মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় দেউলিয়া হলো যুক্তরাষ্ট্রের ২য় বৃহত্তম ব্যাংক
চলতি সপ্তাহের বুধবারও আর দশটি সাধারণ ব্যাংকের মতো বাণিজ্যিক ও আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিপি), যা দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক ব্যাংক
মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে দিশেহারা আমেরিকা ও ব্রিটেন
ইউক্রেনে খাদ্য সরবরাহের লক্ষ্যবস্তুতে ভøাদিমির পুতিনের ইচ্ছাকৃত নীতি একটি সঙ্কটকে আরও বাড়িয়ে তুলছে যা ৪ কোটি ৩০ লাখ মানুষকে দুর্ভিক্ষের মুখে দিয়েছে বলে পশ্চিমা কর্মকর্তারা দাবি করেছেন। তবে রাশিয়া বলছে, পশ্চিমা দেশগুলোর অবিবেচক সামষ্টিক অর্থনৈতিক পদক্ষেপগুলো বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তাকে ধ্বংস করেছে। এদিকে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে একের পর একের নিষেধাজ্ঞা দিয়ে এখন নিজেরাই সঙ্কটে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। গত মঙ্গলবার রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন বলেছিলেন, পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা ‘অর্থনৈতিক আত্মহত্যা’র সমতুল্য। তার কথাই এখন সত্যি বলে প্রমাণিত হচ্ছে।
বুধবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আনাতোলি আন্তোনভ বলেছেন, ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযান শুরুর অনেক আগে থেকেই এই অঞ্চলে সমস্যা শুরু হয়েছিল। জাতিসংঘ সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযানের কারণে সামনের মাসগুলোতে বৈশ্বিক খাদ্য সঙ্কট তৈরি হতে পারে। সংস্থাটির মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, এই যুদ্ধের কারণে দাম বৃদ্ধি পাওয়াতে দরিদ্র দেশগুলোতে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ভয়াবহ পর্যায়ে চলে গেছে। তার আশঙ্কা, শেষ পর্যন্ত ইউক্রেন থেকে রপ্তানি স্বাভাবিক না হলে বিশ্ব দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হতে পারে।
রাশিয়ার হামলার কারণে ইউক্রেনের বন্দরগুলো দিয়ে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ এসব বন্দর দিয়ে বিপুল পরিমাণ সূর্যমুখী তেল, গম ও ভুট্টা রপ্তানি হতো। এগুলো বন্ধ হয়ে পড়ায় এখন বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যাপক কমেছে এবং এর ফলে বিশ্বব্যাপী এসব পণ্যের দাম ব্যাপক বেড়েছে। জাতিসংঘের হিসেবে গত বছরের তুলনায় এ বছর খাদ্যপণ্যের দাম ইতোমধ্যেই সারাবিশ্বে অন্তত ৩০ শতাংশ বেড়েছে। নিউইয়র্কে বুধবার গুতেরেস সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ইউক্রেনের খাদ্যশস্য স্বাভাবিক পর্যায়ে আনা ছাড়া খাদ্য সঙ্কটের কার্যকর কোন সমাধান নেই। একই ভাবে বৈশ্বিক বাজারে রাশিয়া ও বেলারুশের সারেরও বিকল্প নেই। প্রসঙ্গত, রাশিয়া ও ইউক্রেন বিশ্বের যত গম উৎপন্ন হয় তার ত্রিশ ভাগ উৎপাদন করে। যুদ্ধের আগে ইউক্রেন ৪৫ মিলিয়ন টন খাদ্য শস্য প্রতি মাসে রপ্তানি করতো। কিন্তু রাশিয়ার অভিযানের পর সব রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেছে এবং জাতিসংঘের হিসেবে ২০ মিলিয়ন টন ভুট্টা এখনো সেখানে আটকা পড়ে আছে। পশ্চিমা কর্মকর্তারা বলেছেন যে, তারা খাদ্য সরবরাহ পাওয়ার উপায় নিয়ে কাজ করছেন। বর্তমানে ইউক্রেনের বন্দরগুলো হয় রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে, নাহয় অবরোধের মধ্যে আছে। স্থলপথে ইউক্রেনের শস্য পরিবহণ সময় ও ব্যায় সাপেক্ষ। তাই কর্মকর্তারা বলেছেন যে. সহজ সমাধান রাশিয়ান বাহিনী যদি জাহাজ ছেড়ে যেতে অনুমতি দেয়। কর্মকর্তারা যোগ করেছেন, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল রপ্তানি রুটগুলি আনবøক করার জন্য রাশিয়ার উপর চাপ সৃষ্টি করা।’
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্লেটে অনেক কিছু রয়েছে। বর্তমানে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন সংস্থাটি খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা করতে বৃহস্পতিবার বৈঠক করবে। গত বছর ইউক্রেন বিশ্বের লেনদেনকৃত গমের প্রায় এক-দশমাংশ, তার ভুট্টার ১৩ শতাংশ এবং সূর্যমুখী তেলের প্রায় অর্ধেক সরবরাহ করেছিল—যা ৪০ কোটি মানুষকে খাওয়ানোর জন্য যথেষ্ট। কিন্তু এ বছর এর বন্দরগুলো রাশিয়া অবরুদ্ধ করে রেখেছে। এটি, আমেরিকা, ফ্রান্স এবং ভারতের মতো অন্যান্য রুটির ঝুড়িতে খরার পাশাপাশি শস্যের দাম রেকর্ড স্তরের কাছাকাছি রাখছে। যুদ্ধ চলতে থাকলে সঙ্কট আরও বাড়বে। ইউক্রেনের গ্রীষ্মের ফসল ব্যাহত হবে; তাই পরবর্তী একটি রোপণ করা হবে. এদিকে, সারের একটি বৈশ্বিক সঙ্কট, যার মধ্যে রাশিয়া একটি প্রধান রপ্তানিকারক, বিশ্বব্যাপী ফসলের ফলন কমিয়ে দিতে পারে। ইউক্রেনে শান্তিই সুস্পষ্ট সমাধান। এটি ব্যর্থ হলে, কৃষ্ণ সাগরকে এর রপ্তানির জন্য উন্মুক্ত করা অনেক দূর এগিয়ে যাবে। তবে রাশিয়া, ইউক্রেনের অর্থনীতিকে শ্বাসরোধ করার অভিপ্রায়, এটি ঘটতে দেবে বলে মনে হচ্ছে না।
ইউক্রেনের অর্থনীতিবিদ আন্দ্রে স্টাভনিটসার বলেছেন যে, ইউক্রেনীয় শস্য গুদামগুলো মূলত পূর্ণ, এবং এই বছরের ফসলের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা নেই। ‘যদি আমরা এটি সংরক্ষণ করতে না পারি, এটি পচতে শুরু করবে,’ তিনি বলেছেন। হতাশাজনকভাবে, রাশিয়া অধিকৃত এলাকা থেকে সেই ফসল বাজেয়াপ্ত করে সাগর পথে রপ্তানি করতে সক্ষম হবে যখন ইউক্রেন বন্ধ থাকবে। ‘ওডেসাকে অবরোধ মুক্ত করা ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ করার মতোই গুরুত্বপূর্ণ,’ তিনি বলেছেন।
নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বিপদে আমেরিকা ও ব্রিটেন : পুতিনের দূরদর্শী সিদ্ধান্তে রাশিয়া পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা সফলতার সাথে মোকাবেলা করলেও কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছে ব্রিটেন ও আমেরিকা। যুক্তরাজ্যের মুদ্রাস্ফীতি বিগত ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। গত মাসে দেশটির মুদ্রাস্ফীতি সর্বোচ্চ নয় শতাংশে পৌঁছেছে। দেশটিতে গত এক বছর খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়েছে অন্তত সাত শতাংশ। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই মুদ্রাস্ফীতি দেশটির নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ জীবনধারণের ক্ষেত্রে সব ধরনের খরচ বাড়াতে পারে।
যুক্তরাজ্যের অফিস ফর ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিকস বুধবার (১৮ মে) জানিয়েছে, বর্তমানের মুদ্রাস্ফীতির হার ১৯৯০-এর দশকের যুক্তরাজ্যের মহামন্দার সময়ের মুদ্রাস্ফীতির হারকেও পেছনে ফেলেছে। অনেকেই এই মুদ্রাস্ফীতির ফলে ৯০-এর দশকের আকাশছোঁয়া সুদের হারের কথাও স্মরণ করছেন। যুক্তরাজ্য বর্তমানে ইউরোপের সর্ববৃহৎ ৫ অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ মুদ্রাস্ফীতি বিরাজ করছে। জি-সেভেন ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যেও যা সর্বোচ্চ।
একইভাবে, করোনাভাইরাসের প্রকোপ থেকে উঠে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই মূল্যস্ফীতির মুখে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বেড়ে যাচ্ছে জিনিসপত্রের দাম, বাড়ছে জীবনযাত্রার ব্যয় ও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ। এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৮০ সালের পর কখনই পণ্যের দাম এতটা বাড়েনি। দেশটির হাউজিং মার্কেটে দেখা দিয়েছে মারাত্মক অস্থিরতা। ভোক্তাদের পকেটের টাকা বাতাসের মতো মিলিয়ে যাচ্ছে।
অর্থনীতিবিদরা ভয় পাচ্ছেন, ২০০৭ সালের মতো মূল্যস্ফীতি থেকে অর্থনৈতিক মন্দার দিকে ধাবিত হতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হার ছড়িয়ে গেছে বিগত ২২ বছরের রেকর্ড। এ ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান জেরম পাওয়েল বলেছেন, মূল্যস্ফীতি না কমা পর্যন্ত সুদের হার বাড়তে থাকবে। ফেডারেল রিজার্ভের এমন সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে ওয়াল স্ট্রিটের ব্যাংকগুলো জানিয়েছে, এভাবে সুদের হার বাড়াতে থাকলে খুব দ্রæত যুক্তরাষ্ট্র মূল্যস্ফীতি থেকে অর্থনৈতিক মন্দার দিকে ধাবিত হবে।
ফলে এখন পশ্চিমাদের কাছে এখন রাশিয়ার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই। এতদিন ইউক্রেন যুদ্ধের মাধ্যমে তারা ফায়দা নিতে চাইলেও বর্তমানে তারা নিজেরাই সঙ্কটে পড়ে গিয়েছে। বরং, রাশিয়া সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। যার ফলে, বিচক্ষণ পুতিনের কাছে হার মানা ছাড়া পশ্চিমাদের কাছে আর খুব বেশি বিকল্প নেই বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। সূত্র : তাস, ইউকে স্ট্যান্ডার্ড, বিবিসি, ডেইলি সাবাহ, ইকোনমিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।