Inqilab Logo

রোববার, ১৬ জুন ২০২৪, ০২ আষাঢ় ১৪৩১, ০৯ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

জলবায়ু দুর্যোগ মোকাবেলায় সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন

সম্পাদকীয়-২

| প্রকাশের সময় : ১৮ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মরক্কোর মারাক্কাশে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী আবারো জলবায়ুতাড়িত দুর্যোগ ও অভিবাসী সমস্যা সমাধানে বিশ্বসম্প্রদায়ের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। বিশ্বের দেশগুলো প্রতিনিয়ত নানা ধরনের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা করছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকেও কোন রাষ্ট্র মুক্ত নয়। তবে বিশ্বের উষ্ণায়ন ও জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়টি গত দুই দশকের বেশী সময় ধরে বিশেষভাবে আলোচিত হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ উপকূল থেকে শুরু করে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে এ সময়ে অনেকগুলো সুনামি ও সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগের আঘাতে ব্যাপক প্রাণহানি ও ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে। জলবায়ুর পরিবর্তনের নিয়ামক কারণগুলো এখন আর কারো অজানা নয়। মূলত পশ্চিমা ও শিল্পোন্নত বিশ্বের শিল্পায়ন, বনভূমি ও জলাভূমি ধ্বংস ও মাত্রাতিরিক্ত ফসিল জ্বালানি ব্যবহারের কারণেই গত এক শতাব্দীতে বিশ্বের জলবায়ুর বিপজ্জনক পরিবর্তন ঘটলেও এর চরম মাসুল দিতে হচ্ছে প্রধানত বাংলাদেশের মত স্বল্পোন্নত ও জনবহুল দেশগুলোকে। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত ফ্রেমওয়ার্কের জাপানের কিউটোতে স্বাক্ষরিত কনভেনশন অনুসারে জলবায়ুর পরিবর্তনের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় যে সব উদ্যোগ গ্রহণের কথা ছিল, গত দুই দশকের বেশী সময়ে তার সিকিভাগ লক্ষ্যও অর্জিত হয়নি।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ এখন আর কল্পিত বা অনিশ্চিত বিষয় নয়। যদিও ডোনাল্ড ট্রাম্পের মত পশ্চিমা নেতারা এখনো জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলার ইস্যুটিকে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করছেন। মারাক্কাশ সম্মেলনের মাত্র ১০দিন আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় জলবায়ু ইনিশিয়েটিভ ও ফান্ডগঠনের প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের ছেদ ঘটার আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে ইতিমধ্যে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক উদ্যোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে বলে আশ্বস্ত করেছেন। তবে একের পর এক আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলেও বাংলাদেশের মত ভুক্তভোগী দেশগুলো আন্তর্জাতিক তহবিল থেকে কাক্সিক্ষত সহায়তা পাচ্ছেনা। বিশেষত ধনী ও শিল্পোন্নত দেশগুলো তাদের প্রতিশ্রুত চাঁদা পরিশোধে গড়িমসি করছে। বিগত এক দশকে একাধিক উপকূলীয় ঘূর্ণিঝড়ের শিকার হয়ে বিশাল এলাকা নোনা পানিতে প্লাবিত হয়ে লাখ লাখ মানুষ গৃহহীন-উদ্বাস্তুতে পরিণত হলেও এদের পুনর্বাসনের কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়নি। প্রায় দশক আগে ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলায় ক্ষতিগ্রস্তদের অনেক পরিবার এখনো ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবেলায় গঠিত আন্তর্জাতিক তহবিল, কারিগরি ও কৌশলগত সহায়তা ঠিকমত কাজে লাগানো গেলে এসব হতভাগ্য মানুষ যেমন নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি পেত, সেই সাথে আগামীতে সম্ভাব্য আরো বড় ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করাও তাদের পক্ষে সম্ভব হতো।
সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, আগামী বছরগুলোতে বিশ্বে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ২ কোটি ৬০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাবে এবং এর আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হবে প্রায় ৫২ হাজার কোটি ডলার। এ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে মার্কিন দার্শনিক ও সমাজবিশ্লেষক নোয়াম চমস্কি জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতির সবচেয়ে বড় শিকার হিসেবে বাংলাদেশের কথা বলেছেন। নব নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্লাইমেট চেঞ্জ ইস্যুটিকে অস্বীকার করার যে অবস্থানের কথা জানা যায়, তা’ থেকে সরে না আসলে বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ উদ্বাস্তু হবে বলে চমস্কি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হওয়া রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে শুরু থেকেই বাংলাদেশের নাম আলোচনার শীর্ষে রয়েছে। এ কারণে জলবায়ু দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক উদ্যোগ ও তহবিলের ন্যায্য হিস্যা আদায়ে বাংলাদেশ সরকারের জোরালো ভূমিকা প্রত্যাশা করেন দেশের মানুষ এবং সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিরাও। সেই সাথে বাংলাদেশের কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা, জীব-বৈচিত্র্য, টেকসই ও পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নিশ্চিত করতে দেশের নদী ব্যবস্থাপনা ও আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানির ন্যায্য হিস্যার দাবী আদায়ে সরকারের সুদৃঢ় ও জোরালো উদ্যোগ প্রয়োজন। সদ্যসমাপ্ত মারাক্কাশ জলবায়ু সম্মেলন থেকে আমাদের প্রাপ্তি কি তা’ এখনো স্পষ্ট নয়। তবে প্রধানমন্ত্রী তার বক্তৃতায় ধনী রাষ্ট্রগুলো কথা না রাখলে কোটি মানুষের জীবন-মরণ ঝুঁকির কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। চলতি মাসের ২৮-৩০ তারিখে হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে অনুষ্ঠিতব্য ওয়াটার সামিটে বাংলাদেশের পানি সমস্যাকে যথাযথভাবে তুলে ধরার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়েছে, ওয়াটার সামিটে ভারত ও চীনের কাছে পানির ন্যায্য হিস্যা চাইবে বলে প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যৌথ নদীর পানি এবং জলবায়ুর তহবিল থেকে ন্যায্য হিস্যা আদায়ে বাংলাদেশ এখনো তেমন কোন জোরালো উদ্যোগ নিতে পারেনি। পরিবর্তিত বিশ্ব প্রেক্ষাপট এবং সম্ভাব্য দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় সমন্বিত প্রস্তুতি গ্রহণ করতে না পারলে বাংলাদেশের কয়েক কোটি মানুষ উদ্বাস্তু ও অতি দরিদ্র মানুষে পরিণত হবে। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে মেগা অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নের চেয়ে পানি সংকট ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন