মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় দেউলিয়া হলো যুক্তরাষ্ট্রের ২য় বৃহত্তম ব্যাংক
চলতি সপ্তাহের বুধবারও আর দশটি সাধারণ ব্যাংকের মতো বাণিজ্যিক ও আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিপি), যা দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক ব্যাংক
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে যতবারই রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে টেলিভিশনে দেখা গেছে, ততবারই তিনি রাশিয়ান জাতিকে একটি কথা বারবার মনে করিয়ে দিতে ভোলেননি; নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রাশিয়ার চেয়ে পশ্চিমারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
রাশিয়াকে দীর্ঘকালীন ধাক্কার জন্য প্রস্তুত করতে কাজ করছেন পুতিন। সম্প্রতি বিমান পরিবহনের কর্মকর্তাদের তিনি বলেছেন, ‘পশ্চিমাদের মিলিত শক্তি রাশিয়ার ওপর দেওয়া অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দ্রুতই পিছু হটবে না।’ তাই দেশের ভেতরে থাকা সুযোগগুলোকে কাজে লাগিয়েই রাশিয়াকে দীর্ঘকালীন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
স্বনির্ভর রাশিয়া নিয়ে পুতিনের নীতি অবশ্য আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছিল। ২০১৪ সালে ইউক্রেন থেকে ক্রিমিয়া দখল করে নেওয়ার পর থেকে পশ্চিমা শক্তির বাড়তি নিষেধাজ্ঞা মোকাবেলার জন্য ‘ফোরট্রেস রাশিয়া’ কৌশলের মাধ্যমে প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করে রাশিয়া।
তারপরও গত ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে আক্রমণের রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা শক্তির ক্রমাগত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও পশ্চিমা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোর রাশিয়া থেকে ব্যবসায় গুটিয়ে নেওয়া দেশটির জন্য ধাক্কা হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছে।
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ গত মার্চে স্বীকার করে নিয়েছিলেন পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা কড়া হয়ে দেখা দিয়েছে রাশিয়ার কাছে। রাশিয়ার ৬০০ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ ফ্রিজ করা প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, 'নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে যারা যারা আঁচ করছিলেন, তারা নিজেরাও ভাবতে পারেননি এ পর্যায়ের অবস্থার কথা।'
রাশিয়া জানিয়েছে, দেশটি তাদের বৈদেশিক রিজার্ভের ওপর এ নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আদালতে চ্যালেঞ্জ জানাবে। যদি দেখা যায় রিজার্ভে নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া ঋণখেলাপির মুখে পড়েছে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মামলাও করবে দেশটি।
আপাতত যে ৪টি কৌশলে রাশিয়া ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, সেগুলো জেনে নেওয়া যাক।
১. লাডা-কে ঢেলে সাজানো
রাশিয়ার সোভিয়েত যুগের গাড়ি-ব্র্যান্ড লাডা। তবে এটি খুব বেশিমাত্রায় যন্ত্রাংশ আমদানির ওপর নির্ভরশীল। আভটভাজ কোম্পানি লাডা’র গাড়িগুলো তৈরি করে। তবে এটি আবার ফরাসি ব্র্যান্ড রেনোর মালিকানাধীন।
এ বছরের ২৪ মার্চ রেনোর রাশিয়ার বাজার ছেড়ে যাওয়ার খবর চাউর হওয়ার পর আভটভাজ জানিয়েছিল তারা কয়েকটি মডেলের গাড়ি দ্রুত নতুন করে ডিজাইন করছে যাতে আমদানিকৃত যন্ত্রাংশের ওপর বেশি নির্ভর করতে না হয়।
কিন্তু আভটভাজ জানায়নি কোন মডেলের গাড়ি বর্তমান পরিস্থিতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, বরং বলেছিল সামনের মাসগুলোতে গাড়িটি বাজারে আসবে। তবে নতুন ডিজাইন করার মানে হচ্ছে গাড়িগুলোকে স্রেফ আরেকটু সাদাসিধাভাবে কিছু ফিচার বাদ দিয়ে তৈরি করা হবে।
২. ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারীদের কনটাকচা'য় আনা
এই কিছুদিন আগেও মাসিক হিসাবে ইনস্টাগ্রাম ছিল রাশিয়ার সবচেয়ে বড় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। দ্বিতীয় স্থানে ছিল ফেইসবুকের মতো রাশিয়ার নিজস্ব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কনটাকচা।
ইউক্রেনে আক্রমণ ও তৎপরবর্তীকালে ফেইসবুক ও ইনস্টাগ্রাম-এর রাশিয়ায় সেবা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে কনটাকচা'র ডেভেলপারেরা চাইছেন কন্টেন্ট নির্মাতাদের তাদের প্লাটফর্মে আনার জন্য।
এ জন্য কোম্পানিটি আপাতত কোনো কনটেন্টের আয় থেকে এপ্রিল মাসে লভ্যাংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এমনকি কোনো কন্টেন্ট নির্মাতা যদি মার্চের পর থেকে কনটাকচায় যোগ দেন বা পুরনো অ্যাকাউন্ট সচল করেন, তাহলে তাদেরকে ফ্রি প্রমোশনের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে এটি।
কনটাকচা'র উপাত্ত অনুযায়ী, এ প্রক্রিয়া ভালোই কাজ করছে। গত মার্চ মাসে এ প্লাটফর্মে রেকর্ডসংখ্যক দশ কোটি ব্যবহারকারী দেখা গিয়েছে। অন্যদিকে রাশিয়াতে ব্যবহারকারী হারিয়েছে ইনস্টাগ্রাম।
অবশ্য অনেক রাশিয়ান ইনস্টাগ্রাম নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ভিপিএন ব্যবহার করে এখনো ইনস্টাগ্রাম ব্যবহার করছেন। তবে তাদের অনেকে, বিশেষত যারা ইস্টাগ্রামে ব্যবসায় পরিচালনা করতেন, তারা প্রায়ই যুদ্ধবিরোধী বার্তা পাচ্ছেন। এসব মেসেজে অনেক ক্ষেত্রেই আক্রমণাত্মক ভাষা ও কটু কথা'র ব্যবহার করা হচ্ছে।
৩. দেশীয় ক্রেডিট কার্ড
ক্রিমিয়ার ঘটনার পরে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় রাশিয়ার অনেক ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন থেকেই অর্থনৈতিকভাবে একঘরে হওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিল রাশিয়া। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটা সুফল দিয়েছে রাশিয়াকে।
রাশিয়া নিজস্ব ন্যাশনাল পেমেন্ট কার্ড সিস্টেম ও ব্যাংক কার্ড সিস্টেম তৈরি করেছে যা 'মির' নামে পরিচিত। এ সেবাটি দ্রুতই বড় হয়েছে।
রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০১৬ সালে ১.৭৬ মিলিয়ন মির কার্ড ইস্যু করা হয়। ২০২১ সালে এ সংখ্যা বেড়ে ১১৩ মিলিয়নে দাঁড়িয়েছে। গত বছরে রাশিয়ার সব ধরনের কার্ডের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেনের সিকিভাগ মির কার্ড দিয়ে হয়েছে।
ফিনিশ ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স-এর ভিজিটিং সিনিয়র ফেলো মারিয়া শাগিনা বলেন, 'রাশিয়ানরা আক্রমণের আগে সাধারণ নাগরিকদের কাছে ওই কার্ডটি বেশি আবেদনময় করে উপস্থাপন করেনি। তার বদলে সরকার নির্ধারণ করেছিল সরকারি কর্মকর্তা, পেনশনভোগী, ও অন্য যে কেউ কোনো সরকারি সেবা গ্রহণ করতে চাইলে তাদেরকে মির কার্ড ব্যবহার করতে হবে।'
অর্থাৎ মার্চ মাসে ভিসা ও মাস্টারকার্ড যখন ঘোষণা করেছিল তারা রাশিয়ায় তাদের কার্যক্রম স্থগিত করছে, তখন আদতে রাশিয়ার কাছে নিজস্ব বিকল্প ইতোমধ্যে ছিল। তবে মিরের সীমাবদ্ধতা হলো এটি কেবল রাশিয়া ও অল্প কয়েকটি প্রাক্তন সোভিয়েত দেশে কাজ করে। মিরের এই বিশ্বায়নের ব্যর্থতায় রাশিয়ার সুইফট-এর বিকল্প তৈরি ব্যাহত হয়েছিল।
আন্তর্জাতিক পেমেন্ট সিস্টেম সুইফট-এর যে বিকল্প রাশিয়ার হাতে আছে তা এসপিএফএস নামে পরিচিত। গত বছর এটি ৪০০ জন ব্যবহার করেছিলেন, যেখানে সুইফট-এর ছিল ১১ হাজার ব্যবহারকারী।
৪. সরকারি খাতে চাকরি
রাশিয়াতে এখনো গণ-বেকারত্ব দেখা যায়নি। তবে ইউক্রেনে আক্রমণ শুরু হওয়ার পরে অনেক রাশিয়ান রাস্তায় নেমেছিলেন। তাদের অনেকে যেমন স্রেফ যুদ্ধ বন্ধের জন্য মিছিল করেছিলেন, অনেকে আবার নিজেদের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ, চাকরি ইত্যাদির কথা চিন্তা করেই যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ করেছিলেন।
বর্তমানে মস্কো চেষ্টা করছে পশ্চিমা কোম্পানিগুলোতে কাজ করা চাকরি হারানো বিভিন্ন মানুষকে নতুন কাজের সুযোগ করে দেওয়ার। মস্কোর মেয়র মনে করছেন কমপক্ষে দুই লাখ চাকরি ঝুঁকিতে রয়েছে।
নতুন চাকরি তৈরি করার জন্য ৪১ মিলিয়ন ডলার বাজেট রেখেছে মস্কো। তবে অনেক বিশেষজ্ঞ ধারণা করছেন, পশ্চিমা কোম্পানিগুলোতে যেসব রাশিয়ান উচ্চপদে আসীন ছিলেন, তারা দেশ ছেড়ে বাইরে চলে যাবেন।
পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার প্রাথমিক ধাক্কা সামলে নিয়েছে রাশিয়া। দেশটির অর্থনীতি এখনো ধসে পড়েনি। এর প্রধান এটি কারণ হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের খুব দ্রুত সুদহার ২০ শতাংশে তুলে দেওয়া, ও পুজি'র কঠিন নিয়ন্ত্রণ করা।
তবে তার মানে এ নয় যে রাশিয়ার সামনে আর কোনো দুরবস্থা তৈরি হবে না। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর তথ্য অনুযায়ী, রাশিয়ার অর্থনীতি ৮.৫ শতাংশ কমে যেতে পারে এ বছর। ইউরোপ যদি রাশিয়ান তেল আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়, তাহলে অর্থনীতির এ ধস আরও বেশি হবে।
অন্যদিকে রাশিয়ার মুদ্রাস্ফীতি এখন ১৭.৫ শতাংশ। এ ব্যাপারে পুতিনও একমত্য হয়েছেন যে এভাবে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ রাশিয়ানরা।
রাশিয়ার জন্য আরেকটি বড় ঝুঁকি হলো দেশটির আমদানি পণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা। এসব পণ্যের অনেকগুলো বর্তমানে নিষেধাজ্ঞার কবলে আছে। সূত্র: সিএনএন
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।