পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বাংলাদেশকে বলা হয় ধর্মভীরু মানুষের দেশ। পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের মানুষ ধর্মাচারে বাংলাদেশের চেয়ে যে পিছিয়ে, এটি মনে করার যৌক্তিক কারণ রয়েছে। ধর্মনিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমানদের তুলনা যেমন নেই, তেমনি তুলনা নেই সনাতন ধর্মাবলম্বী, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানদেরও। অথচ, অত্যন্ত দুঃখজনক, পৃথিবীর সব ধর্মে ধর্ষণ ও নারী-শিশু নির্যাতনকে মহাঅপরাধের দৃষ্টিতে দেখা হলেও বাংলাদেশ দিনে দিনে ধর্ষকদের অভয়ারণ্যে পরিণত হচ্ছে। দেশে যত ধর্ষণ ঘটে মানসম্মানের ভয়ে তার সিংহাভাগই প্রকাশ্যে আসে না। তার পরও ২০২১ সালে সারাদেশে ১ হাজার ১১৭ কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে একক ধর্ষণের শিকার ৭২৩ আর দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয় ১৫৫ জন। এর মধ্যে ২০০ প্রতিবন্ধী কন্যাশিশুও রয়েছে।
সম্প্রতি জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে ২০২১ সালের কন্যাশিশু নির্যাতন নিয়ে জরিপ প্রকাশ করে জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে এ জরিপ পরিচালিত হয়। জরিপ অনুযায়ী, গত এক বছরে দেশে কন্যাশিশু ধর্ষণের হার বৃদ্ধি পেয়েছে ৭৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ। ২০২১ সালে মোট ১১৬ কন্যাশিশু যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচজন বিশেষ শিশুও আছে। ২০২০ সালে এ সংখ্যা ছিল ১০৪। গত বছরের তুলনায় এ বছর যৌন হয়রানি বৃদ্ধির হার প্রায় ১২ শতাংশ। এ ছাড়া ২০২১ সালে পর্নোগ্রাফির শিকার হয়েছে ৫২ কন্যাশিশু।
২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে কন্যাশিশু ধর্ষণের হার শতকরা ৭৪ দশমিক ৪৩ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০২১ সালে অ্যাসিডের আক্রমণের শিকার হয়েছে ১০ কন্যাশিশু। পারিবারিক বিবাদ, প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হওয়া, সম্পত্তিসংক্রান্ত আক্রোশ, ইত্যাদি কারণে অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে বলে জানা যায়। অপহরণ ও পাচারের শিকার হয়েছে ২০৬ কন্যাশিশু। এর মধ্যে অপহরণের শিকার হয়েছে ১৯৭ জন।
২০২০ সালের আগস্ট থেকে ২০২১ নভেম্বর পর্যন্ত মোট বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে ২ হাজার ৮৬৮ কন্যাশিশু। গড়ে প্রতিটি ইউনিয়নে ২১ কন্যাশিশু বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে, যা ২০১৯ সালের তুলনায় ১৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেশি।
অন্যদিকে ২০১৯ সালে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছিল ২ হাজার ৫০৩ কন্যাশিশু। ২০২১ সালে যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয় ১৭ কন্যাশিশু। এর মধ্যে যৌতুক দিতে না পারায় ৯ জনকে হত্যা করা হয়েছে।
এ ছাড়া ২০২১ সালে গৃহশ্রমিক নির্যাতনে ৩৫টি ঘটনার খবর জানা গেছে। এর মধ্যে ১৮ জনকে শারীরিক নির্যাতন, পাঁচজনকে নির্যাতনের পর হত্যা এবং ১২ জন যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ২৪২ কন্যাশিশু আত্মহত্যা করেছে। ২৭২ জনকে হত্যা করা হয়েছে এবং ৩৫ কন্যাশিশুকে বিভিন্ন স্থানে ফেলে রেখে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে।
প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, দেশে প্রতিদিন সহ¯্রাধিক কন্যাশিশু পর্নোগ্রাফি ও সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়। এর মধ্যে গড়ে ২৫-৩০ জন ভিকটিম সাইবার হয়রানি সম্পর্কিত অভিযোগ কেন্দ্রে মৌখিক ও লিখিত অভিযোগ দাখিল করে। দেশে ধর্ষকদের দৌরাত্ম্য নিঃসন্দেহে জাতীয় লজ্জার ঘটনা। এ অপরাধ রোধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ সব সামাজিক প্রতিষ্ঠানকে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে করতে হবে সক্রিয়।
মনে রাখতে হবে, ধর্ষণের ঘটনায় কেবল ধর্ষকই অপরাধী নয়, সমাজও অপরাধী। যে সমাজ পুরুষকে শেখায় পুরুষই শ্রেষ্ঠ, পুরুষই বলিষ্ঠ, সেই সমাজ কেমন করে নারীকে সুরক্ষা দেবে? গলদ আমাদের শিক্ষায়, মানসিকতায়, নারী ও পুরুষ সম্পর্কে আমাদের প্রথাগত ধারণায়। ফলে সমাজে ধর্ষণের অপরাধ বন্ধ করতে হলে প্রতিটি ধর্ষণের শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি সমাজের ইতিবাচক বদলের প্রয়াসে জোর দিতে হবে। এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, বিচার না হওয়া ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন বন্ধ না হওয়ার অন্যতম কারণ। সাম্প্রতিক নানা পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ধর্ষণ বন্ধ হওয়া তো দূরের কথা বরং দেশে ধর্ষণ দিন দিন বাড়ছেই। হাইকোর্ট নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালগুলোতে বিচারাধীন ধর্ষণ ও ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যামামলাগুলো অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে দ্রæত সম্পন্ন করার নির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করাসহ ওই সাত দফা নির্দেশনা বাস্তবায়নে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রায় নব্বই শতাংশের উপরে ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশিত হয় না। লোকলজ্জা, পারিবারিক ও সামাজিকতার কারণে এসব ঘটনা আড়ালেই থেকে যায়। বিচারহীনতা ও ভয়ের সংস্কৃতির কারণে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলেছে। শুধু ধর্ষণ নয়, একই সঙ্গে ধর্ষণ ও হত্যার বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে এরই মধ্যে।
জাতীয়ভাবে বড় প্রতিবাদ না হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তেমন জোরালো ভূমিকা দেখা যায় না। সাধারণত অধিকাংশ ক্ষেত্রে দরিদ্র ও দুর্বল ঘরের মেয়েরাই ধর্ষণের শিকার হয়। দীর্ঘমেয়াদে মামলা চালানোর মতো অর্থ ও সময় তাদের পরিবার দিতে পারে না। সামাজিকভাবেও তাদের অবস্থান শক্তিশালী নয়। বিপরীত দিকে অর্থবিত্ত বা সামাজিকভাবে প্রভাবশালীরা বা তাদের মদদপুষ্টরাই ধর্ষণের মতো অপরাধ করে। ফলে এসব ক্ষেত্রে পুলিশ মামলা নিতে গরিমসি করে, মামলা নিলেও তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে টালবাহানা করে, অপরাধীদের বাঁচিয়ে প্রতিবেদন দেয় কিংবা অপরাধী প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও পুলিশ তাদের দেখতে পায় না। এরকম অভিযোগ অজগ্র।
স্বীকার করতেই হবে যে, ধর্ষকরাও আমাদের সমাজেরই কোনো না কোনো পরিবারের সদস্য। তাদের বখে যাওয়ার দায় রয়েছে পরিবার-সমাজেরও। তরুণদের সুস্থ-সুন্দর মন ও মূল্যবোধ সম্পন্ন করে গড়ে তুলতে পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারছে না, এটাও স্পষ্ট। মাদকের ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গেও এরকম অপরাধের হার বৃদ্ধির যোগসূত্র আছে বলে অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ যে মাত্রায় বেড়েছে, লাগাম টেনে না ধরা গেলে তা সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নেবে। ধর্ষণ প্রতিরোধে জরুরি অপরাধীর যথার্থ শাস্তি নিশ্চিত করা। দুর্বল ভিকটিমদের পক্ষে রাষ্ট্রকেই এগিয়ে আসতে হবে।
অপরাধ তদন্তে ও অপরাধীদের বিচারাধীন করায় পুলিশকে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। সামাজিক প্রতিরোধ গড়তে এগিয়ে আসতে হবে ব্যক্তি-সংগঠনকে। ঘরে-বাইরে সর্বত্র নারীদের নিরাপত্তা দিতে হবে।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।