পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আজকের বিশ্বসভ্যতা যে সংকট ও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে তা পেছনের মূল মূল কার্যকারণ সম্পর্কে খুব বেশি আলোচনা-পর্যালোচনা হয়নি। একেকটি রক্তক্ষয়ী প্রাণঘাতি যুদ্ধে লাখ লাখ মানুষের জীবন যায়, কোটি কোটি মানুষের সম্পদ ও জীবিকা বেহাত হয়ে যায়, সামাজিক-রাজনৈতিক নিরাপত্তা সামরিক জান্তার ট্যাঙ্ক থেকে সেনানায়কের বুটের তলায় নিষ্পেষিত হতে থাকলেই কেবল আমাদের সামনে সভ্যতার সংকট চোখে পড়ে। তার আগে শুধুই আড়ম্বরতা দেখি, চাকচীক্য আর জ্ঞান-বিজ্ঞানের ঔৎকর্ষের চমক নিয়ে বিভোর থাকি আমরা। অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান রাজপুত্র ফ্রান্জ ফার্দিনান্দ ও তার স্ত্রী সারায়েভোর মেট্টোতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণের প্রেক্ষাপটে ইউরোপে প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হলেও এ যুদ্ধের ধাক্কায় উসমানীয় খেলাফত তথা ইউরেশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রে বড় পরিবর্তন ঘটে যায়। বৃটেন, ফ্্রান্স, ইতালিসহ ইউরোপের ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো অটোমান সাম্রাজ্যকে অনেকটা যুদ্ধবিজয়ে গণিমাতের মালের ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়ার মত ভাগ করে নেয়। সাইক্স-পইকট চুক্তিসহ যুদ্ধ চলার সময়ে এসব দেশের মধ্যে যে চুক্তি ও রাজনৈতিক বোঝাপড়া হয়েছিল অঘোষিতভাবে তা’ এখনো কার্যকর রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সে সব ভূ-রাজনৈতিক বোঝাপড়ার সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নতুন কুশীলবের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। আর এসবের নেপথ্যে সক্রিয় থাকে ইউরোপের সুদি মহাজন তথা ইহুদি ব্যাংকাররা। জার্মানী, জাপান, তুর্কি ও ইতালীয় অক্ষশক্তির কাছে প্রায় পর্যুদস্ত বৃটিশ-ফরাসী শক্তি যুদ্ধ জয়ের জন্য শেষ পর্যন্ত ইহুদি ধনকুবেরদের সহায়তার দ্বারস্থ হয়েছিল। প্রথম মহাযুদ্ধ চলাকালে ভারতসহ বিভিন্ন দেশের হাজার হাজার মুসলমান বৃটিশ বাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করেছিল। কিন্তু ইহুদি ব্যাংকারদের সহযোগিতার জন্য বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড বালফোর ইহুদি কম্যুনিটিকে যুদ্ধে তার পক্ষে টানতে বৃটিশ ইহুদি কম্যুনিটি লিডার রথশিল্ডকে ফিলিস্তিনের মাটিতে ইহুদিদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনে সহায়তার প্রস্তাব দিয়ে ১৯১৭ সালে একটি চিঠি দেন। বালফোরের এই চিঠি ইতিহাসে বালফোর ডিক্লারেশন নামে পরিচিতি লাভ করেছে। ফিলিস্তিনে ইহুদি জনসংখ্যা শতকরা ১০ ভাগের কম হওয়ায় এই প্রস্তাব ছিল অনেকটাই অযৌক্তিক ও অবাস্তব। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরুর আগেই জামার্নীতে ক্ষমতাসীন নাজি পার্টির তরফ থেকে ইউরোপের ইহুদিদের জন্য মাদাগাস্কারে একটি আবাসভ’মি গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়ে অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে বৃটিশদের হাতে মাদাগাস্কারের উপর নিয়ন্ত্রণ হারায় জার্মানী। এ পরিকল্পনা ভন্ডুল হওয়ার কারণে নাৎসী বাহিনীর কাছে ইহুদি নিধণের পরিকল্পনা আরো অনিবার্যরূপে দেখা দেয়। জার্মান বাহিনীর ইহুদি নিধন বা হলোকষ্টের কাহিনীকে ম্যাগনিফাই করে ইহুদিদের পুনর্বাসনের জন্য ফিলিস্তিনের মাটিতে একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের অবাস্তব ও অনৈতিক পরিকল্পনাকে সামনে রেখে যুদ্ধ শেষে তা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করে ইঙ্গ-মার্কিন ও ফরাসি সাম্রাজ্যবাদী জোট।
প্রথম মহাযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ও ভাগ-বাটোয়ারা, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে হিটলারের বাহিনীর ইহুদি বিতাড়ন ও নিধনের প্রেক্ষাপটে ইহুদিদের জন্য ফিলিন্তিনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিংশ শতকে নতুন বিশ্বব্যবস্থার সূচনা হয়। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পরও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানীর অক্ষশক্তিকে পরাজিত করতে সোভিয়েত ইউনিয়ন অন্যতম ভ’মিকা পালন করেছিল। তবে যুদ্ধের পর পশ্চিমাদের পরিকল্পিত নতুন বিশ্বব্যবস্থায় সোভিয়েতের সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে অগ্রাহ্য ও প্রতিপক্ষে পরিনত করা হয়। জার্মান থেকে বিতাড়িত পদার্থ বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের ফর্মূলা ব্যবহার করে পেন্টাগন ম্যানহাটান প্রকল্পের মধ্য দিয়ে যুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের প্রথম পারমানবিক বোমা ব্যবহার করে এশিয়ার দেশ জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরকে ধ্বংসস্তুপে পরিনত করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ই রাশিয়ার নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড প্রকল্প শুরু হয়। পঞ্চাশের দশকের শুরুতেই রাশিয়ার পারমানবিক শক্তিতে পরিনত হওয়ার মধ্য দিয়ে একটি ভাসাম্য তৈরী হয় যা দুই পক্ষে একটি স্নায়ুযুদ্ধ বা ঠান্ডা লড়াইয়ের জন্ম দিয়েছিল। এটি কোনো রাজনৈতিক আদর্শিক লড়াই নয়, এটি মূলত পুঁজি ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ কায়েমে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আধিপত্যবাদী লড়াই। গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের নামে গত ৭ দশক ধরে এই দুই বলয়ের মধ্যে যে বিভক্তির লড়াই চলছে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের পর তার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইহুদি অলিগার্কদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা, আইএলও, বিশ্বব্যাংক,এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সব আন্তর্জাতিক সংস্থার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে পশ্চিমা ইউনিপোলার বিশ্বব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। গত দুই দশকে ইরাক-আফগানিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর উপর পশ্চিমাদের সামরিক আগ্রাসন ও দখলবাজি, সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন, মিশর, লেবাননে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেও পশ্চিমারা কোনো ধরণের সামরিক বা রাজনৈতিক বিজয় লাভ অথবা যুদ্ধের পক্ষে ন্যুনতম যৌক্তিক অবস্থান নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হওয়ায় পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থা বড় ধরণের নৈতিক প্রশ্ন ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। এতদিন ইঙ্গ-মার্কিন ষড়যন্ত্র বড় ধরণের প্রতিরোধের মুখে না পড়লেও এবার রাশিয়ার ইউক্রেন যুদ্ধ সেই চ্যালেঞ্জ সামনে নিয়ে এসেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিশ্বকে ওলট পালট করে দিতে শুরু করলে আশি বছরের বৃদ্ধ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সভ্যতার সংকট’ নামে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। যুদ্ধ শেষ হওয়ার তিন বছর আগে ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথ ইহলোক ত্যাগ করেন। এই যুদ্ধ পশ্চিমা সভ্যতায় মোহাবিষ্ঠ রবীন্দ্রনাথের কিছুটা হলেও মোহভঙ্গ ঘটিয়েছিল, প্রবন্ধে তারই প্রতিফলন ঘটেছিল। বৃটিশদের প্রতি তিনি নিজের এবং ভারতীয়দের মোহগ্রস্ততার দিকটিকেও উপলব্ধি করেছিলেন। ভারতীয়দের হীনতা, অমানবিকতা ও পিছিয়ে পড়ার জন্য রবীন্দ্রনাথ ইংরেজের শাসন-শোষনকেই ইঙ্গিত করেছেন। জীবন-সায়াহ্নে তাঁর বিশ্বভ্রমণের অভীজ্ঞতার আলোকে সোভিয়েত রাশিয়ার সাম্য নীতি, পারস্য এবং মুসলমান স্বায়ত্বশাসিত দেশগুলোতে মানবিক ঔৎকর্ষ ও মর্যাদার অবস্থানকেও প্রশংসা করেছেন। তিনি জাপান, চীন এবং আফগানিস্তানের সাথে তুলনা করে ভারতীয়দের পশ্চাদপদ অবস্থানের কথা বলতে দ্বিধা করেননি। যুদ্ধের বিভীষিকার মধ্যে সভ্যতার সংকট নিবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলে উঠেন- ‘সমস্ত য়ুরোপে বর্বরতা কি রকম নখদন্ত বিকাশ করে বিভীষিকা বিস্তার করতে উদ্যত। এই মানবপীড়নের মহামারী পাশ্চাত্য সভ্যতার মজ্জার ভিতর থেকে জাগ্রত হয়ে উঠে আজ মানবাত্মার অপমানে দিগন্ত থেকে দিগন্ত পর্যন্ত কলুষিত করে দিয়েছে। আমাদের হতভাগ্য নি:সহায় নীরন্ধ্র অকিঞ্চনতার মধ্যে আমরা কি তার কোনো আভাস পাই নি?’ রবীন্দ্রনাথের এই আত্মোপলব্ধি যদি আরো ২০ বছর আগে ঘটত তাহলে ভারতের স্বাধীনতার সংগ্রাম হয়তো আরো ত্বরান্বিত হতো। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ইউরোপে এই মানবপীড়নের মহামারী পশ্চিমা সভ্যতার মজ্জার ভিতর থেকেই জাগ্রত হয়ে মানবাত্মার অপমানে বিশ্বসভ্যতাকে কলুষিত করেছে। রবীন্দ্রনাথের আগে আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল পশ্চিমা পুঁজিবাদী সভ্যতার ভেতরে কদর্য চেহারা উম্মোচিত করে দেখিয়েছেন।
সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গিয়ে পুঁজিবাদী পশ্চিমা সভ্যতা একমেরুকেন্দ্রীক বিশ্বে পরিনত হওয়ার পর একসময় ঔপনিবেশিক লুণ্ঠনে অভ্যস্ত এই সাম্রাজ্যবাদের সম্পদের ক্ষুধা যেন আরো বেড়ে গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডারের প্রতিপক্ষ সোভিয়েত ইউনিয়নকে মোকাবেলা করার জুজু দেখিয়ে পশ্চিমা অলিগার্করা যে মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্স গড়ে তুলেছিল, পশ্চিমা জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বিশাল সামরিক বাজেটে সে সব অস্ত্র ব্যবসার কুশীলবরা ফুলে ফেঁপে উঠেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ওয়ারশ’ জোট ভেঙ্গে যাওয়ার পর মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের উৎপাদন ও মুনাফা প্রবৃদ্ধি ঠিক রাখতে তাদের একটি শক্তিশালী সামরিক প্রতিপক্ষ প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। উপযুক্ত সময়ে স্যামুয়েল পি হান্টিংটন সভ্যতার দ্বন্দ্ব থিউরি তুলে ধরে মুসলমানদেরকে পশ্চিমা সভ্যতার প্রতিপক্ষ হিসেবে দাড় করানোর একটি রাজনৈতিক ত্বত্ত্ব হাজির করলেন। হার্বাডের প্রফেসর হান্টিংটনের লেখা ‘দ্য ক্লাশ অব সিভিলাইজেশন অ্যান্ড দ্যা রিমেকিং অব ওয়ার্ল্ড অর্ডার’ শিরোনামে ১৯৯৬ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হওয়ার ৫ বছরের মাথায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশ ওয়ার অন টেররিজমের নামে বিশ্বের মুসলমানদের বিরুদ্ধে একটি অন্তহীন যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছিলেন। দুই দশকে অন্তত ৫ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করে ইরাক-আফগানিস্তান থেকে পশ্চিমারা পরাস্ত হয়ে শুণ্য হাতে ফিরে গেলেও ওয়ার অন টেররিজমের সেই গোপণ অভিসন্ধি এখনো সক্রিয় আছে বলেই প্রতিয়মান হয়। জায়নবাদী অলিগার্ক ও মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের কুশীলবদের মূল টার্গেট এখনো মুসলমানদের ধর্ম ও সভ্যতা। হান্টিংটন বলেছেন, আমেরিকা কেন্দ্রিক পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার বড় চ্যালেঞ্জ হবে ইসলামি সভ্যতা। তার এই বক্তব্য মানুষের জীবনধারা হিসেবে ফিলসফিক্যাল ও পলিটিক্যাল ইসলামের অগ্রযাত্রার সম্ভাবনাকেই ইঙ্গিত করে। মার্ক্সবাদী সমাজতন্ত্রের দুর্বলতা ও খন্ডিত অবস্থান ধসে যাওয়ার পর জায়নবাদী অলিগার্কদের পুঁজিবাদি লুণ্ঠন ও অর্থনৈতিক বৈষম্যমূলক নিপীড়নের মহামারীর বিরুদ্ধে ইসলামই একমাত্র আদর্শিক-রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিশাল সম্ভাবনা নিয়ে টিকে আছে।
রাশিয়ার সাথে পশ্চিমাদের দ্বন্দ্ব শুরু থেকেই অর্থনৈতিক। ইউক্রেন যুদ্ধের সেই দ্বন্দ্ব এখন অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক যুদ্ধে রূপ নিয়েছে। এই যুদ্ধে মার্কিন ও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার বিপরীতে রাশিয়ার হাতে তেমন শক্তিশালী অস্ত্র না থাকলেও রাশিয়ার জ্বলানি সম্পদের উপর পশ্চিমাদের নির্ভরতা এবং চীন-রাশিয়ার কৌশলগত ঐক্য-সমঝোতা মার্কিন ডলারের একক আধিপত্যের বিরুদ্ধে একটি নতুন প্রতিরক্ষাব্যুহ তৈরী হতে চলেছে। উল্লেখ্য আমেরিকান ফেডারেল রির্জাভ ব্যাংক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হলেও এটা আসলে একটা প্রাইভেট ব্যাংক এর নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা মার্কিন সরকারের হাতে নেই। এই ব্যাংক এবং ডলারের নিয়ন্ত্রণ মূলত এই ব্যাংকের সাথে জড়িত ইহুদি ব্যাংকার-অলিগার্কদের হাতে। শত বছর আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রু উইলসন ফেডারেল রিজার্ভ অ্যাক্ট আইন পাশ করার আগে থেকেই এই ব্যাংক মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব পালন করছে। ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের ৭জন ডিরেক্টর মার্কিন কংগ্রেস থেকে নিয়োগ দেয়া হলেও ব্যাংক পরিচালনা ও নীতি নির্ধারণে তাদের ভ’মিকা গৌণ। সারাবিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং হাজার হাজার প্রাইভেট ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের ক্লায়েন্ট হিসেবে নিবন্ধিত থাকলেও সে সব ব্যাংকের কোনো প্রতিনিধিত্ব এই সিস্টেমে নেই। বাণিজ্য ও বিনিময়ের ক্ষেত্রে মার্কিন ডলারের বিকল্পহীন একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমকে বৈশ্বিক মূদ্রা নিয়ন্ত্রণের অন্যতম চালিকা শক্তিতে পরিনত করেছে। হাজার হাজার ব্যাংকের গচ্ছিত অর্থে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুললেও শুধুমাত্র ভূরাজনৈতিক কারণে যে কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ক্লায়েন্ট ব্যাংক এই ফেডের নিষেধাজ্ঞা ও সম্পদ আটকের শিকার হতে পারে। বিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে জাপান, উত্তর কোরিয়া, কিউবা, চীন, ইরান, ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, লেবানন থেকে রাশিয়া এখন পর্যন্ত অনেকগুলো দেশ ও অসংখ্য প্রতিষ্ঠান মার্কিন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার শিকার হয়ে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ও শান্তি আলোচনার কোনো উদ্যোগ ছাড়াই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা ও সম্পদ জব্দের ঘোষণা দিয়েছে। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা ও সম্পদ জব্দের কারণে দেশে দেশে সাধারণ নাগরিকদের মানবিক বিপর্যয় দেখা দিতে দেখা গেছে। রাশিয়া এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন ছিল বলে তারা হয়তো বড় ধরণের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে না। তবে এই একচ্ছত্র, অস্বচ্ছ ও জায়নবাদ নিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নাগপাশ ছিন্ন করে এর কার্যকর বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ এখনই জোরদার করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
বিগত শতকের নব্বই দশক পর্যন্ত রাজনৈতিকভাবে দ্বিমেরুকেন্দ্রীক বিশ্বের অস্তিত্ব থাকলেও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার অধীনে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ছিল মূলত পশ্চিমাদের হাতেই। বিনিময়যোগ্য মূদ্রা হিসেবে ডলারের একাধিপত্যের প্রভাব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেন্দ্রিক ইউনিপোলার ওয়ার্ল্ডের পত্তন ঘটিয়েছিল। সামরিক-রাজনৈতিক যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি অনেকাংশেই বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক বিষয় দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে দেখা গেছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ঋণগ্রস্ত দেশ হয়েও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একনম্বর অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে টিকে থাকার প্রধান অস্ত্রই হচ্ছে মার্কিন ডলার এবং তথাকথিত ফেডারেল রির্জাভ ব্যাংক। ইউক্রেন যুদ্ধের এক সপ্তাহের মধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে একের পর এক অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা ও সম্পদ জব্দের ঘোষণা দিতে থাকে। এ ব্যাপারে রাশিয়ার একটি পূর্ব প্রস্তুতি নিশ্চয় ছিল। তারা তাদের মোট রির্জাভের মাত্র ১৬ভাগ ডলারে বিনিময় করেছিল বাকি সম্পদের বেশিরভাগই গোল্ড আকারে সঞ্চিত আছে। অর্থাৎ মার্কিন নিষেধাজ্ঞার প্রাথমিক ধাক্কা সামলে উঠতে পারলে পশ্চিমা শক্তি রাশিয়াকে আর ঠেকাতে পারবেনা। ডলারের একাধিপত্য বিশ্বে বড় ধরণের মানবিক সংকটের সৃষ্টি করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধ এবং রাশিয়ার উপর আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা সেই একাধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রাথমিক কার্যকর ভিত্তি অর্জন করতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে রাশিয়া এবং চীন তার ঘনিষ্ঠ ট্রেড পার্টনারদের সাথে ডলারের বদলে রুবল-ইউয়ানের মাধ্যমে পণ্য বিনিময়ের ঘোষণা দিয়েছে। বিষ্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, এই আহ্বানে সউদি শাসকদের মত মার্কিন অনুগতরাও ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। গত দিন দশকে বিশ্ব বাণিজ্যের অন্যতম অনুঘটক হিসেবে রাশিয়া এবং সউদি আরবের ফসিল জ্বালানির প্রধান ক্রেতা হয়ে উঠেছে চীন। ডলারের বদলে রুবলে রাশিয়ার গ্যাস বিক্রির ঘোষণার পর পর ডলারের বিপরীতে রুবলের মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা থেকেই বুঝা যাচ্ছে ডলারের একাধিপত্যের যুগ অস্তমিত হতে চলেছে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার পর রাশান অলিগার্করা এখন দুবাইয়ে সেইফ হ্যাভেন পাচ্ছে। এর মানে দাড়াচ্ছে, বিশ্বঅর্থনীতিতে একটি ইউরেশিয়া কেন্দ্রীক মেরুকরণ ঘটতে চলেছে। চীনের রোড অ্যান্ড বেল্ট ইনিশিয়েটিভের আওতায় ইএইউ বা ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়ন একটি বিকল্প আন্তর্জাতিক মূদ্রাব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রস্তাব নিয়ে কাজ শুরু করেছে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় একাধিপত্য উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মাল্টিকালচারালিজমের সাথে সঙ্গতিহীন। পশ্চিমা নিয়ন্ত্রণাধীন সুইফ্ট কোডের বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে মাল্টিপোলার বিশ্বের সম্ভাবনাকে সফল করে তুলতে হবে। ইউক্রেন যুদ্ধের ফলাফল যাই হোক, ডলার ও সুইফ্ট কোডের বিপরীতে স্বচ্ছ ও সুনিয়ন্ত্রিত আন্তজার্তিক একটি অর্থব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ সভ্যতার সংকট কাটিয়ে বিশ্বে মানবিক মর্যাদা পুন:প্রতিষ্ঠার নতুন সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তুলেছে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।