পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ফল খাওয়ার উপকারিতার কথা সকলেরই জানা। ছোট শিশু থেকে কিশোর-তরুণ, প্রাপ্তবয়স্ক এমনকি বৃদ্ধদেরও নিয়মিতভাবে ফল খাওয়া উচিৎ এবং প্রতিদিন কিছু পরিমাণে হলেও ফল খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা উচিৎ। ডাক্তারী বিদ্যায় বলা হয়, ফল শুধু স্বাদের জিনিস নয়, এর দরকার শরীরে মিনারেল আর ভিটামিনের চাহিদা জোগান দিতে। সেটা বেশি দেশি ফলে। প্রচুর পরিমানে ভিটামিন সি এবং বি কমপ্লেক্স রয়েছে বাংলাদেশের মৌসুমী ফলে। বলা হয়ে থাকে, বিদেশি ফলে ফরমালিন বা কেমিকেল মেশানো থাকে। এই ভরসায় দেশি ফলের প্রতি অনেকের আকর্ষণ এবং দুর্বলতা রয়েছে। তবে এক্ষেত্রেও রয়েছে দুঃসংবাদ। দেশি ফলেও ফরমালিন মেশানোর ঘটনা ধরা পড়ছে বিভিন্ন জায়গায়। দেশি ফলের মধ্যে প্রায় সব ফলেই ফরমালিন মেশানো হয়। ইথোফেন নামের বিষাক্ত হরমোনাল ¯েপ্র দিয়ে কাঁচা ফল পাকানো হয়। আবার পচা ফল তাজা রাখতেও কেমিক্যাল রয়েছে। সাধারণত কৃষিজমিতে ব্যবহার হলেও রমজানকে সামনে রেখে কাঁচা ফল পাকাতে এই ¯েপ্র ব্যবহার করা হচ্ছে। এটি ফরমালিনের চেয়েও ভয়ানক বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তমুজের ভেতর সিরিঞ্জ দিয়ে ক্ষতিকর এরিথ্রোসিন বি এবং স্যাকারিন পুশ করে লাল ও মিষ্টি করার ঘটনা ধরা পড়েছে। বাদ যাচ্ছে না আমি, কলা, পেঁপে, পেয়ারা, আনারসও। জাতীয় ফল কাঁঠালও এর বাইরে নয়। এক সময় লোহার রড ঢুকিয়ে কাঁঠাল পাকানোর কথা শোনা যেত। এতে কাঁঠাল দ্রুত পাকে। এখন রডের সঙ্গে বিষও দেয়া হয়। কেমিক্যাল মেশানোর তালিকায় এগিয়ে রয়েছে কলা। সময়ের আগে কলায় বিশেষ করে সবরি কলায় হরমোন ¯েপ্র করা হয়। অপরিণত কলা কেরোসিনের স্টোভের হিট দিয়ে নরম করা হয়। রাইপেন-ইথোফেন বা কার্বাইড ¯েপ্র করে পাকানো হয়। ¯েপ্র করার আগে কলা পরিষ্কার করা হয় সার্ফএক্সেল বা শ্যা¤পু দিয়ে। পাকানোর এই বিষাক্ত পদ্ধতি রাজধানীর বাদামতলি থেকে কারওয়ানবাজার এবং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কলার আড়তে চলছে হরদম। সেই বিষাক্ত কলা বাজার থেকে কিনে খায় মানুষ। মৌসুমী আরেক দেশি ফল লিচুতেও পাঁচ থেকে ছয়বার কীটনাশক ¯েপ্র করা হয়। ঝরে না পড়া, বোটা শক্ত রাখা, রঙ চকচকে করাসহ সব কিছুর জন্য বিষ দেওয়া হয়। এখন আবার আমড়া-জাম্বুরায়ও কেমিক্যাল মেশানো হচ্ছে। এছাড়া অপরিপক্ব কোনো কোনো ফল পাকাতে ইথোফেনের বাইরে ক্যালসিয়াম কার্বাইডও মেশানো হয়। রং উজ্জ্বল করতে এটি মূলত টেক্সটাইল শিল্পে ব্যবহৃত হয়। গ্যাস জাতীয় ইথাইলিন ও হরমোন জাতীয় ইথরিল অতিমাত্রায় স্প্রে করে এবং ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার করার কারণে ফলগুলো ঔজ্জ্বল্যের সঙ্গে রীতিমতো বিষে পরিণত হয়। এসব ফল খাওয়ার কারণে মানবদেহে ছড়িয়ে পড়ে বিষাক্ত কেমিক্যাল। এর ফলে শরীরে বাসা বাধে নানা অসুখ-বিসুখ। একেবারে সাধারণ চাষী থেকে ছোট-বড় সকল ব্যবসায়ীই সবাই যার যার জায়গায় ফলে বিষ মেশানোর অনৈতিকতার মাধ্যমে মানুষকে রোগী বানানোর কাজটি করছে। লিচু বা আম বাগানগুলো মুকুল আসার আগে-পরে বড় ব্যবসায়ী, সুপার শপগুলো কিনে নেয়। বিষ মেশানোর অপকর্ম তারাও করে। কারও বিবেক স্বাভাবিকভাবে কাজ করে না। মুনাফাই যেন তাদের কাছে শেষ কথা, মানুষের জীবন নয়।
আমদানি করা ফলে ফরমালিন পরীক্ষা করতে ঢাকার বিএসটিআইয়ের অফিসে পাঠালে সময় লেগে যায় মাসখানেক। তদ্দিনে ওইসব ফল পচে যায়। সেইক্ষেত্রে বন্দরে তাৎক্ষণিক ফরমালিন পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখা জরুরি। দেশি ফলের ক্ষেত্রে সেই জটিলতা নেই মনে করা হয়। কিন্তু, বাস্তবতা ভিন্ন। বাংলাদেশ থেকে কিছু রপ্তানি করতে হলে কঠোর মান রক্ষা করতে হয়। দেশীয় লেবু, কাগজি, জাম্বুরা, টমেটো জাতীয় ফল রপ্তানির সময় এনওসি নিতে হয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংঘনিরোধ কেন্দ্র থেকে। সেখানকার কর্মকর্তাদের সামনে এক ধরনের রাসায়নিক দিয়ে ওই ফলগুলো ধুতে হয়। পরে তারা ফাইটোস্যানিটারি সনদ দেন, যেটা ইউরোপের দেশগুলো গ্রহণ করে। আমাদের দেশ থেকে ফল ও সবজি রপ্তানি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফলগুলো ধোয়া হয় ফলের গায়ে লেগে থাকা নানা আবরণ ওঠানোর জন্য। এক সময় বাংলাদেশ থেকে এ ধরনের ফল রপ্তানি হলেই তারা নষ্ট করে ফেলত। পরে তাদের কাছে পরামর্শ চাওয়া হয়। তাদের প্রতিনিধিদল তিন-চারবার বাংলাদেশ সফরের পর ওই রাসায়নিক দিয়ে ধোয়ার পরামর্শ দেয়। তা-ও সাময়িকভাবে। বছর কয়েক ধরে বাংলাদেশ থেকে ফল রপ্তানির ক্ষেত্রে রপ্তানিকারকরা সরাসরি বাগান থেকে ফল কেনেন। তারা কোনো রাসায়নিক ব্যবহারের চিন্তাও করে না। কারণ ইউরোপ বা মধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানি হওয়া ফলের ৯৫ শতাংশের ক্রেতা অনাবাসী বাংলাদেশিরা। বিএসটিআই বা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ফলসহ ফরমালিন মেশানো খাদ্যবস্তু শনাক্ত করেছে। কিন্তু মানুষ নিশ্চিন্তে ফল কিনতে পারবে বা কেমিক্যালমুক্ত ফল চেনার কৌশল বাতলে দিতে পারেনি। তবে কেমিক্যাল মিশ্রিত বা ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে উপসর্গগুলো স¤পর্কে নিয়মিত বলছেন আমাদের চিকিৎসকরা। লক্ষণ হিসেবে রয়েছে পেটে ব্যথাসহ বমি হওয়া, মাথা ঘোরা, হজমবিঘ্নিত হওয়া, শরীরে ঘাম বেশি হওয়া এবং দুর্বল হয়ে যাওয়া, পালস্ রেট কমে বা বেড়ে যেতে পারে। এক গবেষণায় বলা হয়েছে, শুধু ভেজাল খাদ্যের কারণে দেশে প্রতিবছর প্রায় ৩ লাখ লোক ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে। ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ৫০ হাজার, কিডনি রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ২ লাখ। এ ছাড়া গর্ভবতীদের শারীরিক জটিলতাসহ গর্ভজাত বিকলাঙ্গ শিশুর সংখ্যা দেশে প্রায় ১৫ লাখ।
হাইর্কোটের একটি বেঞ্চ বছর কয়েক আগে ফল পাকানো ও সংরক্ষণে কেমিক্যালের ব্যবহার অবৈধ ঘোষণা এবং ফলমূলে কেমিক্যাল ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করতে পুলিশকে নির্দেশ দেন। দূষিত ফল যেন কেউ গুদামজাত ও বিক্রি করতে না পারেন তা সর্বদা মনিটর করার জন্য বিএসটিআই ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেন। এ ছাড়া আদালত দেশের স্থল ও নৌবন্দরে আমদানি করা ফল কেমিক্যাল মেশানো কিনা তা পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে নির্দেশ দেন। কিন্তু, সেই নির্দেশ যথাযথভাবে পালন হচ্ছে না।
সমাজের সর্বস্তরে এমন অবক্ষয়-অনৈতিকতার এই মাত্রায় আর কোনো দেশে আছে কিনা আমার জানা নাই। তবে ভারত, পাকিস্থান, শ্রীলংকা, নেপাল, ভুটানে নেই তা বলতে পারি। মিয়ানমারের অবস্থাও এমন নয়। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান কোনো দেশের মানুষ খাদ্যে ভেজাল বা বিষ মেশানোর কথা চিন্তাও করতে পারে না। ইউরোপ, উত্তর আমেরিকায় ফল বা খাবারে ভেজাল বা বিষের কথা কল্পনাও করা যায় না। ল্যাটিন আমেরিকার মেক্সিকো ও ব্রাজিলের সমাজেও এমন নেই। তাই সার্বিক বিবেচনায় বলা যায়, রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের মানুষের পচনটা ধরেছে মাথায়। এর আগে নষ্ট হচ্ছে শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। বিভিন্ন ধরনের মুখরোচক খাবার ও ফলমূল আকর্ষণীয় করে ও দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করার জন্য যে ক্ষতিকর কার্বাইড, ইন্ডাস্ট্রিয়াল রং, ফরমালিন, প্যারাথিয়ন ব্যবহার করা হয়, এগুলো গ্রহণের ফলে কিডনি, লিভার ফাংশন, অ্যাজমাসহ বিভিন্ন প্রকার জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। সুতরাং পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য চাই কঠোর আইনের প্রয়োগ। বিদেশ থেকে রাসয়নিক দ্রব্য আমদানি, সংরক্ষণ, মজুদকরণ, বিতরণ, ব্যবহার ও উম্মুক্ত বিক্রির ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। জনগণকে বিষমুক্ত ভেজাল ফল ক্রয় ও খাওয়া থেকে বিরত থাকতে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। এ ব্যাপারে সংবাদপত্র এবং বিভিন্ন গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক/কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।