Inqilab Logo

রোববার, ১৯ মে ২০২৪, ০৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১০ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

স্বাধীনতা, কৃষক কতটুকু পেল?

কৃষিবিদ মো. বশিরুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ২৬ মার্চ, ২০২২, ১২:০৫ এএম

সংবিধানের ১৪নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের অন্যতম মূল দায়িত্ব হল, মেহনতি মানুষ, কৃষক ও শ্রমিকের এবং জনগণের মধ্যে পিছিয়ে পড়া অন্য গোষ্ঠিগুলোকে সব ধরণের শোষণ থেকে মুক্তি দেয়া।’ অর্থাৎ সংবিধানে কৃষকদের অধিকার এবং সব ধরণের শোষণ থেকে মুক্তির ব্যাপারে দৃঢ়সংকল্প ব্যক্ত করা হয়েছে। জনগণের সঙ্গে রাষ্ট্রের চুক্তিনামা হচ্ছে সংবিধান। কিন্তু সব ধরনের শোষণ থেকে যাদের ‘মুক্তি’ প্রদানের জন্য সংবিধান প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তারা স্বাধীনতার একান্ন বছরেও শোষণমুক্ত হয়েছে কি?

চলতি মৌসুমে আলুর বাম্পার ফলন হলেও ন্যায্যমূল্য না পেয়ে দুঃশ্চিন্তায় ছিল কৃষক। এছাড়া প্রতি বছর পত্রপত্রিকায় আমন এবং বোরো মৌসুমের শেষে ধানের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার খবর পাওয়া যায়। শুধু কি ধান, আলু, পেঁয়াজ? একই চিত্র সবজি থেকে শুরু করে কৃষির বিভিন্ন পণ্য বিক্রিতে। আসলে, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়লেও প্রান্তিক কৃষকের কোনও লাভ হয় না। তারা যে তিমিরে ছিল সেখানেই থেকে যায়।

মনে আছে, ধানের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার পাইকড়া গ্রামের কৃষক আব্দুল মালেক সিকদার পাকা ধান ক্ষেতে আগুন দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। দুধের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার অভিযোগ তুলে রাস্তায় দুধ ঢেলে প্রতীকী প্রতিবাদ করেছিল বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের কর্মীরা। টমেটো বা আলুর দাম না পেয়ে কৃষকের তা রাস্তায় ফেলে প্রতিবাদ করতে দেখা যায়। অন্যদিকে ক্রেতাসাধারণ বাজারের দিকে তাকালেই চোখে সর্ষে ফুল দেখে। অনেক সময় দেখা যায়, যে পণ্য কৃষক বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে ১০ টাকা, একইপণ্য ক্রেতারা ৩০ টাকায়ও কিনতে পাচ্ছে না। অথচ, ফসল উৎপাদন ভালো হলে সরকার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার ঘোষণা দেয়, কৃতিত্ব নেয় কৃষি মন্ত্রণালয়। দেখা যায়, বাম্পার ফসলের সময় কৃষক তার ফসলের দাম এতো কম পায় যে তার উৎপাদন খরচটুকুও ওঠে না।

সম্প্রতি গিয়েছিলাম রংপুরের সদর উপজেলার বুড়িরহাট এলাকার। চারিদিকে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ জুড়ে আলুর ক্ষেত। গত বছর ভালো দাম পাওয়ায় এবার কৃষকরা দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে আলু চাষ শুরু করেন। আলু ক্ষেতগুলোতে ঘুরে ফিরে দেখলাম খণ্ড খণ্ড জমিতে কৃষক আলু পরিচর্যা ব্যস্ত সময় পার করছে। আবার কেউ আগাম আলু বিক্রি করছে। দেখতে পেলাম, যারা আগাম আলু বিক্রি করছে তারা খুবই চিন্তিত। কারণ, আলুর বর্তমান বাজারদরে লাভ তো দূরের কথা খরচও তুলতে পারছে না। ফলে হতাশা কাজ করছে তাদের মধ্যে। কৃষক সাদেকুল আর আমিনুল ইসলাম সাথে কথা হয় আমার। তারা দুই ভাই ৬ বিঘা জমিতে আগাম আলু চাষ করেছিল, ফলনও ভালো। কিন্তু চাহিদার তুলনায় আলুর ফলন বেশি হওয়ায় আলু বিক্রি হচ্ছে না।

প্রতি কেজি আলু চাষ করে তাদের খরচ পড়েছে ৭ থেকে ৮ টাকা। সেই আলু ৫ থেকে ৬ টাকার বেশি দামে বিক্রি করতে পারছে না। কৃষকরা আরও জানালো, প্রতিবছর আলু খেতেই বিভিন্ন জায়গা থেকে পাইকাররা এসে আলু কিনে নিয়ে যেতো, আগাম টাকাও তারা দিয়ে যেত। এবার দাম কমে যাওয়ায় চাহিদা নেই বললেই চলে। তারা আরও জানাল এনজিও থেকে সুদে টাকা নিয়ে আলু চাষ করে এখন টাকা দেয়াই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একই কথা জানাল মহিপুরে আলু চাষি হারুন মিয়া, সাহেব আলীসহ অনেকে।

অন্যদিকে রংপুরের অন্যতম সবজির পাইকারি বাজার পালিচড়া হাটে গিয়ে দেখা গেল পাইকারি আলু বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা মণ দরে। কেজি ১০ থেকে ১২ টাকা দরে। তারা জানায়, আলু ক্ষেত থেকে কেনার পর পরিবহন খরচসহ অন্য খরচ মিলে কেজি প্রতি দুই টাকা বেশি পড়ে যায়। ফলে তাদের একটু বেশি দামে বিক্রি না করলে লাভ হয় না।

বঙ্গবন্ধুর ভাষায় ‘কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে’। আর এ দেশের কৃষক কিনা এক কেজি আলু বিক্রি করেও এক কাপ চায়ের দাম পাবে না, এটা কি ভাবা যায়? মনে রাখতে হবে, এ কৃষকদের কল্যাণে আমরা এখন আর খাদ্য ঘাটতির দেশের বাসিন্দা তো নই-ই, বরং তাদের শ্রম ও ঘামেই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ।

সব কিছুর পরও যে কৃষির প্রাণ কৃষকরাই তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের কোনো পরিসংখ্যান নেই। ১৯৭০ সালে কৃষিজমিতে বছরে একটি ফসল হতো। তারাই এ জমি তিন ফসলি করেছে। কোথাও কোথাও একটি জমিতে বছরে চারটি ফসল ফলিয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়েছে কৃষকরা। বন্যা, খরাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগেও সোনার ফসল ফলিয়েছে তারা। করোনাকালীন দুর্যোগেও বাংলাদেশের কৃষি মাথা উচুঁ করে রেখেছে। এমনকি দাম না পাওয়াসহ অন্যান্য বিপর্যয়ও দমাতে পারেনি কৃষকদের।

তাইতো কৃষক, কৃষিবিজ্ঞানী আর সম্প্রসারণ কর্মীদের নিরলস পরিশ্রমের ফলে দেশ আজ বিশ্বে চাল ও সবজি উৎপাদনে তৃতীয়। মাছ, চা এবং ছাগলের মাংস উৎপাদনে চতুর্থ। পাট উৎপাদনে দ্বিতীয় এবং পাট রপ্তানিতে প্রথম। কাঁঠাল উৎপাদনে দ্বিতীয়। অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত পানির মাছ উৎপাদনে তৃতীয় এবং বদ্ধ জলাশয়ের মাছ উৎপাদনে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে। ছাগলের দুধ উৎপাদনে দ্বিতীয়। ইলিশ উৎপাদনে প্রথম, আর বর্তমানে বিশ্বের মোট ইলিশের ৮৬ শতাংশই উৎপাদিত হচ্ছে এই দেশে। মাত্র চার বছর আগেও এই উৎপাদনের হার ছিল ৬৫ শতাংশ। আম উৎপাদনে সপ্তম ও আলু আর পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম বলে বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়। বন্যা, লবণাক্ততা, খরা ও দুর্যোগসহিষ্ণু শস্যের জাত উদ্ভাবনেও শীর্ষ তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান। ফলে দেশ থেকে মঙ্গা, দুর্ভিক্ষ আর ক্ষুধার অপবাদ মুছে গেছে।

প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে আলু রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে। মাছ রপ্তানিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর বাইরে চা, শাকসবজি ও ফলমূলও রপ্তানি হচ্ছে। তাই নিজেদের চাহিদা মেটানোর পর বাংলাদেশের দৃষ্টি আজ বিশ্ববাজার দখলের। আর সেজন্য নজর দেয়া হচ্ছে কৃষিপণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় শিল্পায়িত ও বাণিজ্যিক কৃষি খাত গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার, যা বাস্তবায়ন হলে এ খাতের রপ্তানি আরও বাড়বে। তবে , যে কৃষকের হাত দিয়ে এই খাতে এত উন্নয়ন, সেই কৃষক পাচ্ছে না ন্যায্য টাকা। শিকার হচ্ছে সীমাহীন বৈষম্যের। এ পরিস্থিতি প্রতিবারই হলে ফসল ফলানোর ধারাবাহিকতা সুরক্ষা পাবে কী করে? আসলে কৃষির শক্তি হলে কৃষক। কৃষক তার মেধা ও শ্রম দিয়ে উৎপাদন করে দেশের সামগ্রিক গতিশীলতা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই কৃষকের অধিকার খর্ব হলে তার চেয়ে পরিতাপের আর কিছু হতে পারে না। কৃষকের কষ্টের যথাযথ মূল্যায়ন ছাড়া কৃষিতে উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়। এর জন্য সরকারের অধিক তদারকির পাশাপাশি কৃষি মন্ত্রণালয়কে আইনের সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। সরকারিভাবে সরাসরি কৃষকদের থেকে ফসল ক্রয় করার সুযোগ সৃষ্টিসহ মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

লেখক: উপ-পরিচালক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: স্বাধীনতা


আরও
আরও পড়ুন