Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মৃত্যুর মুখে ময়মনসিংহ অঞ্চলের নদ-নদী

খননেও মিলছে না সুফল তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের খনন কাজে চলছে লুটপাট নরসুন্দা ও রাজবাড়ী নদীকে ইতোমধ্যে মৃত ঘোষণা

মো: শামসুল আলম খান | প্রকাশের সময় : ১৬ মার্চ, ২০২২, ১২:১০ এএম

মরণ বাঁধ ফারাক্কা এবং অন্যান্য অভিন্ন নদীতে বাঁধ দিয়ে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে এদেশের নদ-নদীর আজ মরণ দশা। সারাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো বৃহত্তর ময়মনসিংহের প্রায় অর্ধ শতাধিক নদ-নদী এখন মৃত প্রায়। এ অঞ্চলের বড় নদ ব্রহ্মপুত্রে নেই স্রোতধারা, নেই কোন প্রবাহ। খরস্রোতা এই নদ এখন যেন জীর্ণশীর্ণ মরা খাল। ঐতিহাসিক এই ব্রহ্মপুত্রে নদের বুকে ধূ ধূ বালুচর। নদীর বুকে কোথাও কোথাও হচ্ছে ফসলের আবাদ। নদ-নদী শুকিয়ে যাওয়ার কারণে জীবিকা হারিয়ে পথে বসেছে লাখো পরিবার। জীববৈচিত্রেও পড়েছে বিরূপ প্রভাব। মৎস্য সম্পদও ধ্বংসের প্রান্তসীমায়। হারিয়ে যাচ্ছে অনেক প্রজাতির মিঠা পানির মাছ। অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে এক সময়ের যোগাযোগের চালিকাশক্তি নৌপথ। বিলুপ্ত হয়ে গেছে জেলে পল্লীগুলো। ব্রহ্মপুত্র নদের নাব্যতা ফেরাতে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে যে খনন কাজ শুরু হয়েছে তাতে অনিয়ম তার লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে।

ব্রহ্মপুত্রের পাশাপাশি এ অঞ্চলের প্রায় অর্ধশত নদ-নদী এখন মৃত্যুর মুখে। এর মধ্যে নরসুন্দা ও রাজবাড়ী’কে ইতোমধ্যে মৃত নদী হিসেবে চিহ্নিত করেছে স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড। মৃত নদ-নদীর এ তালিকা ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে। বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের নদ-নদীর মধ্যে- ঝিনাই, আইমন, সুতিয়া, পুরাতন ব্রক্ষপুত্র, ঘরোটা নদী, সিমাহালি, নরসুন্দর, বোথাই, নিতারী, সোমেশ্বরী, কংশ, গুনাই, কাঁচামাটিয়া, পানকুরা, সাইদুল, মগড়া, রাংরা, খারমরি, মাহাডেবা, জাদুকাটা, ধানু, বাউলাই, শিরখালি, চেলাখালি, মতিচিক, চালহি, বংশাই, মানস, পুটিয়া, জিনজিরাম, সুবনফিরি, বলেশ্বর, বগাই কংশ, কাউলাই, ধনু, সিলাই, রাজবাড়ী ও খারমেনি এসব নদীও এখন প্রবাহহীন ক্ষীণ জলধারা নিয়ে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে।

ব্রহ্মপুত্র নদের নাব্যতা ফেরাতে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে খনন কাজ চলছে। ২০১৯ সালের শেষ দিকে শুরু হওয়া কাজে ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নদের ২২৭ কিলোমিটার খনন করছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডবিøওটিএ)। যমুনা-ব্রহ্মপুত্রের সংযোগস্থল জামালপুরের কুলকান্দি থেকে কিশোরগঞ্জের টোক পর্যন্ত নদটি আগামী ২০২৪ সালের জুনে খনন কাজ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু একদিকে খনন হলেও অন্যদিকে নদের মাঝে জেগে উঠছে চর। খননের পরও কেনো নদে চর জাগছে তা এখন ময়মনসিংহবাসীর কাছে প্রশ্নের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, নদের চর জাগার কারণ শনাক্ত না করেই অপরিকল্পিত ভাবে নদ খনন হচ্ছে। এতে সরকারি অর্থের অপচয়ই নয়, সুফল বঞ্চিত হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র। এমন অভিযোগে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ব্রক্ষপুত্র নদ খননে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বরাদ্দ লুটপাটের অভিযোগে মানববন্ধন করেছে জেলা আওয়ামীলীগ-জাসদ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এ সময় তারা নদ খননের সকল ধরনের তথ্য জনসম্মুখে প্রকাশ করার দাবি জানান।

মানববন্ধনে ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বরাদ্দের টাকা দিয়ে কাজ না করে বিল উঠিয়ে নিয়ে যাবেন, তা হতে পারে না। অবিলম্বে নদ খননের সকল ধরনের তথ্য জনসম্মুখে প্রকাশ করা হোক।
জেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শওকত জাহান মুকুল বলেন, নদ খননের ২৭ শত কোটি টাকার প্রকল্প আমলা-ঠিকাদার যোগসাজস করে লুটপাট করছে। এই অনিয়ম অবিলমে¦ বন্ধ না হলে আমরা বৃহত্তর আন্দোলনে যেতে বাধ্য হব।

নদের তীরবর্তী বাসিন্দারা জানায়, নদ শুকিয়ে যাওয়ার কারণে নদ কেন্দ্রিক জীবিকা হারিয়ে পথে বসেছেন প্রায় লাখো পরিবার। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র হুমকির মুখে পড়েছে। মৎস্য সম্পদও ধ্বংসের পথে। এ অঞ্চলের নৌ-পথ অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অথচ এক সময়ে নৌ-পথের যোগাযোগ ছিল সবচেয়ে ভাল এবং সুলভ। আজ তা হারিয়ে গেছে। বিলুপ্ত হয়ে গেছে জেলে পল্লীগুলো। নদীতে পানি না থাকায় এখন আর মাছ পাওয়া যায় না। এতে জেলেরা তাদের পেশা ছেড়ে অনেক কাজের সন্ধানে গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে গেছে।

ব্রহ্মপুত্র মরা গাঙে রূপ নেয়ায় এ অঞ্চলের কৃষি খাতের বেহাল দশা। দিন দিন বিশাল বিস্তৃত মরুপ্রান্তর হয়ে উঠছে এক একটি নদ-নদী। অথচ এক সময় এসব নদ-নদীই ছিল মাছের অভয়ারণ্য। পণ্য পরিবহন ও মানুষের যোগাযোগের সুবিধার কারণে নদীপাড়ে গড়ে উঠেছিল ছোট-বড় হাট-বাজার, বন্দর, নগর ও গঞ্জ। নদীর মৃতুর সাথে সাথে এসবই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।

পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের গড়ে প্রশস্থ ছিল প্রায় ১১ কিলোমিটার। বর্তমানে এর প্রশস্থতা কমে এখন ১২০ মিটার থেকে ২২০ মিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। খনন না করায় নদের বুকে পলি ও বালু জমে অসংখ্য চর জেগে উঠেছে। এর মধ্যে গত ৩৩ বছরে নতুন চর জেগেছে ৭২০ বর্গকিলোমিটার। একই সঙ্গে খরস্রোতা ব্রহ্মপুত্র নদের নাব্য হ্রাস পাওয়ায় তলদেশ ভরাট হয়ে উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৬ মিটার অর্থাৎ ২২ ফুট। ফলে নদে শুষ্ক মৌসুমে নদের দুই পাড়ের ফসলি জমিতে প্রতি বছর ভয়াবহ সেচ সংকট দেখা দেয়।

কয়েক বছর আগেও বৃহত্তর ময়মনসিংহে নদ-নদী তীরবর্তী হাজার হাজার একর জমির আবাদ হতো এসব নদ-নদীর পানি দিয়ে। জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, গাইবান্ধায়ও হাজার হাজার একর জমির আবাদ ছিল ব্রহ্মপুত্রের পানিনির্ভর। উর্বর পলি মাটিতে বাম্পার ফলন হতো। সে অবস্থা আজ আর নেই। ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র এখন হেঁটেই পার হওয়া যায়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নদ-নদী

২৯ এপ্রিল, ২০১৬
৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ