Inqilab Logo

বুধবার ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ফারাক্কার প্রভাবে পানিশূন্য হয়ে পড়ছে ৫৪ নদ-নদী

প্রকাশের সময় : ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুরশাদ সুবহানী, পাবনা থেকে  : শুষ্ক মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই পদ্মা নদীর বুকে পানির টান শুরু হয়েছে। শুষ্ক হয়ে উঠেছে নদীর বুক। বিশাল নদীজুড়ে ছোট-বড় অসংখ্য চর জেগে উঠেছে। পদ্মা নদী বলতে এখন যা নজরে পড়ে সেটা ব্রিটিশ রাজত্বের সময়ের সেই নদী বলে মনে হয় না। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারতের ফারাক্কা ব্যারেজ চালু হলে ঘুরে যায় পদ্মার পানি। ভাগরথি নদীর মাধ্যমে অভিন্ন গঙ্গার পানি ঘুরিয়ে নেয়া হলে এই নদীর মূল স্রোতধারার পদ্মানদীতে পানির প্রবাহ কমতে শুরু করে। আর নদী শুকিয়ে সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। এই বাস্তবতা উপলব্ধি করে পদ্মা নদী বাঁচাতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী দেবগৌড়ার সাথে ৩০ সালা মেয়াদি পানি চুক্তি করেন। কিন্তু তাতে কোন সুফল পাওয়া যাচ্ছে না দীর্ঘ ২০ বছরে ধরে। চুক্তি অনুসারে জানুয়ারী-মে মাস এই সময়ে প্রতি মাসে ৩ সাইকেলে (১০ দিন পরপর) বাংলাদেশ গঙ্গার পানি নায্যতা পাবে। ফারাক্কা পয়েন্টে পানিপ্রবাহের অর্ধেক পদ্মা নদীতে আসবে। আর শুষ্ক মৌসুমের পিক সময়ে এপ্রিল-মে মাসে ফারাক্কা পয়েন্টে পানির প্রবাহ যতটুকু থাক না কেন, পদ্মা নদীর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানির প্রবাহ ৩৪ হাজার কিউসেকের নিচে নামবে না। বাস্তব চিত্র এর উল্টা। জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী মাসেও পানি প্রবাহ নজরে পড়ে না। শুষ্ক মৌসুমের পিক সময়ে নদী একেবারেই পানিশূন্য হয়ে পড়ার উপক্রম হয়। পদ্মা নদীর পানিপ্রবাহে টান পড়লে এর প্রধান শাখা নদী গড়াই, আত্রাইসহ শাখা-প্রশাখা নদী মিলিয়ে প্রায় ৫৪টি নদীতে পানিশূন্য হয়ে পড়ে। নদীতে পানির প্রবাহ না থাকায় সেচের অভাবে শুধু কৃষি ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়ে তা নয়, এই প্রভাব বিস্তৃত হয়। আবহাওয়ার বৈরি আচরণ, মরুকরণের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। মাছের অভাবে মৎস্যজীবীরা হাহাকার করে। মাঝি-মাল্লার কোন কাজ থাকে না। সামগ্রীক বিরূপ প্রভাব দেশব্যাপী শুরু হয়। পদ্মা নদীতে পানি স্বল্পতার কারণে উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে মরুকরণ অবস্থা স্থায়ী রূপ নিতে যাচ্ছে। ফাল্গুন চৈত্র-বৈশাখ মাসের মত গরম অনুভূত হচ্ছে। গভীর রাতে শীতকালের মত আবহাওয়া অনুভব করছেন মানুষজন। যা মরু আবহাওয়ার লক্ষণ বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। জীব-বৈচিত্র্য হুমকীর মুখে পতিত হয়েছে অনেক আগেই।  আন্তর্জাতিক নদী পদ্মা (গঙ্গা) উজানে ভারত ফারাক্কা ব্যারেজ দিয়ে ভাগিরথী নদীর মাধ্যমে পানিপ্রবাহ ঘুরিয়ে নেয়ায় ভাটির দেশ বাংলাদেশ ক্রমেই তীব্র পানি সংকটে নিপতিত হচ্ছে। কালক্রমে প্রমত্তা পদ্মা নদীর সাথে প্রধান শাখা নদী আত্রাই, গড়াইসহ ৫৪টি নদ-নদীতে পানির টান পড়তে শুরু করে। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর কমতে শুরু করেছে। ফলে নদী ও ভূ-গর্ভের পানি দিয়ে সেচকার্য ব্যহত হয়ে পড়েছে। চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর পদ্মা নদীর বুকে চুক্তি মাফিক পানি আসেনি। এখনও পানি পাওয়া যায় না। যদিও হাইড্রোলজি (বর্তমান নাম ভূ-পরিস্থ পানি জরিপ দপ্তর যা উন্নয়ন বোর্ডের আওতাধীন) পাবনার অফিস চুক্তি পর থেকে পানিপ্রবাহের কোন তথ্য সাংবাদিকদের আর দেন না। জিজ্ঞেস করলে বলা হয় যৌথ নদী কমিশন দিতে পারবে। শুষ্ক মৌসুমের শুরুতে জানুয়ারী মাসে ভারত থেকে একটি প্রতিনিধি দল হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে আসেন। নদীর এখানে ওখানে পানির প্রবাহ ও গভীরত্ব মাপজোক করেন। তাদের প্রাপ্ত ফলাফল এ যাবৎ কাল স্থানীয়ভাবে প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে জানানোর কোন উদ্যোগ নেয়া হয় না। এবারও একই অবস্থা।
পাবনার চাটমোহর উপজেলার কাছিকাটা এলাকার আত্রাই নদীর উজানে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহার, নদী অভিমুখে ১৬টি নদী ও ৩২টি খাল বিলের অস্তিত্ববিলীন হওয়ার হওয়ার পথে। একদা এই সব নদ-নদীতে ও খাল-বিলে পানিতে থৈ থৈ করত, মাঝি’র নৌকা চলতো, মৎস্যজীবীদের মাছ ধরার দৃশ্য দেখা যেত বছরজুড়েই। এখন তা কল্পনামাত্র। বর্ষা মৌসুমে এবং মৌসুম শেষে পানি কমার সময় মাছ কিছু পাওয়া গেলেও তা আর আগের মত নেই। ভাঙ্গুড়া উপজেলার বড়াল ব্রিজের উজানে দিলপাশা এলাকায় ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে কলকাতায় মাছ নেয়ার জন্য ‘দিলপাশা’ নামে রেলওয়ে স্টেশন স্থাপন করা হয়। পাবনার ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া ও বৃহত্তর পাবনা জেলার চলনবিল অঞ্চল থেকে আহরিত মাছ মালবাহী ট্রেনে করে কলকাতায় যেত। এই দৃশ্য এখন আর নেই। স্থানীয়ভাবেই মাছের চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। পুকুর জলাশয়ে হাইব্রিড পদ্ধতিতে মাছ চাষ করে চাহিদার যোগান দেয়া হচ্ছে। এই মাছ মুক্ত নদী ও বিলের মাছের মত স্বাদ হয় না। চলনবিলাঞ্চলের মধ্যে বড়াল, গুমানী, আত্রাই, গুড় নদী, করতোয়া, তুলশি, চেচুয়া, ভাদাই, চিকনাই, বানগঙ্গা ও খুবজীপুর, তেলকুপি নদী রয়েছে। ৩২টি খালের মধ্যে নবীর হাজরা জোলা, হক সাহেবের খাল, নিমাইচরা বেশানী খাল, বেশানী গুমানী খাল, উলিপুর, সাঙ্গুয়া খাল, দোবিলা, কিশোরকলি খাল, বেহুলারখাড়া, বাঁকাইখাড়া, গোহালানদী, গাড়াবাড়ি দারুখালী খাল, বিলসূর‌্য নদী, কুমারডাঙ্গা নদী, জানিগাছার জোলা। পাবনার অদূরে মরাপদ্মা। পদ্মা নদীর একটি শাখা। এই নদীও শুকিয়ে যাচ্ছে। এপ্রিল-মে মাসে এই নদীর শুষ্কতা আরও ভয়বাহরূপ নেবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ফারাক্কার প্রভাবে পানিশূন্য হয়ে পড়ছে ৫৪ নদ-নদী
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ