Inqilab Logo

শুক্রবার, ০৫ জুলাই ২০২৪, ২১ আষাঢ় ১৪৩১, ২৮ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

একাত্তরে যেভাবে বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল রাশিয়া

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১৪ মার্চ, ২০২২, ১২:০৩ এএম

উনিশশো একাত্তর সালে বাংলাদেশের মানুষ যখন স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছিল, তখন পৃথিবীর বৃহৎ দেশগুলো এর পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। আমেরিকা এবং রাশিয়ার (তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন) মধ্যে শীতল যুদ্ধ তখন একেবারে তুঙ্গে। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের উপর।

তখন আমেরিকা এবং চীন পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল। অন্যদিকে বাংলাদেশের পক্ষে ভারত যখন আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে তোলা এবং সামরিক সহায়তা নিয়ে এগিয়ে এসেছিল, তখন ভারতকে সমর্থন দিয়েছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন, যার সবচেয়ে বৃহৎ ও প্রভাবশালী অংশ এখনকার রাশিয়া। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের অন্যতম উপদেষ্টা জি ডবিøউ চৌধুরী লিখেছেন, ভারতের পক্ষে সুপার পাওয়ার সোভিয়েত ইউনিয়ন সবদিক থেকে সহায়তা করেছিল। অন্যদিকে পাকিস্তানের পক্ষে আমেরিকা এবং চীন শুধু নৈতিক সমর্থন দিয়েছিল। এই দুই দেশের কাছ থেকে পাকিস্তান কোন সামরিক সহায়তা পায়নি বলে তিনি উল্লেখ করেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একেবারে গোড়ার দিকে আমেরিকা তাদের নিরপেক্ষ অবস্থান দেখানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু যতই দিন গড়াতে থাকে, আমেরিকা ধীরে ধীরে পাকিস্তান সরকারের পক্ষ অবলম্বন করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জনগোষ্ঠীর উপর যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছিল সে ব্যাপারে নিরব দর্শকের ভ‚মিকা পালন করেছিল আমেরিকা। অন্যদিকে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অবস্থান ছিল আমেরিকার বিপরীত। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পাকিস্তান সেনবাহিনী বাঙালিদের উপর হত্যাকান্ড শুরুর পর বিষয়টি নজরে আসে সোভিয়েত নেতাদের।

ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে একটি চুক্তির ব্যাপারে অনেকদিন ধরেই আলোচনা চলছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিষয়টি নিয়ে খুব একটা তাড়াহুড়ো করতে চাননি। কিন্তু ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার গোপনে চীন সফর করার এক মাসের মধ্যে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন এ চুক্তি সম্পাদন করেন। ৯ আগস্ট ভারতের রাজধানী দিল্লীতে ভারত ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়েনের মধ্যে শান্তি, বন্ধুত্ব এবং সহযোগিতার ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

ভারতের গবেষণা সংস্থা অবসারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ডিস্টিংগুইশড ফেলো নন্দন ইউনিকৃষ্ণান এর মতে, ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের এই মৈত্রী সুবিধা পেয়েছিল বাংলাদেশ। কারণ এই চুক্তির ফলে চীন এবং আমেরিকার মতো শক্তিধর দেশগুলো পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করতে পারেনি। একাত্তর সালের আগস্ট মাসে রাশিয়ার ভারতের মৈত্রী চুক্তিটি ভীষণ চিন্তায় ফেলে দেয় আমেরিকাকে। তখন আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার এই মৈত্রী চুক্তিকে ‘বম্বশেল’ হিসেবে বর্ণনা করেন।

পাকিস্তানের সাথে ভারতের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়ন চুক্তিকে দায়ী করেন কিসিঞ্জার। ‘হোয়াইট হাউজ ইয়ারস’ বইতে মি. কিসিঞ্জার লিখছেন, ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে থামাতে পারতো। কিন্তু তারা সেটা করেনি। প্রকৃতপক্ষে মৈত্রী চুক্তির মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধকে উসকে দিয়েছে।’ ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারত মহাসগরে তাদের নৌবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করে। পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধকে কেন্দ্র করে সোভিয়েত ইউনিয়ন এ পদক্ষেপ নিয়েছিল।

১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, ভারত মহাসাগরে ১২ থেকে ১৫টি রণতরী পাঠিয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। এসব রণতরীতে গাইডেড মিসাইল এবং পরমাণু অস্ত্রবাহী সাবমেরিনও রয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পদক্ষেপের জবাবে পাকিস্তানের পক্ষে সমর্থন দেখানোর জন্য আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের নির্দেশে মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজকে বঙ্গোপসাগরে পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়। ১৪ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তান অভিমুখে এই রণতরী ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করে। কিন্তু পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমর্পন করার পর মার্কিন রণতরী তাদের গতিপথ পরিবর্তন করে।

নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার খবর অনুযায়ী সপ্তম নৌ বহর হিসেবে পরিচিত আমেরিকার এ নৌবহরে নয়টি জাহাজ ছিল। সে খবরে আরো বলা হয়, ভারত - পাকিস্তান যুদ্ধের প্রেক্ষোপটে আমেরিকা এই নৌবহর পাঠিয়েছিল ভারত মহসাগরে। তবে এই নৌবহরের তিনটি উদ্দেশ্যে ছিল বলে পেন্টাগন থেকে ফাঁস হওয়া গোপন বার্তা থেকে জানা যায়। মার্কিন সিন্ডিকেটেড কলামিস্ট জ্যাক এন্ডারসনকে উদ্ধৃত করে নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, উদ্দেশ্যগুলো ছিল: পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত আমেরিকার নাগরিকদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়া, সোভিয়েত ইউনিয়ন রণতরীর পাল্টা জবাব হিসেবে তাদের উপস্থিতি জানান দেয়া, পূর্ব পাকিস্তানের পতন হলে ভারত যাতে পশ্চিম পাকিস্তান আক্রমণ করতে না পারে সেজন্য তাদের নিবৃত্ত করা।

সোভিয়েত রণতরী ভারত মহাসাগরে অবস্থান নেয়ায় ভারতের মনোবল যথেষ্ঠ বৃদ্ধি পায়। এর ফলে আমেরিকা এবং চীন পাল্টা সামরিক ব্যবস্থা নেবার কথা চিন্তা করেনি। নিউ ইয়র্ক টাইমসের খবরে বলা হয়, সোভিয়েত আধিপত্যবাদের কারণে ভারত পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণের সাহস করেছে। যদি সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন না থাকতো তাহলে ভারত এ কাজ করতে পারতো না। অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিনিধি বলেন, জাতিসংঘের এই ফোরামকে সোভিয়ত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা এবং সোভিয়েত-বিরোধী কাজে ব্যবহার করছে চীন।

১৫ ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনে পোল্যান্ড একটি প্রস্তাব তুলেছিল। পাকিস্তানের প্রতিনিধি জুলফিকার আলী ভুট্টো পোল্যান্ডের প্রস্তাব সম্বলিত কাগজ ছিড়ে টুকরো-টুকরো করে নিরাপত্তা পরিষদ থেকে বেরিয়ে আসেন। এই প্রস্তাবের অন্যতম বিষয় ছিল - যুদ্ধবিরতি এবং পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাকিস্তানী সেনা প্রত্যাহার করা। পোল্যান্ডের এই প্রস্তাবকে ‘আত্মসমর্পণের দলিল’ হিসেবে বর্ণনা করেন ভুট্টো। কিন্তু ভুট্টো যখন নিরাপত্তা পরিষদে তার এই তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন, ততক্ষণে পূর্ব-পাকিস্তানের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে। আত্মসমর্পনের জন্য তৈরি হয়ে গেছে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা। দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধের অবসান ঘটছে। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন যদি ভারতে দৃঢ় সমর্থন না দিতো তাহলে এতো দ্রæত পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমর্পন করতো কিনা সেটি নিয়ে পর্যবেক্ষকদের মনে সন্দেহ আছে। সূত্র : বিবিসি বাংলা।



 

Show all comments
  • Ratan Baedday ১৪ মার্চ, ২০২২, ৪:৪৯ এএম says : 0
    এসব সত্যিকারের ইতিহাস গুলো আমাদের কিছু কিছু প্রজন্মের অজানা হয়ে আছে -আবার আরেক শ্রেণির কিছু পরাজিত শ্রুত্রু তাদের মেনে নিতে কষ্ট পাই।আজ তেমনি ভাবে বাংলাদেশ যেই ভূমিকা পালন করলো - এটাই সত্যিেকারের প্রয়োজন ছিল -তাই আজ আমাদের জননেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর কন্যা -তাহার অভিজ্ঞতা চিন্তা ভাবনা কাহারো সাথে তুলনা হয় না - অতীত কে ভুলে যেতে দেন্ নাই রাশিয়া আমাদের বন্ধু ছিল - আমেরিকা নয় - জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু।
    Total Reply(0) Reply
  • Jashim Chowdhury ১৪ মার্চ, ২০২২, ৪:৪৯ এএম says : 0
    বাংলাদেশ জন্মের আগে, জন্মলগ্ন ও জন্মের পরে সোভিয়েত ইউনিয়নপন্থী ছিল এবং আছে। যে আমেরিকা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছিল সে আমেরিকা কখনো বন্ধু রাষ্ট্র ছিল না। তারা আমাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে।
    Total Reply(0) Reply
  • Akther Hussain ১৪ মার্চ, ২০২২, ৪:৫০ এএম says : 0
    সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতা আমাদের চিরদিন মনে রাখতে হবে।তাও মনে রাখতে হবে আমাদের প্রতিবেশি যতটুকু সাহায্য করেছে তারচেয়ে তারা বেশি লাভবান হয়েছে। সেটা অর্থনৈতিক,রাজনৈতিক এবং সামরিক দিক দিয়ে।
    Total Reply(0) Reply
  • Kazi Maksudur Rahman ১৪ মার্চ, ২০২২, ৪:৫০ এএম says : 0
    তখন আমাদের সমর্থন করছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন । তখন ইউক্রেনের সৈন্যরা আমাদের বেশি সহযোগিতা করেছিল। রাশিয়া এবং ইউক্রেন উভয়েই আমাদের বন্ধু আমরা চাই যুদ্ধ বন্ধ করে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা।
    Total Reply(0) Reply
  • Pyr Ahmad Rubel ১৪ মার্চ, ২০২২, ৪:৫০ এএম says : 0
    কেউ দয়া করেনি সবাই নিজের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্বার্থে করেছে।।
    Total Reply(0) Reply
  • মোহাম্মদ দলিলুর রহমান ১৪ মার্চ, ২০২২, ৬:৩৪ এএম says : 0
    আপনারা রাশিয়া ইউক্রেন বলছেন,পূর্বে এরা একটি দেশ ছিল এত এব সবাই আমাদের উপকার করেছে বলতে হবে,কিন্তু এখন ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়াঝাঁটি করে নিপাত হতে,আমেরিকা পশ্চিমা শাসকেরা এক ভাইয়ের ঘরে এসে বসেছে রাসায়নিক পাতিল নিয়ে,এবং করনার মত বিভিন্ন রোগ ছড়াইয়া দিতে,বদনাম ভাইয়ের কাজ শয়তানের,এখন শয়তান তামাশা দেখেন,আর ভাই ভাই ঝগড়াঝাঁটি করে মারতেছি,কিন্তু ভাই ভাইকে না দেখে আননের কথা শুনবেন কি জন্য,এক ভাই নাট্যকার আরোক ভাই সম্রাট ,নাট্যকার ভাইয়ের দেমাক নাই,সে মনে করেছে নাটক বড়,তাহার নাটক দেখে সবাই তাকে সাপোর্ট করবে,সেটা তার ভুল।
    Total Reply(0) Reply
  • Titu Meer ১৪ মার্চ, ২০২২, ৮:১১ এএম says : 0
    চরম মুসলিম বিদ্বেষি ইহুদীবাদী জেলোনস্কির পতন কামনা করি এবং বাংলাদেশের দুঃসময়ের সমর্থকারী রাশিয়ার বিজয় হোক, দোয়া করি ।
    Total Reply(0) Reply
  • Titu Meer ১৪ মার্চ, ২০২২, ৮:৩৪ এএম says : 0
    চরম মুসলিম বিদ্বেষি ইহুদীবাদী জেলোনস্কির পতন কামনা করি এবং বাংলাদেশের দুঃসময়ের সমর্থকারী রাশিয়ার বিজয় হোক, দোয়া করি ।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রাশিয়া


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ