Inqilab Logo

বুধবার ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১, ০৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মাওলানা জাফরুল্লাহ খানের জীবন ও কর্ম

মুফতি সুলতান মুহিউদ্দিন | প্রকাশের সময় : ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:২৭ এএম

বর্ষীয়ান আলেম, প্রবীণ রাজনীতিবিদ, বিশিষ্ট লেখক ও অনুবাদ, মাওলানা মুহাম্মদ জাফরুল্লাহ খান রহ. ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। এদেশে খেলাফত তথা ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠা ও ইসলাম বিরোধী অপশক্তির মোকাবেলায় যারা ত্যাগ ও সংগ্রাম করে গেছেন তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম। তিনি দীর্ঘ ২৮ বছর হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহমাতুল্লাহি আলাইহি প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করে গেছেন। ইসলাম বিরোধী অপশক্তির যখনই মাথাচাড়া দিয়ে উঠতো তিনি সর্বাগ্রে তার প্রতিবাদে ঝাপিয়ে পড়তেন। উলামায়ে কেরামের ঐক্যের ব্যাপারে তার ভূমিকা ছিলো প্রশংসনীয়।
মাওলানা মুহাম্মদ জাফরুল্লাহ খান নেত্রকোনা পৌরসভার অন্তর্গত মালনী গ্রামের মদীনাবাগ মহল্লায় এক সম্রান্ত 'খান' পরিবারে ১৯৫১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মুহাম্মাদ মশরব উদ্দিন খান রহ.। ১৯৫৫ সনে নেত্রকোনার মিফতাহুল উলুমে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগে ভর্তি হন এবং একটানা ১২ বৎসর লেখাপড়া করেন। ১৯৬৮ সনে মোমেনশাহীর সুবিখ্যাত জামিয়া ইসলামিয়ায় হাদিসের প্রথম বর্ষে ভর্তি হন। ১৯৬৯ সনে ঢাকার ঐতিহাসিক জামেয়া কোরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ মাদরাসায় হাদিসের শেষ বর্ষ সমাপ্ত করেন। সাথে সাথে ইলমে তাজবীদ ও অধ্যায়ন করেন। ১৯৭২ সনে চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক দারুল হাটহাজারীতে পুনরায় তাকমিল ফিল হাদীসে ভর্তি হন, এবং ইলমে তাফসিরও চর্চা করেন।
তিনি ইলমে হাদিস ও ইলমে তাফসীর যাদের থেকে অধ্যায়ন করে এজাজতপ্রাপ্ত হয়েছেন, তারা হলেন- বিশ্ব বিখ্যাত হাদিস বিশারদ মাওলানা জাফর আহমদ উসমানী সাহেব রহ., হাকীমুল ইসলাম মাওলানা কারী মুহাম্মাদ তাইয়্যেব রহ., যুগশ্রেষ্ঠ ওলি হযরত মাওলানা মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রহ. শায়খুল হাদীস মাওলান আজিজুল হক রহ., শায়খুত তাফসীর মুফতী দ্বীন মুহাম্মদ খান রহ., মুফতী আব্দুল মুইজ রহ., মাওলানা আব্দুল কবীর রহ., মাওলানা আব্দুল মজিদ ঢাকুবী রহ., হাটহাজারীর মাওলানা আবদুল কাইয়ুম রহ., মুফতী আহমাদুল হক রহ., মাওলানা আবদুল আজীজ রহ., শায়খুত তাফসীর মাওলানা আবুল হাসান রহ., মাওলানা হামেদ রহ., মাওলানা মুহাম্মদ আলী রহ., চট্টগ্রাম। আর হাদীসে মুসালসালাতের সনদ দিয়েছেন দারুল ঊলূম দেওবন্দের শায়খে সানী শায়খুল হাদীস মাওলানা আব্দুল হক আজমী রহ.। এছাড়া তিনি ইলমে ফিকহ বিষয়ে মুফতীয়ে আজম বাংলাদেশ মুফতী ফয়জুল্লাহ রহ. থেকে দীক্ষা নিয়েছেন। আধ্যাত্বিক উৎকর্ষ সাধনায় একাধারে ১৭ বছর হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছেন এবং রাজৈনতিক অঙ্গনেও তার মতাদর্শে দীক্ষিত হয়েছেন।
তাছাড়া সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতী আল্লামা বিন বায, পাকিস্তানের মুফতীয়ে আজম মাওলানা মুহাম্মদ শফী রহ., মাওলানা ইহতেশামুল হক থানবী রহ.,, কুয়েতের আল্লামা শায়খ রেফায়ী, ভারতের মাওলানা মসিহুল্লাহ খান রহ., এবং দেশের মাওলানা আব্দুল ওয়াহাব হাটহাজারী, মাওলানা আতহার আলী জালালাবাদী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, খতীবে আজম আল্লামা সিদ্দিক আহমদ রহ., মাওলানা মুসলেহ উদ্দিন রহ., মাওলানা মাজহারুল ইসলাম রহ. মাওলানা সামছুদ্দীন কাসেমী রহ., হাজী ইউনুস ও এডভোকেট ফরীদ আহমদ রহ. প্রমুখের সান্নিধ্যে ছিলেন। সর্বশেষ তিনি শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির তত্ত্বাবধানে ছিলেন। তিনি তাঁর খলিফাও।
তিনি মনে করতেন যে, বিশ্ব মুসলিমের রাজনৈতিক মুক্তির জন্য আলাদা জাতিসংঘ, আলাদা আন্তর্জাতিক মুদ্রা, আলাদা সম্মিলিত বাহিনী হওয়া বাঞ্ছনীয়। তিনি একজন চিন্তাশীল ও সৃজনশীল ব্যক্তিত্ব ছিলেন, কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন। তিনি চট্টড়গ্রাম দামপাড়া মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালনাসহ অনেক মাদরাসা-মক্তব পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আল কুরআনের তরজমা ও তাফসীরসহ তার লিখিতি গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় শতাধিক। বই-পুস্তকের রচনা, গ্রন্থণা, অনুবাদ ও সম্পাদন এবং তাফসীর, সীরাত, মাওয়ায়েজে হাসানাহও করেছেন। স্বরচিত পুস্তকের প্রকাশনায় তিনি যারপরনাই আনন্দিত হতেন। দেশ ভ্রমণ, শিক্ষা গ্রহণ, বই লেখা তার পছন্দ ছিলো। কারো সমালোচনা করা সর্বাধিক অপছন্দ ছিলো। মাওলানা জাফরুল্লাহ খান সাধারণ জীবন-যাপনে স্বাছন্দ্যবোধ করতেন। উচ্চবিলাসী বা বাড়ি গাড়ি অধিক টাকার মালিক, সম্পদশালী হওয়ার স্বপ্ন কখনও দেখতেন না। সবসময় কায়োমানাবাক্যে মাওলা পাকের কাছে মুনাজাত করতেন ‘হে আল্লাহ আমাকে জুমার দিনে শাহাদাতের মউত দিও। আমার কবর যেন মদিনায় হয়।’ ঈমানের সাথে মৃত্যুবরণ এবং নেককারগণের সাথে হাশর করণ তাঁর একান্ত প্রার্থনা ছিলো।’
নিজের হাতে প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম নগরীর দামপাড়া মাদরাসার প্রতি হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা ছিল সারাজীবন। মাদরাসার কমিটিও তাকে সবোর্চ্চ সম্মান করতেন। তাই মাদরাসার বার্ষিক মাহফিলে তিনি বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। বৃহস্পতিবার মাদরাসার মাহফিলে বয়ানে করেছেন। শুক্রবার বাদ ফজর মাদরাসার মসজিদে মুসল্লীদের সুন্নাতের তা’লীম দিয়েছেন। নিজেও জুমার নামাজের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন। জুমার দিনের বিশেষ আমল সূরা কাহাফ তিলাওয়াতকালে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে হাসাপাতাল নেওয়ার পথে মাওলানা মুহাম্মদ জাফরুল্লাহ খান ইন্তেকাল করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন। পরদিন জন্মস্থান নেত্রকোণা পৌরসভার মালনী গ্রামে সকাল ১০ টায় নিজ ছেলে মাওলানা নিয়ামতুল্লাহ খানের ইমামতি জানাযার নামাজ শেষে পারিবারিক কবরস্থানে বাবা-মার পাশে শায়িত করা হয়। দাম্পত্য জীবনে তার ১ স্ত্রী, ২ ছেলে , ৭ মেয়ে। তন্মোধ্যে ১ ছেলে ও ২ মেয়ে শিশুকালে ইন্তেকাল করেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মাওলানা জাফরুল্লাহ খানের জীবন ও কর্ম
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ