Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইউরোপ-আমেরিকার পর্যটন ব্যবস্থা এবং আমাদের সম্ভাবনা

রহমান মৃধা | প্রকাশের সময় : ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:০৩ এএম

ভ্রমণ করতে পছন্দ করে না এমন মানুষ খুব কমই পাওয়া যাবে। ছোটবড় সবাই ভ্রমণ করতে পছন্দ করে। ছোটবেলা নৌকায় করে নদীপথে নানা বাড়ি যখন যেতাম, সারাদিন লেগে যেতো। তবুও ক্লান্তি অনুভব করিনি। বাড়ি থেকে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কথা শুনলেই আনন্দে মন ভরে যেত। এখনো দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করা, নতুন নতুন শহর এবং প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখা ও উপভোগ করি। ইউরোপের বিভিন্ন শহর ও স্থানে আমি ভ্রমণ করেছি। এতে নানা অভিজ্ঞতা হয়েছে।

ভ্রমণ সব সময় পরিবেশ বা পরিস্থিতি অনুযায়ী হয় না। তা সত্ত্বেও ভ্রমণের সময়টুকুু কম-বেশি সবাই ম্যানেজ করার চেষ্টা করে। যারা নিয়মিত দেশ-বিদেশ ঘোরাঘুরি করেন তাদের জিজ্ঞেস করলে বলবেন, সব ভ্রমণ সব সময় সমপরিমাণ বিনোদন দেয় না। ভ্রমণে বেদনা এবং আনন্দ দুটোই থাকে। যেমন অনেক সময় দেখা যায় প্লেনের ভ্রমণ ভালো হয় না। কারণ, প্লেনের ছিটের স্পেস কম বা ভালো সার্ভিসের অভাব। কখনো হোটেলের সার্ভিস ভালো হয় না। যেমন নোংরা টয়লেট, রেস্টুরেন্টের খাবার এবং সার্ভিস মনপূত না হওয়া, কখনও আশপাশের পরিবেশ বা সমুদ্রসৈকতের পরিবেশ পছন্দমত না হওয়া ইত্যাদি। আবার ভ্রমণ হতে পারে একাকী, স্বামী-স্ত্রী বা একটি পুরো পরিবার মিলে। তবে ভ্রমণে যাবার আগে কোথায় ভ্রমণ, কেন ভ্রমণ এ বিষয়ের উপর সবার মতামত এবং একটি বাজেট নির্ধারণ করা প্রয়োজন। সঙ্গীদের সবাই যেন ভ্রমণের আনন্দ উপভোগ করতে পারে তার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। ভ্রমণে একটি জিনিস সচরাচর ঘটে, তাহলো নিজেদের মাঝে মনোমালিন্য হওয়ার আশঙ্কা থাকে। পশ্চিমা দেশগুলোতে ডিভোর্স পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে বা হয়ে থাকে যদি ভ্রমণকালীন সময়ে আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের অভাব হয়।

একটা বিষয় খেয়াল রাখা দরকার হোটেলে থাকাকালীন ভালো সার্ভিস পেতে স্টাফদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। অনেকে হোটেল থেকে বিদায় নেওয়ার সময় হয়ত বকশিস বা টিপস দেয়, ভালো সার্ভিসের কারণে। আমি হোটেলে ঢুকেই প্রথম দিন টিপস দেই, যাতে শুরু থেকেই তারা ভালো সার্ভিস দেয়। রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে বিশেষ করে ইউরোপে, যে রেস্টুরেন্টে লোকাল লোকজন বেশি যায়, সেখানে খাবার এবং সার্ভিস ভালো হয়ে থাকে। এশিয়ায় বিশেষ করে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া বা মালয়েশিয়ার স্ট্রিটফুড সবসময় সুস্বাদু এবং দামও কম হয়ে থাকে। ওয়েস্ট ইউরোপ এবং আমেরিকায় কোনো কিছু ভালো না হলে কমপ্লেইন করা যেমন সহজ, তেমনটি সহজ নয় মধ্যপ্রাচ্য বা ইস্ট ইউরোপে। কারণ, আমেরিকা এবং ওয়েস্ট ইউরোপে ক্রেতার প্রাধান্য সব সময় বেশি দেওয়া হয়ে থাকে। কোথাও ভালো সার্ভিস না পেলে সেখানে দ্বিতীয় বার না যাওয়াই শ্রেয় বলে মনে করি। ইদানিং ইউরোপের হোটেলে সিটি ট্যাক্স নেওয়া শুরু হয়েছে, যা চেক আউটের দিন পে করতে হয়। একটি উদাহরণ দিই, গত বছর সামারে বুকিং দিয়েছি সেন্ট্রাল প্যারিসে একটি ফোর স্টার হোটেল, যা পঞ্চাশ পারসেন্ট ডিসকাউন্ট অফার করেছিল। হোটেলের ছবি, লোকেশন এবং ডিল সব মিলে ভালোই মনে হওয়ায় বুকিং করি। হোটেলে ঢুকে দেখি কিছুই মনপূত নয়। আগে বুকিং করায় টাকা আর ফেরত পাওয়া যাবে না। দুদিন থেকেছি, প্রতিদিনই সকালে নক করে ঘুম থেকে আমাদের তুলেছে তাড়াতাড়ি রুম পরিষ্কার করার জন্য। শেষের দিনও একই কাজ করেছে, যদিও আমাদের চেক আউটের সময় দুপুর বারোটা। আমার বেশ মেজাজ খারাপ হয়েছে বার বার বিরক্ত করার কারণে। ক্লিনারদের রিসিপশন ডেস্ক থেকে চেক করার কথা রুমে গেস্ট আছে কিনা। তা না করে, বার বার নক করে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটিয়েছে, যা ছিল খুবই বিরক্তিকর। বিষয়টি ম্যানেজারকে জানাতেই ‘সরি’ বলল। পরে চেক আউটের সময় সিটি ট্যাক্স হাতে ধরিয়ে দিতেই রাগ করে বললাম, তোমার শহরের মেয়রকে শুভেচ্ছা দিও যে, হোটেলের ক্লিনারের বারবার দরজায় নক করার কারণে তার সিটিতে গেস্ট নিরিবিলি ঘুমাতে পারেনি। সে জন্য গেস্ট সিটি ট্যাক্স পে না করে সুইডেনে চলে গেছে। একথা বলার পর হোটেল ম্যানেজার তৎক্ষণাৎ বলল, আমাকে সিটি ট্যাক্স দিতে হবে না। আমেরিকায় যদি এমন ঘটনা ঘটে গ্রাহক তার ন্যায় বিচার পেয়ে থাকে, কিন্তু ইস্ট ইউরোপে এধরনের সার্ভিস পাওয়া কঠিন। আমি মনে করি, ভালো ব্যবহার, ভালো সার্ভিস সবসময় দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্ক তৈরি করে। সে ক্ষেত্রে সব দেশের উচিৎ পর্যটকদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা এবং তাদের ভালো সার্ভিস দেওয়া। ইন্টারনেটের যুগে অনেক কিছুই জানা সম্ভব। তাই এর সাহায্যে ভ্রমণের আগে একটু জেনে এসব বিষয়ে অবগত হওয়া ভালো। ভ্রমণে শুধু বিনোদন নয়, এর মাধ্যমে শিক্ষা, জানা, শোনা, শেখা এবং দেখার সুযোগ সৃষ্টি হয়। ভ্রমণে মানসিক চিন্তাশক্তির বিস্তৃতি ঘটে। মন মানসিকতায় ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। অন্যান্য মানুষের সাংস্কৃতিক, রীতিনীতি সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়।

দেশে শুরু হয়েছে ফাগুন মাস। মনে পড়ছে, ‘ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে’ পুরো দেশ ভরা পরম করুণাময়ের রহমত, তা সত্ত্বেও বিদেশি পর্যটকদের হৃদয়ে এর প্রতি আগ্রহ খুব একটা তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না। কী কারণ থাকতে পারে এর পেছনে? সম্ভাব্য কারণগুলো হচ্ছে, আমাদের পর্যটন স্পটগুলোতে হকার, টোকাইদের হয়রানি, খাবার, আবাসিক খরচ তুলনামূলক অনেক বেশি, কোনো কোনো সময় প্রতারণাও শিকার হন পর্যটকরা। পর্যটন এলাকার পরিবহন খরচও মাত্রারিক্ত রাখা হয়। বিদেশি দেখলে তো আর কথাই থাকে না। নিরাপত্তার সংকট তো আছেই। সর্বোপরি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা খুবই জরুরি। কেউ এখন ইউক্রেন যেতে রাজি হচ্ছে না, বরং সেখান থেকে সবাই বের হতে উঠে পড়ে লেগেছে। অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ট্যুরিস্টদের সাথে ভালো আচরণ করা শিখতে হবে, তাদের নিরাপত্তা দিতে হবে, যেখানে পর্যটকদের আনাগোনা, সেখানে সুন্দর পরিবেশ তৈরি করতে হবে। মনে রাখতে হবে, পর্যটন থেকে পৃথিবীর অনেক দেশ অর্থনীতিতে যেভাবে উপকৃত হচ্ছে, তার শত ভাগের এক ভাগ যদি আমরা ম্যানেজ করতে পারি, তাহলে বিষয়টি বুজতে সহজ হবে পর্যটনের গুরুত্ব কী?

চাইলেই বাংলাদেশে সুন্দর ব্যবহার এবং নিরাপত্তার মাধ্যমে পর্যটকদের স্বস্তি ও আনন্দ নিশ্চিত করতে পারে। আমাদের দেশে যেসব ন্যাচারাল সৌন্দর্য রয়েছে, তা সত্যিই উপভোগ করার মতো। বাস্তবতা হচ্ছে, উপভোগ করা সম্ভব হচ্ছে না। দেশের অস্থিতিশীলতা, দুর্বল ম্যানেজমেন্ট এবং সর্বোপরি নোংরা পরিবেশ এর জন্য দায়ী। আশা করি, কর্তৃপক্ষ এ বিষয়গুলোর ওপর কড়া নজর দেবেন এবং বিশ্বের পর্যটকদের নতুন করে বরণ করতে সক্ষম হবেন। বাংলাদেশের অনেকেই বিশ্বের নানা দেশ ঘুরছে বা ঘুরতে শুরু করেছে। এখন আমাদের প্রাকৃতিক এবং ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো নিয়ে যদি বিশ্বজুড়ে প্রচার করা যায়, পর্যটকদের জন্য নিরাপদ এবং সাচ্ছন্দময় পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়, তাহলে পর্যটনখাতে বিপুল সম্ভাবনা তৈরি হবে।

লেখক: সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন