Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামে সুস্থ পরিবার ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশ

প্রকাশের সময় : ৬ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির

সমাজের প্রাণকেন্দ্র হলো পরিবার। ইসলামের দৃৃষ্টিতে পরিবার শুধুমাত্র একটি উত্তম সমাজিক প্রতিষ্ঠানই নয়, বরং একটি পবিত্র সংস্থা। পরিবারের সুখ-শান্তি এবং পারস্পরিক সম্পর্ক ছাড়াও রয়েছে একটি আইনগত ও সামাজিক দিক। মানব জীবনের জৈবিক চাহিদা স্বামী-স্ত্রীর মাধ্যমে পরিপূর্ণ করা ছাড়াও এর রয়েছে একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবদান। আমাদের ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে ইসলাম প্রবর্তিত পরিবার প্রথার সুফল পেতে হলে এর সুস্থ ও সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। নৈতিক চরিত্র গঠনের প্রকৃষ্ট ক্ষেত্র হলো পরিবার। সামাজিক সম্পর্ক সৃষ্টি ও বৃদ্ধি হয় পরিবারকে কেন্দ্র করে।
পরিবারে একজন আর একজনের প্রতি বিশ্বস্ত এবং অনুগত হতে হয়। তা থেকে সৃষ্টি হয় সামাজিক আনুগত্য। এক ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির প্রতি দরদ এবং অনুভূতি ছাড়া আদম সন্তানের মানবিক শান্তি সৃষ্টি হতে পারে না। পরিবার ছাড়া জীবনের যাত্রাপথে থাকে না কোনো নিরাপত্তা। সামাজিক, মানবিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মানুষ পরিবারেই সবচেয়ে বেশি পারস্পরিক সহযোগিতা পেয়ে থাকে। পবিত্র আল কোরআনে পারিবারিক সদস্যদের মুহসিনীন বা প্রাচীর ঘেরা দুর্গে অবস্থানকারী সুরক্ষিত লোকজনের সাথে তুলনা করা হয়েছে।
ইসলামে পরিবার শুধুমাত্র স্বামী-স্ত্রী এবং সন্তানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, পরিবারের পরিসর আরো ব্যাপক নিকট আত্মীয়স্বজন ও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত তাদের সাথে সম্পক দয়া, করুণা এবং সহানুভূতি তো আছেই, বাড়তি দায়িত্বশীলতার প্রশ্নও জড়িত। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পূর্ণ সহযোগিতা ও ¯েœহ ভালোবাসার বন্ধনের ওপর নির্ভর করে পারিবারিক জীবনের সুখ-শান্তি ও সর্বাঙ্গীণ উন্নতি, স্বামী-স্ত্রী নিজ নিজ কর্তব্য পালন করে চললে পারিবারিক পরিবেশ অনেকাংশে সুখ ও শান্তিতে ভরে ওঠে। পরিবার হচ্ছে আদি ও ক্ষুদ্রতম একক অংশ বা ইউনিট। মানব সৃষ্টির শুরু থেকেই পরিবারের উৎপত্তি ঘটেছে এবং পরিবারের অস্তিত্বের সাথে মানব প্রকৃতি সম্পৃক্ত। ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় পরিবারই হলো মানুষ গড়ার মূল কেন্দ্র এবং সমাজ গঠনের প্রধান ভিত্তি। এ জন্য পরিবার গড়ার ব্যাপারে ইসলাম বিশেষভাবে যতœবান হওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে।
দাম্পত্য জীবন সুখের হলেই পরবর্তীতে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনও আনন্দময় হয়। আল্লাহতায়ালা তাই দাম্পত্য জীবন গঠনের পূর্বশর্ত হিসেবে স্বামীর জন্য বিবাহের পূর্বে স্ত্রী ও সন্তানের ভরণ-পোষণের জোগান দেয়ার যোগ্যতা অর্জন করার কথা বলেছেন। পারিবারিক জীবনে প্রবেশ করার পূর্বেই একজন পুরুষের উচিত তার স্ত্রীর ও ভবিষ্যৎ বংশধরদের ভরণ-পোষণ করার মতো আথির্ক সচ্ছলতা অর্জন করা। মহান আল্লাহপাক বলেন, “আর সন্তানের পিতার দায়িত্ব যথাবিধি তাদের (মা ও শিশুর ) ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করা।” (সূরা বাকারা, আয়াত-২৩৩)
এ আয়াত দ্বারা এ কথা বোঝানো হয়েছে যে, শিশুকে স্তন্যদান মাতার দায়িত্ব, আর ভরণ-পোষণ ও জীবন ধারণের অন্যান্য দায়িত্ব বহন করবে পিতা। সামাজিক পরিবেশে বসবাস করা স্ত্রীর ন্যায্য অধিকার এবং বাচ্চাকে দুধ পান করানো তার সর্বশ্রেষ্ঠ মমত্ববোধের পরিচয় ও কর্তব্য। এটা শিশুর অন্যতম অধিকারও বটে। সুরা বাকারায় বলা হয়েছে : “মায়েরা তাদের সন্তানদের পূর্ণ দুই বছর দুধ পান করাবে।”
এসব অধিকার যথাযথভাবে আদায় করে স্বামী পরিবারের অভিভাবকের দায়িত্ব পালনে প্রয়োজন আর্থিক সচ্ছলতা। নতুবা স্ত্রীর অধিকার আদায় করা বা সন্তানের পুষ্টি, স্বাস্থ্য, বিনোদন, ভবিষ্যৎ জীবন গঠন কোনোটিই সম্ভব নয়। তাই পারিবারিক পরিবেশ সুন্দর ও শান্তিময় করতে হলে সকলকে আর্থিকভাবে সচ্ছল হতে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। মাতা-পিতার ওপর সন্তানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট বয়সে তার জন্য আলাদা শয়নের ব্যবস্থা করা। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “তোমাদের সন্তানদের বয়স যখন সাত বছর হয়, তখন তোমরা তাদেরকে নামাজের জন্য আদেশ কর। আর দশ বছর হলে তাদেরকে নামাজের জন্য তাগিদ দেবে এবং ফাররিকু বায়নাহুম ফিল মাদাজিই তাদের বিছানা আলাদা করে দেবে।”
হযরত লোকমান (আ.) নিজ পুত্রকে যে মূল্যবান উপদেশ দিয়েছেন পবিত্র কোরআন শরিফে তার উল্লেখ হয়েছে এভাবেÑ “হে বৎস নামাজ কায়েম কর, সৎ কাজের আদেশ দাও, মন্দকাজে নিষেধ করা এবং বিপদাপদে সবর করা। নিশ্চয়ই এটি দৃঢ়তার কাজ”। (সুরা লোকমান, আয়াত-১৭) শিশুরা নরম মাটির মতো, শৈশবে যে মূল্যবোধ ও আদব-আখলাকের পরিবেশে বেড়ে উঠবে তাই পরবর্তী জীবনে স্থায়ী হয়ে যায়। এ কারণে পরিবার হচ্ছে শিশুর প্রথম বিদ্যালয়।
এ সময়ে মাতা-পিতা নিজেদের অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব দিয়ে এবং ধর্মীয় নির্দেশনার মাধ্যমে তাদের প্রতিপালন করবেন। হযরত দয়াল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “পিতা-মাতার ওপর সন্তানের অন্যতম অধিকার হচ্ছে তাকে উত্তম শিক্ষা দেয়া এবং সুন্দর একটি নাম রাখা।” (বায়হাকী শরিফ) ছোট বেলা থেকেই শিশুর শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। এটি মাতা-পিতার ওপর ফরজ। এই কর্তব্য পালন না করলে গুনাহগার হতে হবে এবং আখেরাতে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। হযরত মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনÑ “দোলনা থেকে শিক্ষা শুরু কর।” তিনি মুসলিম শিশুকে দোলনায় দেখতে চেয়েছেন, অযতœ-অবহেলায় ধুলাবালিতে নয়। আর তাকে এ বয়স থেকেই আনন্দপূর্ণ পরিবেশে শিক্ষার ব্যবস্থা করতে বলেছেন। পিতা-মাতাকে এ ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। সন্তান জন্ম দিলেই চলবে না, তার শিক্ষা-দীক্ষা ও ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে ভাবতে হবে, যাতে সে যোগ্য ঈমানদার ব্যক্তিরূপে গড়ে ওঠে।
শিশুকে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে লালন-পালনের সাথে তার মননশীলতার বিকাশও প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে অভিভাবককে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার মধ্যে মিথ্যা বলা, নাপাক থাকা, নামাজ না পড়া ইত্যাদি বিষয়ের ওপর। এ জন্য চাই সহায়ক পরিবেশ। প্রিয় নবী (সা.) শিশুদের জ্ঞানদানের কথা বলেই ক্ষান্ত হননি, বরং তাদেরকে সাঁতার কাটা, এমন কি তীর চালানো পর্যন্ত শিক্ষা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। লিখন, সাঁতার কাটা, তীর চালানো শিক্ষা দেয়া এবং পবিত্র উপজীবিকার ব্যবস্থা করা পিতার ওপর সন্তানের অধিকার; (বায়হাকী)
ইসলাম একটি মধ্যপন্থি দ্বীন বা জীবন ব্যবস্থা। ইসলাম বলেছে তুমি আয় বুঝে ব্যয় কর। দারিদ্র্য যেমন ইসলাম কামনা করে না, অনুরূপভাবে ইসলামে বাহুল্য বর্জনের নির্দেশও রয়েছে। কারণ সীমাহীন দারিদ্র্য অনেক ক্ষেত্রে মানুষকে কুফরির পথে ধাবিত করে, আবার সীমাহীন প্রাচুর্য আর অপরিকল্পিত সন্তান-সন্ততি ও পারিবারিক সদস্য বৃদ্ধি, পরিবারে অশান্তি ডেকে আনে। অনেক ক্ষেত্রে মানুষকে সত্য ও ন্যায়ের পথ থেকে বিপথগামী করে। সন্তানের জন্মদানই বড় কথা নয়, বড় কথা হচ্ছে, সন্তানের উপযুক্ত ভরণ-পোষণ এবং শিক্ষা ও স¦াস্থ্য সম্পর্কিত দায়িত্ব পালন। হযরত নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনÑ “তোমাদের প্রত্যেকেই এক একজন দায়িত্বশীল এবং সবাই তার দায়িত্বের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হতে হবে।” পুরুষ তার গৃহে দায়িত্বশীল, এ জন্য তাকে জবাবদিহি করতে হবে। অনুরূপভাবে নারী তার স্বামী গৃহে একজন দায়িত্বশীল এবং দায়িত্বের ব্যাপারে তাকে জবাবদিহি করতে হবে। (বুখারি ও মুসলিম শরিফ)।
তাই ইসলামী ঐতিহ্য রক্ষা ও বরকতময় পারিবারিক পরিবেশ পুনঃ প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে আমাদের কতিপয় বিষয়ের প্রতি যতœবান হতে হবে। (১) স্বামী-স্ত্রী দাম্পত্য ও পারিবারিক জ্ঞান। (২) এ ক্ষেত্রে তাদের বয়সের সমতা। (৩) আর্থিক সামর্থ্য। (৪) পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি সকলের পরিচ্ছন্নতা ও সু-স্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণ। (৫) ইসলাম প্রবতির্ত উন্নততর ধারণা প্রয়োগ করা ইত্যাদি
লেখক : সংগঠক ও সাংবাদিক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইসলামে সুস্থ পরিবার ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশ
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ