Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মাতৃভাষা আল্লাহর শ্রেষ্ঠ দান

খুৎবা-পূর্ব বয়ান

শামসুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:০০ এএম

মাতৃভাষা আল্লাহর দেয়া অনুপম নিদর্শন এবং শ্রেষ্ঠ দান। মায়ের ভাষায় কথা বলা মানুষের সৃষ্টিগত অভ্যাস। তাই ইসলাম মায়ের প্রতি যেমন অকৃত্রিম শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসার শিক্ষা দিয়েছে। তেমনি মাতৃভাষার প্রতিও অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছে। গতকাল জুমার খুৎবা-পূর্ব বয়ানে পেশ ইমাম এসব কথা বলেন। রাজধানীর মসজিদগুলোতে স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় অধিকাংশ মসজিদের বাইরে মুসল্লিদের জুমার নামাজ আদায় করতে হয়েছে।
বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের পেশ ইমাম মুফতি এহসানুল হক জিলানী গতকাল জুমার খুৎবা-পূর্ব বয়ানে বলেন, আল্লাহ তায়ালার অফুরন্ত নিদর্শনসমূহের মধ্যে ভাষা অন্যতম একটা নিদর্শন। কোরআনুল কারীমে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তার নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে আকাশসমূহ ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও রঙ-এর ভিন্নতা। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে।’’ (সূরা রূম-২২)। পেশ ইমাম বলেন, মাতৃভাষা মায়ের ভাষা। প্রত্যেক মানুষের নিকট তার নিজ মাতৃভাষা অতিশয় প্রিয়।

পেশ ইমাম বলেন, মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আ’লামীন যুগে যুগে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে তাঁর রাসূল পাঠিয়েছেন। তারা তাদের মাতৃভাষায় কথা বলেছেন, দ্বীন প্রচার করেছেন এবং প্রেরিত কিতাবসমূহ আল্লাহ তায়ালা নবী-রাসূলদের নিকট মাতৃভাষায় অবতীর্ণ করেছেন। এই সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন ‘আমি প্রত্যেক রাসূলকে তার স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি তাদের নিকট পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য। অতঃপর আল্লাহ পথভ্রষ্ট করেন যাকে চান এবং পথ দেখান যাকে চান। তিনি মহা সম্মানিত, প্রজ্ঞাময় (সূরা ইব্রাহীম-৪)। তিনি বলেন, আসুন আমরা আমাদের বাংলাভাষাকে সহিশুদ্ধভাবে বলা ও লেখার চর্চা করি এবং ভাষা আন্দোলনের মাস একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার জন্য যারা শহীদ হয়েছেন তাদের রূহের মাগফিরাতের জন্য দোয়া করছি। আল্লাহ সবাইকে কবুল করুন। আমিন।

ঢাকার গুলিস্তান ফুলবাড়িয়া রেলওয়ে জামে মসজিদের খতিব মাওলানা মুহিউদ্দীন রব্বানী বয়ানে বলেন, ভাষা আল্লাহর মহিমার এক উজ্জ্বল নিদর্শন। ইসলাম মায়ের প্রতি যেমন অকৃত্রিম শ্রদ্ধাবোধের শিক্ষা দিয়েছে, তেমনি মাতৃভাষার প্রতিও অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছে। মহান আল্লাহ সব নবী-রাসূলকে স্বজাতির ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছেন। যাতে তারা স্বীয় জাতিকে দ্বীনের দাওয়াত স্পষ্টভাবে পৌঁছাতে পারেন। কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে আমি রাসূলগণকে তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছি, যাতে তাদের (দ্বীন) স্পষ্টভাবে বুঝতে পারেন। সূরা ইবরাহিম: ৪। প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আমি আরবদের মধ্যে সবচেয়ে বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জলভাষী’। রাসূলের এ বাণী থেকে প্রমাণিত হয়; বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জল মাতৃভাষায় কথা বলার যোগ্যতা অর্জন করা রাসূল (সা.)-এর আদর্শ। খতিব বলেন, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আমাদের ভাষার অধিকার কেড়ে নিতে চেয়েছিল।

১৯৫২ সালের ৮ ফাল্গুন সংগ্রামরত অবস্থায় পুলিশের গুলিতে নির্মমভাবে শাহাদতবরণ করেন বরকত, সালাম, জব্বার, শফিক ও রফিকসহ নাম না জানা আরো অনেক বীর সন্তানেরা। এভাবে মাতৃভাষার জন্য রক্তদান বা শাহাদত বরণের ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। খতিব বলেন, ভাষা আন্দোলনের এই গৌরবোজ্জ্বল রক্তিম ইতিহাস জাতিকে অনুপ্রাণিত করবে যুগ থেকে যুগান্তরে এটি আমাদের প্রত্যাশা।
ঢাকার মোহাম্মদপুর লালমাটিয়া বায়তুল হারামের খতিব মাওলানা কাজী আবু হোরায়রা বয়ানে বলেন, আল্লাহ তায়ালা সকল অঞ্চলের মুসলমানদের জন্য মাতৃভাষার পাশাপাশি ওহীর ভাষা আরবি জানাকেও বাধ্যতামূলক করেছেন। কেননা তিনি ওহী তথা কোরআন নাজিলের জন্য আরবি ভাষাকে চয়েজ করেছেন। এজন্যই রাসূল (সা.) বলেছেন, তোমরা আরবিকে তিন কারণে ভালোবাস। প্রথমত, আমি তোমাদের নবী আরবি ভাষার, দ্বিতীয়ত, কোরআনুল কারিম তথা ওহী নাজিল হয়েছে আরবি ভাষায় এবং তৃতীয়ত আর জান্নাতের ভাষাও আরবি।

রাসূল (সা.) আরো বলেছেন, আমি আমার মাতৃভাষা আরবদের মধ্যে সবচেয়ে বিশুদ্ধভাবে বলি। তাহলে মাতৃভাষা বিশুদ্ধভাবে জানা ও বলা সুন্নাত। আর একজন মুসলিম হিসেবে আমাদের ধর্মীয় ভাষা তথা কোরআন ও হাদিসের ভাষা আরবি জানা অপরিহার্য। কেননা পরকালের ভাষা আরবি, নামাজের ভাষা আরবি, আল্লাহর নাজিলকৃত বিধানের ভাষা আরবি, জান্নাতের ভাষা আরবি, আমাদের নবী (সা.) আরবি। সে জন্য বিশুদ্ধ আরবি জানা জরুরি। বিশুদ্ধ মাতৃভাষা চর্চা করার ও আরবি ভাষা তথা পরকালের ভাষার প্রতিও আমাদের গভীর মনোযোগ দেয়া ঈমানি দায়িত্ব। আল্লাহ আমাদের তৌফিক দিন। আমিন।

মিরপুরের বাইতুল আমান কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খতিব মুফতি আবদুল্লাহ ফিরোজী বয়ানে বলেন, মাতৃভাষা আল্লাহর দেয়া অনুপম নিদর্শন এবং শ্রেষ্ঠ দান। মায়ের ভাষায় কথা বলা মানুষের সৃষ্টিগত অভ্যাস। তাই ইসলাম মায়ের প্রতি যেমন অকৃত্রিম শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসার শিক্ষা দিয়েছে, তেমনি মাতৃভাষার প্রতিও অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছে।

আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে নবী-রাসূলগণকে প্রেরণ করেছেন যেন তারা মানুষকে মহান রবের একত্ববাদের দিকে আহ্বান করেন। তিনি তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করেছেন। যাতে বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জল ভাষায় তারা মানুষের কাছে একত্ববাদের অমীয় বাণী পৌঁছাতে পারেন এবং মানুষেরাও তাদের সেই আহ্বান স্পষ্টভাবে বুঝতে পারেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, আমি সব রাসূলকেই তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছি, যাতে তাদের স্পষ্টভাবে (ধর্মীয় বিধান) বুঝাতে পারেন। (সূরা ইবরাহিম: ৪)। নবীজী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আমি আরবদের মধ্যে সবচেয়ে বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জলভাষী।’ বিশ্বনবীর এ বাণী দ্বারা বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জল মাতৃভাষায় কথা বলার যোগ্যতা অর্জনের গুরুত্ব বোঝা যায়।

খতিব আরো বলেন, মাতৃভাষা বাংলার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও যত্নবান হওয়া আমাদের ঈমানি দায়িত্ব। কারণ এ ভাষা আল্লাহর দেয়া ভাষা বৈচিত্র্যের অংশ এবং তাঁর কুদরতের অনন্য সৌন্দর্য। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘তাঁর আরেকটি নিদর্শন হচ্ছে, নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। নিশ্চয়াই এতে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শনাবলি রয়েছে।’ (সূরা রুম: ২২)। এ আয়াত দ্বারা প্রতীয়মান হয়, আমাদের মাতৃভাষা বাংলাও মহান আল্লাহর নিদর্শনাবলির অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং এ ভাষার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনসহ যত্নশীল হওয়া আল্লাহর নিদর্শনাবলির প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও যত্নবান হওয়ার নির্দেশনায় শামিল।

খতিব বলেন, আসুন ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত এই মাসে বিশুদ্ধ মাতৃভাষা চর্চার দীপ্ত শপথ নিই। পরিহার করি ভিনদেশি ভাষাকে ফ্যাশন হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতা। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ে শাহাদতবরণকারী বীর সন্তানদের রূহের মাগফিরাত কামনা করি। আল্লাহর দেয়া নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করি। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের আমল করার তৌফিক দান করেন। আমীন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: খুৎবা-পূর্ব বয়ান

২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ