পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। আগে কোনো উৎসব-পার্বন উপলক্ষে ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিত। এখন এ ধরনের কোনো উপলক্ষের প্রয়োজন পড়ছে না। প্রতিদিনই তারা জিনিসপত্রের দাম ইচ্ছেমতো বাড়িয়ে দিচ্ছে। আজ যে দাম থাকছে, কাল তা আরও বেড়ে যাচ্ছে। জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি তাদের ইচ্ছাধীন হয়ে পড়েছে, যেখানে বিবেক ও ন্যায্যতা বলে কিছু নেই। তারা দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধির ‘পাগলা ঘোড়া’ ছুটিয়ে চলেছে। দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনো সংস্থা আছে কিনা, তা নিয়ে এখন সন্দেহ দেখা দিয়েছে। সরকারের তরফ থেকে এ নিয়ে কার্যকর কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হওয়া স্বাভাবিক, সরকারও যেন ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে। সরকারের এহেন অপারগতায় সাধারণ মানুষ এক নিদারুণ কষ্ট ও দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করছে। অসংখ্য মানুষ তিন বেলার পরিবর্তে একবেলা কমিয়ে দুই বেলা খাচ্ছে। সীমিত আয়ের কর্মজীবীদের অনেকে দুপুরের খাবার খরচ বাঁচাতে ডাল-ভাতের পরিবর্তে শুধু কলা-রুটি খাচ্ছে। অনেক মুদির দোকান দিনমজুর বা দরিদ্র মানুষের জন্য পলিথিনে ১০ টাকার সয়াবিন তেল, ১০ টাকার ডাল প্যাকেট করে বিক্রি করত। এখন এ দাম দ্বিগুণ হয়ে ২০ টাকা হয়ে গেছে। মানুষের প্রাত্যাহিক মৌলিক খাবারের এমন কোনো পণ্য নেই যার দাম প্রতিদিন বাড়ছে না। এ অবস্থা কতদিন চলবে, তা কেউ বলতে পারছে না।
এপ্রিলে পবিত্র রমজান শুরু হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির জন্য ব্যবসায়ীদের কাছে এটা একটা বড় মওকা। রমজানে তারা যেমন খুশি তেমন দাম বাড়িয়ে দেয়। এবারও যে তার ব্যতিক্রম হবে না, তা নিশ্চিত করে বলা যায়। খাদ্যমন্ত্রী বলেছেন, রোজায় চালের দাম বাড়বে না। তার এ কথার সূত্র ধরে বলা যায়, বিগত কয়েক বছর ধরেই ব্যবসায়ীরা রোজার আগে পণ্যের দাম বাড়িয়ে রোজায় স্থিতিশীল দেখানোর এক ধরনের চালাকির আশ্রয় নিচ্ছে। আগেই যখন দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়, তখন রোজায় বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা থাকে না। জিনিসপত্রের দাম বিগত কয়েক মাস ধরে যেভাবে বেড়েছে, তাতে নিম্নবিত্ত তো বটেই মধ্যবিত্তের অবস্থাও কাহিল হয়ে পড়েছে। টিসিবি ্য রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় ট্রাকের মাধ্যমে ন্যায্যমূল্যে চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, চিনি বিক্রির ব্যবস্থা করেছে। এসব ট্রাক থেকে পণ্য কিনে বাজারমূল্য থেকে সাধারণ মানুষের গড়ে ২০০ টাকা সাশ্রয় হয়। ফলে ট্রাকের নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছার অনেক আগে থেকে শত শত মানুষ লাইন ধরে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকে। এদের সবাই যে পণ্য কিনতে পারে, তা নয়। দেখা যায়, লাইন অর্ধেক না পেরোতেই পণ্য শেষ হয়ে যায়। ফলে অনেককে হতাশ হয়ে ফিরে যেতে হয়। টিসিবি’র পণ্য কেনার জন্য সাধারণত নিম্নবিত্তরাই লাইন ধরে। এখন মধ্যবিত্তরাও লাইন ধরছে। পরিকল্পনা মন্ত্রী নিজেই বলেছেন, এখন টিসিবি’র লাইনে ভালো জামা-কাপড় পড়া মধ্যবিত্তরাও লাইনে দাঁড়াচ্ছে। এ চিত্র থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, দেশের সাধারণ মানুষ অর্থনৈতিক অবস্থা কী দুর্দশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অথচ সরকার বিভিন্ন পরিসংখ্যান দিয়ে ভালো অবস্থার প্রমাণ দিতে চাইছে। গতকাল দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাসিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শহরের তুলনায় গ্রামে জিনিসপত্রের দাম বেশি। এ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন এবং একে অপ্রত্যাশিত, বাস্তবতা বিবর্জিত ও অগ্রহণযোগ্য বলেছেন। বিবিএস এ প্রতিবেদন দিয়ে কি বোঝাতে চেয়েছে, তা বোধগম্য নয়। তারা বলছেন, প্রতিষ্ঠানটি হয়তো সরকারকে খুশি করার জন্য এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। অথচ বিষয়টি হওয়ার কথা বিপরীত। সাধারণভাবে কোনো পরিসংখ্যানই যথাযথ চিত্র তুলে ধরে না। এর মাধ্যমে বাস্তব পরিস্থিতির চেয়ে খণ্ডচিত্র তুলে ধরা হয়। যা সরকারের পছন্দের, তাতে তার প্রতিফলন ঘটে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, জিনিসপত্রের দামবৃদ্ধির অন্যতম কারণ হচ্ছে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থার সমন্বয় না থাকা। জনসংখ্যার চাহিদা কত এবং কি পরিমাণ খাদ্য প্রয়োজন, তা মাথায় নিয়ে পরিকল্পনা করলে পণ্যবাজার স্থিতিশীল রাখা সম্ভব। আমাদের দেশে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর আদম শুমারি করার কথা থাকলেও বিগত ১০ বছর ধরে তা করা হচ্ছে না। এ সময়ের মধ্যে যে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। বর্ধিত এই জনসংখ্যার হিসাব না করার কারণেই খাদ্য ও চাহিদার সমন্বয় হচ্ছে না। এখানে সরকারের বড় ধরনের ত্রুটি রয়েছে। অন্যদিকে সরকার বলছে, আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। যদি তাই হয়, তাহলে চাল, ডাল, শাক-সবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না। চাল আমদানিরও প্রয়োজন পড়ত না।
নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামবৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে কোনো জরিপের প্রয়োজন পড়ে না। সাধারণ মানুষ এর প্রত্যক্ষ সাক্ষী। তারা ভুক্তভোগী। পত্রপত্রিকায় প্রায় প্রতিদিনই এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। সাধারণ মানুষের দুর্দশার চিত্র উঠে আসছে। সরকার কি তা দেখছে না? নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামে মানুষের যখন ত্রাহি দশা, তখন মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির দাম বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এমতাবস্থায় জিনিসপত্রের দাম কোথায় গিয়ে ঠেকবে এবং সাধারণ মানুষ কি দুর্ভোগে পড়বে, তা কল্পনাও করা যায় না। এমনিতেই ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। তার ওপর গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির দাম বৃদ্ধি করা হলে মানুষের সহ্য করার আর কোনো সীমা থাকবে না। সরকারের উচিৎ পরিসংখ্যান থেকে নজরটি সরিয়ে সাধারণ মানুষের দিকে দেয়া। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে তাদের জীবনযাপন কতটা দুর্বহ ও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে, সেটা উপলব্ধি এবং যথোচিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। সরকারকে বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে এবং সুশাসন ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। রমজানে পণ্যমূল্য যাতে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।