পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
একটি পরিবারে ক্যান্সার আক্রান্ত একজন রোগী থাকা মানে, সেই রোগীর চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে করতে গোটা পরিবারটির দরিদ্রে পরিণত হওয়া। যদিও অনেক ভালো চিকিৎসার পরও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আক্রান্ত ব্যক্তিটি শেষমেশ মারাই যান। সত্যিকার অর্থেই চিকিৎসাক্ষেত্রে ক্যান্সার একটি ভীতিপ্রদ রোগের নাম। এই রোগটি শরীরে বাসা বাঁধলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শেষ পর্যায়ে ধরা পড়ে। একেবারে শেষ পর্যায়ে ধরা পড়ার কারণে বেশিরভাগ রোগীই মারা যায়। অথচ, আক্রান্ত হবার শুরুতেই যদি পরীক্ষার মাধ্যমে রোগটি নির্ণয় করা সম্ভব হয়, তাহলে খুব অল্প খরচে অধিকাংশ রোগীই সুস্থ হতে পারে।
বড়ো একটি সমস্যা হচ্ছে, দেশে মোটামুটি ভালোমানের ক্যান্সার চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়, এরকম হাসপাতাল আছে হাতে গোনা অল্প কিছু। এই হাসপাতালগুলির অধিকাংশই ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় দিন দিন রোগীর চাপ বেশি হচ্ছে এবং রোগীরা ক্যান্সার চিকিৎসা করতে বিদেশমুখী হয়ে অর্থনৈতিকভাবে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। দেশে বেসরকারি কিছু হাসপাতালে মানসম্মত ক্যান্সার চিকিৎসা দেওয়া হলেও তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় দেশের অধিকাংশ মানুষ এসব হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিতে পারে না। অন্যদিকে, পরিসংখ্যান বলছে, দিন যতই যাচ্ছে, দেশে ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা ততই বেড়ে চলেছে। প্রতিবছর গড়ে দেড় থেকে দুই লাখ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে এবং এদের মধ্যে এক থেকে দেড় লাখ আক্রান্ত মানুষই এই রোগে ধুকে ধুকে মারা যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক সংস্থা, ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার (আইএআরসি)’র সাম্প্রতিক প্রকাশিত অনুমিত হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর এক লাখ পঞ্চাশ হাজার মানুষ নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে মারা যায় এক লাখ আট হাজার এবং এই সংখ্যা প্রতিবছর বেড়েইে চলছে। এই সংস্থার মতে, বাংলাদশে ক্যান্সার আক্রান্তের হার প্রতি লাখে ১০৫.৭ এবং মৃত্যুহার প্রতি লাখে ৭৭.১।
অনানুষ্ঠানিক এক জরিপে দেখা গছে, এই অনুমিত ক্যান্সার রোগীদের এক তৃতীয়াংশ দেশের স্বীকৃত চিকিৎসা সেবার আওতায় আসে। বাকিদের একটা বড়ো অংশ বিদেশে চিকিৎসা নিচ্ছে কিংবা নানা অবৈজ্ঞানিক ব্যবস্থার আশ্রয় নিচ্ছে। ফলে ক্যান্সার নির্ণয় ও চিকিৎসা সেবার বাইরে থেকে যাচ্ছে বিপুল সংখ্যক রোগী। গত দুই দশকে দেশে সরকারি খাতে ক্যান্সার চিকিৎসার আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির সন্নিবেশ ঘটেছে লক্ষণীয়ভাব। ঢাকার মহাখালীস্থ জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টটিউিট ও হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা প্রথমে ৫০ থেকে ৩০০-তে উন্নীত করা হয়েছে এবং এরপর আরো ৫০০ শয্যাসংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে, যেখানে রেডিও থেরাপির আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযুক্ত হয়ছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও ঢাকার বাইরে বগুড়াতে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেডিও থেরাপির সর্বাধুনিক লিনিয়ার এক্সিলারেটর মেশিন সংযুক্ত হয়ছে। পুরাতন ৮টি বিভাগীয় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পূর্ণাঙ্গভাবে সবগুলিতে ক্যান্সার বিকিরণ চিকিৎসা, কেমোথেরাপির ব্যবস্থা চালু নেই। বেসরকারিখাতে কয়েকটি বড়ো হাসপাতালে রেডিও থেরাপিসহ ক্যান্সার চিকিৎসা চালু হয়েছে, যেখানে অনেক স্বচ্ছল রোগী চিকিৎসা নিতে পারছে, যা সাধারণ মানুষের চিকিৎসাপ্রাপ্তির নাগালের বাইরেই রয়ে গেছে। একমাত্র জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনসটিটিউট ছাড়া সরকারি-বেসরকারি কোনো বিশেষায়িত ক্যান্সার সেবা প্রতষ্ঠিান গড়ে ওঠেনি। ক্যান্সার চিকিৎসা রাজধানীকেন্দিক হওয়ায় চিকিৎসার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে আসা রোগীদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় থাকতে হয়। উপরন্তু ক্যান্সার চিকিৎসা ব্যয়বহুল ও দীর্ঘমেয়াদি হওয়ায় আক্রান্ত রোগীর সামর্থ না থাকলেও বাধ্য হয়ে বিদেশি কিংবা বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে।
দক্ষিণ-র্পূব এশিয়ায় পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ক্যান্সার নির্ণয়ের এক বছরের মধ্যে শতকরা প্রায় পঁচাত্তর ভাগ রোগী মারা যায়। এমতাবস্থায়, দেশের অধিকাংশ মানুষের ভৌগোলিক ও আর্থিক সামর্থের নাগালের মধ্যে ক্যান্সার সেবা পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ প্রয়োজন। ক্যান্সার রোগীর সঠিক পরিসংখ্যান এবং জনগোষ্ঠিভিত্তিক বা পপুলশেনভিত্তিক ক্যান্সার রেজিস্ট্রির মাধ্যমে আক্রান্তের হার, মৃত্যুহারসহ গুরুত্বর্পূণ উপাত্ত পাওয়া সম্ভব, যা সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। ২০০৪ সালে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট হাসপাতালে ও ১৯টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ক্যান্সার নিবন্ধন কার্যক্রম স্বল্পপরসিরে শুরু হয়। কিন্তু জনগোষ্ঠীভিত্তিক ক্যান্সার নিবন্ধনের উদ্যোগ নেয়া ছাড়া উল্লিখিত তথ্য-উপাত্ত পাওয়া সম্ভব নয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্যান্সার চিকিৎসায় দেশব্যাপী চিকিৎসাসেবা ছড়িয়ে দেবার উদ্যোগ গ্রহণ করতে নির্দেশনা দিয়েছেন। নির্দেশনা বাস্তবায়নে উঠেপড়ে লেগেছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। ক্যান্সার চিকিৎসায় গুরুত্ব অনুধাবন করে দেশের ৮টি বিভাগেই ৮টি ১৫তলা বিশিষ্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পূর্ণাঙ্গ ক্যান্সার ইউনিট স্থাপনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। ক্যান্সারের পাশাপাশি সেখানে কিডনি, লিভার এবং ডায়ালাইসিস সুবিধা রাখার জন্যও আলাদা ব্যবস্থা রাখার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ক্যান্সার চিকিৎসায় আলাদা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। প্রকল্পের কাজ শেষ করা বা লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সময় নির্ধারণ করা হয় জুন ২০২২ পর্যন্ত। ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত বিশাল জনগোষ্ঠীকে চিকিৎসা সেবার আওতায় আনা; সূচনাতেই ক্যান্সার রোগ নির্ণয় এবং সময়মত ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা; ক্যান্সার চিকিৎসা সেবা সম্প্রসারণ ও বিকেন্দ্রীয়করণরে মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে চিকিৎসা সেবার আওতায় আনা; ক্যান্সার চিকিৎসা সেবায় বৈদেশিক নির্ভরতা কমিয়ে আনা, পক্ষান্তরে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করা; ক্যান্সার চিকিৎসার ক্ষেত্রে Out of Pocket Expenditure দেশে ক্যান্সার চিকিৎসা সেবা আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা এ প্রকল্পের লক্ষ্য।
লেখক: জ্যেষ্ঠ তথ্য কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।