Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

‘মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় বাংলাদেশে হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়েছে’

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:০১ এএম

রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া থেকে শুরু করে জিম্বাবুয়েতে আরোপ করা কূটনৈতিক নিষেধাজ্ঞার প্রভাব নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্ন রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশি অ্যাক্টিভিস্টদের কোনো সন্দেহ নেই যে, দুই মাস আগে যুক্তরাষ্ট্র শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার পর থেকে সেখানে বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে গেছে। বার্তা সংস্থা এএফপির এক প্রতিবেদনে এই কথা বলা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বিস্তারিত রেকর্ড রাখা মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের মতে, ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রায় ২,৫০০ বাংলাদেশি নাগরিক নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিহত এবং আরও কয়েকশ মানুষ জোরপূর্বক গুম হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। আরো বলা হয়, ‘অধিকার’ গত চার বছরে প্রায় ১,২০০ বা প্রতি মাসে গড়ে ২৫ টি মৃত্যুর ঘটনা রেকর্ড করেছে। কিন্তু তাদের মতে, ওয়াশিংটন গত ১০ ডিসেম্বর র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) এবং এর সাতজন শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ম্যাগনিটস্কি অ্যাক্ট এর আওতায় নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর আর কোনো হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেনি।
আট বছর আগে নিখোঁজ এক ব্যক্তির বোন এবং জোরপূর্বক গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার শত শত পরিবারের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ‘মায়ের ডাক’ এর সমন্বয়কারী আফরোজা ইসলাম আঁখি বলছিলেন, ‘এই নিষেধাজ্ঞাটা যদি অনেক আগেই দেয়া হত, তাহলে অনেকগুলো প্রাণ বাঁচানো যেত।’ মার্কসবাদী বিদ্রোহী এবং ইসলামপন্থী চরমপন্থা মোকাবিলার পাশাপাশি মানবপাচার রোধ করার জন্য ২০০৪ সালে র‌্যাব গঠন করা হয়েছিল। র‌্যাব তার লক্ষ্য নির্দয়ভাবে অনুসরণ করলেও এর কর্মকর্তারা একে কার্যকর বলে থাকেন। অতি সম্প্রতি এর লক্ষ্যবস্তু ছিল মূলত অভিযুক্ত অপরাধী এবং মাদক ব্যবসায়ীরা। কর্তৃপক্ষ জোরালোভাবে জানায় যে, কেবল আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বৈধ অপারেশনে গুলি বিনিময়ের সময়ই মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।

কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, রাজনৈতিকভাবে বিরোধী ব্যক্তিরাও নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে মারা গেছেন এবং নিহতদের ক্ষেত্রে আইনি প্রক্রিয়াকে অগ্রাহ্য করার জন্যই বন্দুকযুদ্ধের আয়োজন করা হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের ঠিক আগে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (বিএনপি) এর অন্তত ১৮ জন কর্মীকে র‌্যাব তুলে নিয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। তাদের মধ্যে আঁখির ভাই সাজেদুল ইসলাম সুমনও ছিলেন। আঁখি এএফপিকে বলেন, ‘আমার মা এক বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রতিদিন র‌্যাব সদর দফতরে যেতেন কারণ আমরা শুনেছিলাম যে র‌্যাব অফিসাররা তাকে আটক করেছে। কিন্তু ও আর ফিরে আসেনি।’

বাংলাদেশের শীর্ষ মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্র’ এর প্রধান নূর খান লিটন বলছেন, ‘মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় সরাসরি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। মানুষ এতে খুশি এবং অনেকেই কথা বলতে শুরু করেছেন।’ অ্যাক্টিভিস্টদের মতে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার প্রায় সকলকেই আটক করার পর গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। রিতা বেগম শেষবারের মতো তার ১৪ বছরের ছেলে রাকিব হাওলাদারকে ২০১৮ সালে পুরান ঢাকার একটি থানায় হাতকড়া পরানো অবস্থায় আটক থাকতে দেখেছিলেন। এর পরের দিন তার বাবা তাকে বলেন যে, মাদক চোরাচালানের দায়ে অভিযুক্ত ছেলেটিকে মারতে মারতে হত্যা করা হয় এবং তারপর গুলি করে দেখানো হয় যে সে গুলি বিনিময়ে মারা গেছে।

ওই নারী এএফপিকে বলেন, ‘তার শরীরের প্রত্যেকটা হাড় ভেঙ্গে দেয়া হয়। তারপর তাকে গুলি করা হয়। আমি কোনো বিচার পাইনি।’ তিনি জানান যে, তিনি অভিযোগ দায়েরের চেষ্টা করেছিলেন। তিনি বলেন ‘তখন পুলিশ আমার বাড়িতে আসে। তারা আমার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে আমাকে অনেকগুলো কাগজপত্রে সই করিয়ে নেয়। এমনকি তারা আমার মেয়েকে ধর্ষণের হুমকিও দেয়। আমি চাই আমেরিকান নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকুক। আমি চাই না, আর কোনো মা তার সন্তানকে হারাক। অন্য কারো কপাল যেনো আমার মতো না হয়। আমি আমার চোখের মণিকে হারিয়েছি।’

কিছু ক্ষেত্রে র‌্যাব অফিসারদের বিচার করা হয়েছে। ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের দায়ে র‌্যাবের একজন কমান্ডারসহ অন্তত ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। ঢাকা এবং ওয়াশিংটনের মধ্যে সাধারণত উষ্ণ সম্পর্ক বজায় থাকে। নিরাপত্তা ইস্যুতে সহযোগিতা ছাড়াও বাংলাদেশ প্রায়ই জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ভোট দিয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া নিষেধাজ্ঞার মধ্যে রয়েছে সম্পদ জব্দ করা এবং ভিসা না দেয়া। এগুলো র‌্যাব এবং বর্তমান বা সাবেক র‌্যাব কর্মকর্তাদের উপর আরোপ করা হয়েছে, যাদের মধ্যে র‌্যাবের সাবেক প্রধান বেনজির আহমেদ রয়েছেন যিনি এখন পুলিশ প্রধান হিসেবে কর্মরত।

এই পদক্ষেপ এমন এক সময়ে এসেছে যখন চীন এশিয়ার অন্যতম এই দরিদ্র দেশটিতে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করছে। এই পদক্ষেপ ঢাকাকে হতবাক করেছে। পররাষ্ট্রসচিব ‘অসন্তোষ’ জানাতে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তলব করেন। অস্ট্রেলিয়া ভিত্তিক বাংলাদেশি গবেষক মুবাশ্বার হাসান মনে করেন, নিষেধাজ্ঞাগুলো নিরাপত্তা বাহিনী এবং ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে ‘ট্যাক্টিকাল স্ট্রাইক’ তৈরি করেছে। তিনি বলছিলেন, এর মধ্য দিয়ে পুরো ‘সিকিউরিটি এস্টাবলিশমেন্ট’কে নতুন করে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণের আওতায় আনা হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশী কর্মকর্তাদের মধ্যেও উদ্বেগ বেড়ে গেছে যাদের কাছে অবসর গ্রহণের পর এবং প্রশিক্ষণের জন্য পশ্চিমা বিশ্ব জনপ্রিয় গন্তব্যস্থল। তিনি উল্লেখ করেন যে, বাইডেন প্রশাসন সে সমস্ত সরকারগুলোর সাথে যুক্ত ব্যবসাকে লক্ষ্যবস্তু করতে শুরু করেছে যেগুলো তাদের ভাষায় চীনের মতো মানবাধিকারকে দমন করে। তিনি বলেন, ‘ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত অনেক বাংলাদেশি ব্যবসায়ী নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন।’

মন্তব্যের জন্য র‌্যাব এবং পুলিশের কাছে এএফপি বারবার অনুরোধ করলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশ একথা অস্বীকার করে যে দেশটির কর্মকর্তারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা জোরপূর্বক গুমের সঙ্গে জড়িত। তবে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শাহাব এনাম খান বলেন, ‘আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা সংস্থাগুলোতে কর্মরত ব্যক্তিদের উপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা একটি শিক্ষা। সম্ভবত কেউই এর পুনরাবৃত্তি দেখতে চায় না।’ সূত্র : এএফপি।



 

Show all comments
  • shorif ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ৭:৩৫ এএম says : 0
    RAB,Police muloto birodhi doler birudhyei bebohar kora hoechhe.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ