Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ঢাবির ২৯ বিভাগে ধীরগতি

চ্যালেঞ্জের মুখে ‘লস রিকভারি প্ল্যান’ বাস্তবায়ন

রাহাদ উদ্দিন | প্রকাশের সময় : ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:০১ এএম

করোনা মহামারীর কারণে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এবং জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সময় সাশ্রয়ী কর্মসূচি হিসেবে ‘লস রিকভারি প্ল্যান’ প্রণয়ন করেছে। করোনা উত্তর শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা সচল রাখতে ও সেশনজট নিরসনে এই পরিকল্পনা হাতে নেয় বিশ্ববিদ্যালয়টি। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী যে বিভাগগুলোতে ৬ মাসে সেমিস্টার সেগুলোতে ৪ মাসে ও যেগুলোতে ১২ মাসে ইয়ার সেগুলোতে ৮ মাসে ইয়ার শেষ করার কথা রয়েছে। এছাড়াও ৬০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা ৩০ নম্বরে ও ১০০ নম্বরের পরীক্ষা ৫০ নম্বরে হওয়ার কথা রয়েছে এ পরিকল্পনায়।

বিভাগগুলো মৌলিক নির্দেশনাগুলো মানলেও মানছে না রেজাল্ট দেওয়ার সঠিক নিয়ম। ফলে শিক্ষার্থীদের মাঝে দেখা দিয়েছে অসন্তোষ। তাদের মতে, একাডেমিক কার্যক্রমে ধীরগতির কারণে ব্যাহত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের লস রিকভারি প্ল্যান। নিয়ম অনুযায়ী একটা সেমিস্টার শেষ হওয়ার পর দ্রুততম সময়ে রেজাল্ট প্রকাশ করে আরেকটা সেমিস্টারের ক্লাস শুরু করা হয়। কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে এমন অনেক বিভাগ রয়েছে যেগুলোতে ২টা সেমিস্টারের রেজাল্ট দেওয়া বাকি অথচ তৃতীয় আরেকটা সেমিস্টারের ক্লাস করানো হচ্ছে। এছাড়াও লস রিকভারি প্ল্যান অনুযায়ী পূর্বের তুলনায় স¦শরীরে ২ টা ও অনলাইনে ১ টা ক্লাস বেশি নেওয়ার নির্দেশ রয়েছে। কিন্তু এ নির্দেশনাও উপেক্ষা করছে বেশ কিছু বিভাগ।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, উদ্ভিদবিজ্ঞান, যোগাযোগ বৈকল্য, ভূগোল ও পরিবেশ, সমাজবিজ্ঞান, টেলিভিশন ফিল্ম ও ফটোগ্রাফি, ফিন্যান্স, ম্যানেজমেন্ট, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট, গণিত, লোক প্রশাসন, রসায়ন, পরিসংখ্যান, মৃত্তিকা-পানি ও পরিবেশ, ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট, আধুনিক ভাষা শিক্ষা ইনস্টিটিউট এর অধীনে জাপানিজ ভাষা ও সংস্কৃতি, ফারসি ভাষা ও সংস্কৃতি, চিনা ভাষা ও সংস্কৃতি এবং ইংলিশ স্পিকার ফর অ্যাদার লাংগুয়েজ বিভাগে ২০২০ সালে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরা ২০২২- এ এসেও প্রথম বর্ষেই রয়ে গেছে। কিছু বিভাগে ২০২০ সালে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরা ২০২২-তেও একই বর্ষে রয়েছে।

এছাড়াও দুইটা সেমিস্টারের পরীক্ষা শেষ করে তৃতীয় আরেকটা সেমিস্টারের ক্লাস নিচ্ছেন অথচ একটা সেমিস্টারেরও রেজাল্ট দেওয়া হয়নি এমন বিভাগ রয়েছে প্রায় ১৩টি। বিভাগগুলো হলো- বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি, আরবি ভাষা ও সাহিত্য, একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস, শিক্ষা ও গবেষণা, ম্যানেজমেন্ট, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, মার্কেটিং, ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমস, ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজম্যান্ট, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য, ইংলিশ স্পিকার ফর অ্যাদার ল্যাংগুয়েজ ও ফলিত গণিত বিভাগ। এছাড়াও বেশ কিছু বিভাগে এক সেমিস্টারের ফাইনাল পরীক্ষা নেওয়ার পূর্বে আরেকটা সেমিস্টারের মিড ও একইসাথে তৃতীয় আরেকটা সেমিস্টারে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে এমন অভিযোগও রয়েছে শিক্ষার্থীদের।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সমাজকল্যাণ বিভাগের ২০১৯-২০ সেশনে যারা প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছিল তারা ২০২২-এ এসেও প্রথম বর্ষেই রয়ে গেছে। শিক্ষার্থীরা জানান, এখানকার শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের নিয়ে ভাবেন না। তারা শিক্ষার্থী বান্ধব না। তাই অন্যান্য বিভাগে প্রথম বর্ষ শেষ করে দ্বিতীয় বর্ষে ক্লাস করা শিক্ষার্থীদের বন্ধু-বান্ধবরাই এ বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী, তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা দ্বিতীয় আর চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীরা এ বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। জানা যায়, বিভাগটিতে দ্বিতীয় সেমিস্টার পরীক্ষা চলমান অবস্থায় গত ২১ জানুয়ারি স¦শরীরে ক্লাস পরীক্ষা বন্ধ করে বিশ্ববিদ্যালয়। তবে অনলাইনে কিংবা কোন বিভাগ চাইলে স¦শরীরেও পরীক্ষা নিতে পারবেন বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তা সত্ত্বেও মাত্র ২টা কোর্সের পরীক্ষা আঁটকে রেখে শিক্ষার্থীদের একটা দোটানায় ফেলে রেখেছে বিভাগটি।

ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী সোহাগ হোসেন জানান, ২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর ষষ্ঠ সেমিস্টার শেষ হলেও গত এক মাসের বেশি সময়ে সর্বসাকুল্যে ১০ টি ক্লাস নিয়েছে বিভাগটি। নাহিদ হাসান নামে বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ৩য় ও ৪র্থ সেমিস্টারের রেজাল্ট বাকি, ৫ম সেমিস্টারের ক্লাস শুরু হলেও বেশিরভাগ শিক্ষকই ক্লাস নিচ্ছেন না।

২ বছর ধরে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে আছে উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থীরা। ২০২০, ’২১ ও ’২২ সাল পর্যন্ত একটানা তিন বছর ধরে তৃতীয় বর্ষে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগের শিক্ষার্থীরা। ফাইনাল তো দূর তারা এখনো মিড দিতে পারেনি বলে জানা যায়। বিভাগটিতে ’১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থীরা এখনো দ্বিতীয় বর্ষে আর ’১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থীরা আছে প্রথম বর্ষে।

টেলিভিশন ফিল্ম অ্যান্ড ফটোগ্রাফি বিভাগের ’১৭-১৮ সেশনের এক শিক্ষার্থী বলেন, আমার এখন মাস্টার্সে থাকার কথা অথচ এখনো থার্ড ইয়ারে পড়ে আছি। ৫ম সেমিস্টার রেজাল্ট হয়নি এখনো। বিশ্ববিদ্যালয় ৪ মাসে সেমিস্টার শেষ করতে বললেও যথাসময়ে সেমিস্টার শেষ করছে না বিভাগটি। সপ্তাহে একটা ক্লাস নেওয়ার কথা থাকলেও নিয়মিত ক্লাস নিচ্ছেন না চেয়ারম্যান হাবিবা রহমান।
১ বছরের এমবিএ প্রোগ্রাম ৩ বছর ধরে চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগে। বিভাগটির ’১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থীরা জানান তাদের এই এমবিএ শেষ করতে আরো ১ বছর লাগতে পারে।

২০২১ সালের ২৫ নভেম্বর অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলেও এখনো পর্যন্ত রেজাল্ট দিচ্ছে না রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ। নানামুখী হতাশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বিভাগের শিক্ষার্থীরা। পরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান ও অফিস সূত্রে জানা যায়, ফেব্রুয়ারী মাসের শেষ অথবা মার্চের পহেলা সপ্তাহে এ রেজাল্ট দেওয়া হবে।

মোটামুটি সব ব্যাচেরই একাডেমিক কার্যক্রম ধীর গতিতে আগাচ্ছে বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষার্থীরা। সামান্য একটা রিপোর্ট জমা দেয়ার কারণে একটা ব্যাচের প্রোমোশনও আটকায়ে রেখে দিয়েছে। তাছাড়া এই ডিপার্টমেন্টের ধীর গতিতে চলার প্রবনতার কারণে এক ব্যাচকে প্রায় দেড় বছর পরে অনার্স শেষ করে বের হতে হয়েছে বলে জানা যায়।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি (শিক্ষা) ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আমরা যে ‘লস রিকভারি প্ল্যান’ হাতে নিয়েছে এটা আসলে অনেকটাই সক্ষমতার বিষয়। কোনো কোনো বিভাগ বা ইনস্টিটিউটের সক্ষমতা বেশি আবার কোনটার কম। এগুলো আমরা কেন্দ্রীয়ভাবে মনিটরিং করছি এবং প্রাপ্ত তথ্যের উপর ভিত্তি করে এগুলোকে যাতে করে গতিশীল করতে পারি, পরীক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে, ফলাফল পাওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের যে ক্ষতিটা হয়েছে তা পুষিয়ে নিতে আমরা অতি সত্বর একটা ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একটা সেমিস্টার রেজাল্ট দেওয়ার আগে আরেকটা সেমিস্টারে ক্লাস শুরু করার আসলে কোন নিয়ম নেই, কিন্তু করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আমরা বিভাগগুলোকে এ অনুমতি দিয়েছি। তবে টানা দুই সেমিস্টারের রেজাল্ট বাকি রেখে তৃতীয় আরেকটা সেমিস্টারে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে, এটা স্বাভাবিক নয়। এ বিষয়ে আমরা খোঁজখবর নিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিব।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ঢাবি


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ