চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
বন্ধুত্ব ও ভালবাসা আল্লাহ তায়ালার একটি বিশেষ নিয়ামাত, যা তিনি সমগ্র সৃষ্টিকুলের হৃদয়ের মাঝে প্রদান করেছেন। রূহ-এর জগতেও এর অস্তিত্ব বিদ্যমান। এর মাধ্যমেই সৃষ্টিলগ্ন থেকে সমগ্র মাখলুক বিশ্ব জগতে আজও টিকে আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকবে। কিন্তু মানব জাতির মাঝে আল্লাহ তা’য়ালা বন্ধুত্ব ও ভালবাসার একটি সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এই সীমারেখা মেনে চলার মাঝেই নিহিত রয়েছে মানব জাতির অস্তিত্ব, মানব সমাজের সৌন্দর্য্য, মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশ, ইহকালীন কল্যান ও পরকালীন নাজাত।
মানুষের মাঝে এই নিয়ামাতের স্মরণ করিয়ে দিয়ে মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেন : তোমরা ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জু (ইসলাম ও কুরআন)-কে আঁকড়ে ধর এবং ভিন্ন ভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ো না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর নিয়ামাতের কথা বিশেষভাবে স্মরণ কর! যখন তোমরা ছিলে পরস্পরের শত্রু তখন আল্লাহ তোমাদের মনের মধ্যে ভালবাসা তৈরি করে দিলেন আর তাঁর অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই-ভাই হয়ে গেলে। তোমরা তো ছিলে আগুনের গর্তের কিনারে, আর আল্লাহ সেখান থেকে তোমাদেরকে রক্ষা করেছেন। এভাবেই আল্লাহ তোমাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ বর্ণনা করেন, যেন তোমরা হিদায়াত লাভ কর। (সূরা আলে-ইমরান : ১০৩)।
যারা আল্লাহ তা’য়ালা এবং তাঁর রসূলের উপর বিশ্বাসী তারা শুধুমাত্র হৃদয়ের আবেগে বা নাফসের কামনা-বাসনায় বা জৈবিক লালসায় বন্ধুত্ব ও ভালবাসার লাগামহীন পথে পা বাড়ায় না, বরং তারা জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ সর্বদা আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা মেনে চলেন। প্রকৃত মুমিনের বন্ধুত্ব ও ভালবাসা শুধুমাত্র আল্লাহ তায়ালা, তাঁর রসূল ও প্রকৃত মুমিনের জন্যই নির্ধারিত। এ প্রসংগে আল্লাহ তায়ালা বলেন : তোমাদের বন্ধু তো আল্লাহ, তাঁর রসূল এবং যারা ঈমান এনেছে তারা, যারা বিনীত ভাবে রুকূর সাথে সালাত কায়িম করে এবং যাকাত আদায় করে। যারা আল্লাহ, তাঁর রসূল এবং মুমিনদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে নিশ্চয়ই তারাই হবে আল্লাহর দল, তারাই বিজয়ী হবে। (সূরা মায়েদা : ৫৫-৫৬)।
আল্লাহর অভিভাবকত্ব ও বন্ধুত্ব প্রসংগে তিনি বলেন : যারা ঈমান এনেছে আল্লাহ তাদের অভিভাবক ও বন্ধু। আল্লাহ তাদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোর দিকে পরিচালিত করেন। আর যারা কুফরি করে তাদের অভিভাবক ও বন্ধু হল তাগুত। তারা তাদেরকে আলো থেকে বের করে অন্ধকারের দিকে পরিচালিত করে। তারাই জাহান্নামের অধিবাসী এবং সেখানে তারা চিরদিন থাকবে। (সূরা বাকারাহ : ২৫৭)। রসূলুল্লাহ্ সল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ভালবাসা প্রসংগে তিনি বলেন: তোমাদের নিকট তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রাসূল এসেছেন। তোমাদেরকে যা বিপদগ্রস্ত করে তা তাঁর জন্য কষ্টদায়ক। তিনি তোমাদের কল্যাণকামী। মুমিনদের প্রতি তিনি অত্যন্ত দয়ালু, পরম করুণাময়। (সূরা তওবা : ১২৮)।
মুমিনদের বন্ধুত্ব প্রসংগে তিনি বলেন : মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী একে অপরের অভিভাবক ও বন্ধু। তারা ভাল কাজের আদেশ দেয়, খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে, সালাত কায়িম করে, যাকাত আদায় করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে। আল্লাহ তাদের প্রতি অচিরেই রহমত নাযিল করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাপরাক্রশালী, মহাপ্রজ্ঞাময়। আল্লাহ মুমিন পুরুষ ও নারীদের জন্য এমন জান্নাতের অঙ্গীকার করেছেন যে জান্নাতের নিচ দিয়ে ঝর্ণাসমূহ বয়ে যায়। সেখানে তারা চিরদিন থাকবে। আল্লাহ তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দেন মহাপবিত্র স্থায়ী বাসস্থান আদন নামক জান্নাতের। বস্তুত আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই সর্বশ্রেষ্ঠ এবং এটাই সবচেয়ে বড় সফলতা। (সূরা তওবা : ৭১-৭২)।
যারা আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলের বিরোধিতা করে, নায়েবে রসূল ওলামায়ে কেরামগণের সাথে শত্রুতা পোষণ করে, কুরআনের বিধান ও রসূলের আদর্শকে অপছন্দ করে- এসব লোকদের সাথে প্রকৃত মুমীনগণ কখনও বন্ধুত্ব স্থাপন করেন না। এসব লোক তাদের পিতা, ভাই, পুত্র, আত্মীয়-স্বজন বা অন্য কোন ঘনিষ্টজন হলেও তাদের সাথে কোন ভালবাসা পোষণ করেন না। এসব লোক অমুসলিম নামধারীও হতে পারে বা মুসলিম নামধারীও হতে পারে। মুসলিম নামধারী হলেও আল্লাহ তায়ালার দরবারে তারা মুসলিম হিসাগে গণ্য নয়।
এ প্রসংগে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন : আপনি মুমিনদের এমন কোন দল পাবেন না, যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে এবং আখিরাতের প্রতিও ঈমান রাখে- অথচ তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতাকারীদেরকে ভালবাসে, যদিও তারা তাদের পিতা, তাদের পুত্র, তাদের ভাই বা তাদের আত্মীয়-স্বজনও হয়। আল্লাহ তাদের অন্তরে ঈমানকে সুদৃঢ় করে দিয়েছেন এবং নিজের পক্ষ থেকে তাদেরকে রূহ (হিদায়াতের আলো)। দিয়ে শক্তিশালী করেছেন। তিনি তাদেরকে এমন জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যে জান্নাতের নিচ দিয়ে ঝর্ণাসমূহ বয়ে যায়, সেখানে তারা চিরদিন থাকবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন, তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। তারাই আল্লাহর দল। মনে রেখ! আল্লাহর দল অবশ্যই কল্যাণপ্রাপ্ত হবে। (সুরা মুজাদালা : ২২)।
তিনি আরও বলেন : হে মুমিনগণ! তোমাদের মাতা-পিতা ও তোমাদের ভাইয়েরা যদি ঈমানের উপর কুফরিকে প্রাধান্য দেয় তাহলে তাদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ কর না। তোমাদের মধ্যে যারা তাদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে, তারা হবে সীমালংঘনকারী।
আপনি বলুন : তোমাদের মাতা-পিতা, তোমাদের সন্তান-সন্ততি, তোমাদের ভাইগণ, তোমাদের স্ত্রীগণ, তোমাদের জ্ঞাতিগণ, তোমাদের উপার্জিত অর্থ-সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা- তোমরা যার মন্দার ভয় কর এবং তোমাদের বাসস্থান-যা তোমাদের নিকট অত্যন্ত পছন্দ; এসব যদি তোমাদের নিকট আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করার চেয়ে প্রিয় হয় তাহলে আল্লাহর পক্ষ থেকে (শাস্তির)। হুকুম আসার অপো কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ পাপাচারী জাতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন না। (সূরা তওবা : ২৩-২৪)।
কোন কাফির, মুশরিক, মুনাফিক, ইহুদী, নাসারা, নামধারী মুসলিম ও জালিমের সাথে প্রকৃত মুমিনের কোন আন্তরিক ভালবাসা হতে পারে না। যদি কোন মুসলিম তাদের সাথে আন্তরিক বন্ধুত্ব স্থাপন করে তাহলে আল্লাহর সাথে তার কোন সম্পর্ক থাকবে না, বরং সে আল্লাহর দরবারে তাদেরই দলভূক্ত বলে গন্য হবে। তবে কোনরুপ দুনিয়াবী ক্ষতির আশংকা থাকলে সেক্ষেত্রে বাহ্যিক সতর্কতা অবলম্বন দোষনীয় হবে না। এ প্রসংগে আল্লাহ তায়ালা বলেন : মুমিনগণ যেন মুমিনগণকে বাদ দিয়ে কোন কাফিরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ না করে। যে মুমিনকে বাদ দিয়ে কাফিরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে তার সাথে আল্লাহর কোন সম্পর্ক থাকবে না। তবে তোমরা যদি তাদের নিকট থেকে কোনরূপ ক্ষতির আশংকা কর, তার কথা স্বতন্ত্র। আল্লাহ তাঁরই সম্পর্কে তোমাদেরকে সতর্ক করছেন। আর আল্লাহর নিকটই ফিরে যেতে হবে। (সূরা আলে ইমরান : ২৮)।
তিনি আরও বলেন : হে মুমিনগণ! তোমরা তোমাদের নিজেদেরকে ছাড়া অন্য কাউকে ঘনিষ্ঠতম বন্ধু হিসেবে গ্রহণ কর না। কেননা অন্যরা তোমাদের ক্ষতি করতে দ্বিধা করে না এবং যা তোমাদেরকে কষ্ট দেয় তারা তাই কামনা করে। তাদের মুখ থেকে কখনো কখনো বিদ্বেষ প্রকাশ পায়, কিন্তু তাদের মনে যা গোপন রয়েছে তা আরো ভয়ঙ্কর। আমি তোমাদের জন্য আয়াতসমূহ বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করছি, যেন তোমরা বুঝতে পার। (মুমিনগণ!)। তোমরা এমন যে, তোমরাই তাদেরকে ভালবাসো, কিন্তু তারা তোমাদেরকে ভালবাসে না। আর তোমরা কিতাবের প্রতিটি বিষয়ে ঈমান রাখ। তারা যখন তোমাদের সংস্পর্শে আসে, তখন তারা বলে, আমরা ঈমান এনেছি। আর যখন তারা একান্তে মিলিত হয় তখন তোমাদের প্রতি আক্রোশে নিজেদের আঙুলের মাথা কামড়াতে থাকে। বলুন (হে রাসূল!)।, তোমরা মরো তোমাদের আক্রোশেই। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের অন্তরে যা আছে সে সম্পর্কে সবকিছুই জানেন। যদি তোমাদের ভাল কোন কিছু হয় তাহলে তা তাদেরকে কষ্ট দেয় আর তোমাদের যদি খারাপ কিছু হয় তাহলে তারা তাতে আনন্দিত হয়। যদি তোমরা ধৈর্যশীল ও মুত্তাকী হও, তাহলে তাদের ষড়যন্ত্র তোমাদের কোন ক্ষতিই করতে পারবে না। তারা যা করে নিশ্চয়ই আল্লাহ তা পরিবেষ্টন করে রেখেছেন। (সূরা আলে-ইমরান : ১১৮-১২০)।
তিনি আরও বলেন : হে মুমিনগণ! তোমরা মুমিনদের বাদ দিয়ে কাফিরদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ কর না। তোমরা কি তোমাদের নিজেদের বিরুদ্ধে আল্লাহর নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত করতে চাও? নিশ্চয়ই জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে হবে মুনাফিকদের অবস্থান, আর আপনি তাদের জন্য কোন সাহায্যকারী পাবেন না। তবে যারা তওবা করে, আত্মশুদ্ধি করে, আল্লাহকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করে এবং আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠভাবে দ্বীনে সুপ্রতিষ্ঠিত থাকে, তারা মুমিনদের সাথেই থাকবে। আর আল্লাহ মুমিনদেরকে শীঘ্রই মহাপুরস্কার প্রদান করবেন। (সূরা নিসা : ১৪৪-১৪৬)।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।