চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
শপথের আরবী শব্দ হলো বাইয়াত অর্থাৎ কোন কাজ করা বা না করার প্রতি দৃঢ় অঙ্গিকারবদ্ধ হওয়া। ইসলামের ইতিহাস থেকে জানা যায়, মুসলমানরা রাসুল সা.এর কাছে তিন ধরনের শপথ গ্রহন করেছে, ১. মাতৃ শপথ। ২. রাজনৈতিক শপথ। ৩. চুড়ান্ত শপথ। সকলের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, তখন মুসলমানরা রাসুল সা. এর কাছে শপথ নিয়েছে এখন আমরা কার কাছ থেকে শপথ নিবো? । বর্তমানে বাইয়াত দুইভাবে নেওয়া যায় (১) কোন ব্যক্তির কাছ থেকে যিনি শরিয়তের সকল বিষয় জানেন এবং মানেন (২) কোন ইসলামী সংগঠন থেকে যা কোরআন ও সুন্নাহর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত, মানুষ শপথ গ্রহন দ্বরা দুটি জিনিস রক্ষার জন্য অকাতরে জীবন দিতেও দিধাবোধ করেনা, তা হলো নিজের মাতৃভূমি এবং ধর্ম। যেই কোন কাজ, সংগ্রাম, আন্দোলন সাফল্যের জন্য শপথবদ্ধ হওয়া ছাড়া কোন বিকল্প নাই। শপথের মাধ্যমে ইসলামের সাফল্য নিম্নোক্ত তুলে ধরা হলো।
১. আকাবার প্রথম শপথ যার অপর নাম মাতৃ শপথ : আকাবা বলা হয় সংকীর্ণ গিরিপথ কে যা মক্কা থেকে মিনায় আসার পথে মিনার পশ্চিম পাশে একটি পাহাড়ের সংকীর্ণ গিরিপথ যা আকাবা নামে পরিচিত। ( আর রাহীকুল মাখতুম : পৃ. ১৮৫)। মাতৃশপথ নামে নামকরণের কারন হলো, এই বায়য়াত শুধু বিষয়ে অংগীকার গ্রহন করা হয় কোন যুদ্ধ বিগ্রহের বিষয় এতে অন্তর্ভুক্ত ছিলনা ( মানবতার বন্ধু মুহাম্মদ সা. : পৃ. ১৯১)।
আকাবা নামক স্থানে নবওয়তের দশম বছরে হজ্জের মওসুমে মদিনা থেকে ৬ জন ইসলাম গ্রহন করে ছিলেন। তারা আল্লাহর রাসুলের সাথে বায়য়াত গ্রহন করেন, যে তারা মদিনায় গিয়ে রাসুল সা. এর রিসালাতের তাবলীগ করবেন, ছয় জন মিলে সিদ্ধান্ত নিলো আমাদের কওমে বিশৃঙ্খলা বন্ধ ও ঐক্য তৈরির লক্ষ্যে মুহাম্মদের দাওয়াতের বিকল্প নাই। এই ছয় ব্যক্তিবর্গ মদিনায় ফিরে যাওয়ার পর তারা সেখানে নতুন জাগরন সৃষ্টি করেন। সেখানে ইসলামের দাওয়াত জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং ব্যাপক বিস্তার লাভ করতে থাকে। আনসারদের পরিবারগুলোর মধ্যে কোন পরিবারই বাদ ছিলনা, সেখানে মুহাম্মদ সা. সম্পর্কে আলাপ আলোচনা হয়না। নবুয়তের দ্বাদশ বছরে ১২/১৩ জন মদিনা থেকে এসে রাসুলের কাছে এই মর্মে বায়য়াত গ্রহন করেন, যা কোরআনে উল্লেখ রয়েছে।
হে নবী! ঈমানদার নারীরা যখন তোমার কাছে এসে আনুগত্যের শপথ করে যে, তারা আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করবে না, চুরি করবে না, ব্যভিচার করবে না, তাদের সন্তানদেরকে হত্যা করবে না, জারজ সন্তানকে স্বামীর ঔরস থেকে আপন গর্ভজাত সন্তান বলে মিথ্যা দাবী করবে না এবং ভাল কাজে তোমার অবাধ্যতা করবে না, তখন তাদের আনুগত্য গ্রহণ কর এবং তাদের জন্যে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল অত্যন্ত দয়ালু। (সূরা আল মুমতাহিনা : ১২)। রাসুল সা. মদিনার এই দলটিকে কোরআন ও ইসলামের শিক্ষা দানের জন্য মুসয়াব বিন উমাইরকে নিযুক্ত করেন, তিনি এর সাথে সেখানে তাদের নামাজের ইমামতি ও দাওয়াতী কাজও আনজাম দিতেন।
২. শপথকারীদের দাওয়াতের সাফল্য : একদিন হযরত মুসয়াব বিন উমাইর যে বাড়ীতে থাকতেন সে বাড়ীর মালিক আসাদ বিন যারারা উভয়ে দাওয়তী কাজের জন্য বের হলেন, বনু আব্দুল আশহাল ও বনু যফর গোত্রের দিকে তাদের দাওয়াত দেখে গোত্রের দুই সরদার ক্ষেপে গেলেন, কথাতো থাক দূরের কথা রেগে অবস্থা খারাপ যেহেতু শপথকারীরা ওয়াদা করেছেন যেই কোনভাবে রাসুলের দাওয়াত কওমে পৌঁছে দিবেন। তারাও সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, মুসয়াব বিনম্র ভাষায় বললেন, আপনি একটু মনোযোগ দিয়ে আমাদের কথা শুনুন। শুনার পর ভালো লাগলে গ্রহন করবেন না হয় মূখ ফিরিয়ে নিবেন, কওমের নেতা উসাইদ একটু শান্ত হলো। মুসয়াব আলোচনা শুরু করলেন এবং কোরআন পড়ে শুনালেন, তারা উসাইদ কে কিছু বলার আগে তিনি ইসলাম গ্রহনের প্রতি সম্মতি প্রকাশ করলেন। এবং ইসলাম গ্রহন করলেন, সাথে আমার একজন বন্ধু আছে সে এলাকার সরদার তার কথা সবাই শুনে দৌড়ে তাকে ডেকে আনলেন ইসলামের মহান বানী শুনালেন, কিছু বলার আগে তার বন্ধু সাদ বিন মুয়ায ইসলাম গ্রহন করার সম্মতি প্রকাশ করেন। এবং ইসলাম গ্রহন করেন, তিনি যখন তার গ্রামে যায় লোকেরা দূর থেকে বলতে লাগলো, সাদের চেহারা বদলে গেছে এসে সাদ বললেন হে’ আব্দুল আশহাল গোত্রের জনমন্ডলী, আমার সম্পর্কে তোমাদের মত কি? সবাই বললো, তুমি আমাদের সরদার। তোমার মতামত আমাদের মতামতের চেয়ে পরিপক্ব, সাদ বললেন, তা হলে শুনে রাখ, তোমরা যতক্ষণ আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের উপর ঈমান না আনবে, ততক্ষণ তোমাদের নারী ও পুরুষদের সাথে কথা বলা আমার উপর হারাম। এর পর সমগ্র গোত্রের নারী ও পুরুষেরা এক যোগে ইসলাম গ্রহন করলো। এই নেতার মাধ্যমে যখন ইসলামী আন্দোলনের শক্তি প্রভুতি বৃদ্ধি পেল, তখন দাওয়াতী অবিযান ও জোরদার হলো এবং ঘরে ঘরে ও গোত্রে গোত্রে ইসলাম ছড়িয়ে পড়লো।( মানবতার বন্ধু মুহাম্মদ সা.- ১৯২)
আকাবার দ্বিতীয় শপথ : নবুওয়াতের ত্রয়োদশ বর্ষে ৬২২ ঈসায়ী সালের জুন মাসে মদিনা থেকে ৭০ জন মুসলমান হজ্জ পালনের উদ্দেশ্যে মক্কায় আসেন। সকলের মনে ছিল অন্যরকম এক আনন্দ প্রিয় নবীর সাথে সাক্ষাৎ হবে, তারা আলাচোনা শুরু করলেন, রাসুল সা. এভাবে মক্কায় আর কতদিন থাকবে, যেই কোনভাবে রাসুলকে মদিনায় নিয়ে যেতে হবে। এরি প্রেক্ষিতে ১২ই জিলহজ্জ আকাবা নামক স্থান সমাবেশের সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়।
সেদিন মোট ৭৫ জন ব্যক্তি মিটিং এ অংশ নেন তাদের ভিতর ৭৩ জন পুরুষ ২জন মহিলা ছিলেন, সকলেই রাসুলের জন্য অপেক্ষা করছেন, তিনার সাথে চাচা আব্বাস রাযি. উপস্থিত হলেন। তিনি তখন ইসলাম গ্রহন করেননি তার পরেও তিনার হিতাকাঙ্ক্ষী ছিলেন, প্রথমে সমাবেশে চাচা বক্তব্য রাখেন , তিনি বর্তমান ও ভবিষ্যতের বিষয় নিয়ে বক্তব্য দেন, তার পর রাসুল সা. বক্তৃতা শুরু করেন প্রথমে কোরআন তেলাওয়াত করলেন, আল্লাহর আনুগত্যের প্রতি দাওয়াত দিলেন, এর পর বাইয়াত হল। উপস্থিত জনতা বলে উঠলো ইয়া রাসুলুল্লাহ আমারা কি কি বিষয় আপনার কাছে বাইয়াত করবো? তিনি বললেন নিম্নোক্ত বিষয়ের উপর। ১. ভালো মন্দ সকল অবস্থায় আমার কথা শুনবে এবং মানবে। ২. সচ্ছলতা অসচ্ছলতা উভয় অবস্থায়ই ধন-সম্পদ ব্যয় করবে। ৩. সৎ কাজের আদেশ দিবে এবং অসৎ কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখবে। ৪. আল্লাহর পথে উঠে দাড়াবে এবং আল্লাহর আল্লাহর ব্যাপারে কারো ভয়ভীতি প্রদর্শনে পিছিয়ে যাবেনা। ৫. তোমাদের কাছে যাওয়ার পর আমাকে সাহায্য করবে এবং নিজেদের প্রান ও সন্তানদের হেফাজতের মতোই আমার হেফাজত করবে। এতে তোমাদের জন্যে জান্নাত রয়েছে।
উপস্থিত প্রতিনিধি দলের সদস্যরা বাইয়াতের জবাব দিলেন : আমরা আমাদের সমস্ত সহায় সম্পদ ধ্বংস এবং আমাদের গোত্র প্রতিদের হত্যার বিনিময়ে হলেও আপনার সাহায্য সহযোগিতা অব্যাহত রাখবো বলে অঙ্গিকার করছি। এই বায়য়াতের বিশেষ কারনে এর নাম হয়ে গেলো ‘বায়য়াতুল হারব’ বা ‘সামরিক অংগীকার’। এই বায়য়াতকে ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তিপ্রস্তরও বলা হয়। বায়য়াত সম্পন্ন করার পর রাসুল (সা.) বারো জনকে নকীব বানানোর প্রস্তাব দিলেন, তারা এই বায়য়াত নিজেদের গোত্রে বাস্তবায়ন করবে। তাঁর একথা বলার কিছুক্ষণের মধ্যে ১২জন নকীব মনোনিত করলেন। এদের মধ্যে ৩জন আওস ও ৯জন খাযরাজ গোত্রের ছিলেন। এখান থেকে মদিনাকে কল্যানকর ও সুখী সমৃদ্ধি রাষ্ট্র পরিনতি করার দৃঢ় সংকল্প শুরু হয়। (আর রাহীকুল মাখতুম : পৃ. ১৮৮-৯৫)।
৩. চুড়ান্ত শপথ ও বিজয়ের লক্ষন : রাসুল (সা.) ৬ ষষ্ঠ হিজরত ১৪০০ সাহাবী নিয়ে হজ্জ করার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে, হুদায়বিয়ায় পৌঁছে উসমান (রা.) কে কাফেরদের নিকট প্রেরণ করেন এ বার্তা দিয়ে যে, তুমি তাদেরকে বলবে। এবছর আমি শুধু ওমরা করে চলে যাব যুদ্ধ-বিগ্রহ করবো না আর দুর্বল মনা মুসলমানদেরকে বলে দিও যে, ইনশাআল্লাহ অচিরেই মক্কা বিজয় হবে। উসমান (রা.) তিনি তার বিশ্বস্ত ব্যক্তি আবান ইবনে সাঈদ এর মাধ্যমে মক্কায় প্রবেশ করেন। তিনি যখন কাফেরদেরকে একথা জানালেন যে,রাসুল সা. এবছর শুধু ওমরা করে চলে যাবেন যুদ্ধ-বিগ্রহ করবেন না তখন তারা একবাক্যে সকলে না বলে দিল।
এবং তারা বলল তুমি চাইলে ওমরা করতে পারো কিন্তু উসমান (রা.) উত্তর দিলো রাসুল (সা.) কে ছাড়া কখনোই আমি ওমরা করব না। অত:পর তারা তাকে আটকে রাখলো আর এদিকে গুজব ছড়িয়ে গেল যে তারা উসমান (রা.) কে হত্যা করে ফেলেছে। এ সংবাদ যখন রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কর্ণকুহরে পৌঁছে ছিল তখন তিনি অনেক কষ্ট পান এবং সকল সাহাবীদের কে নিয়ে বাবলা গাছের নিচে বায়াত গ্রহণ করেন যে, ওসমানের হত্যার প্রতিশোধ নেওয়া পর্যন্ত আমরা লড়াই চালিয়েই যাব। হুযুর (সা.) উসমান (রা) এর হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য, বাবলা গাছের নিচে বসে সাহাবীদের থেকে যে জিহাদের বায়আত গ্রহণ করেছিলেন তাকেই বায়আতে রিদওয়ান বলা হয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।