চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
নামায ফার্সি শব্দ, এর আরবি হলো সালাত। এর আভিধানিক অর্থ: প্রার্থনা, সান্নিধ্য, দুআ ইত্যাদি। ইসলামের পাচঁটি স্তম্ভর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সালাত। ঈমানের পরেই সালাতের মর্যাদাগত অবস্থান। রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে এ সম্পর্কে ইরশাদ করেছেন: বলুন আমার বান্দাদেরকে, যারা ঈমান এনেছে তারা যেন সালাত প্রতিষ্ঠা করে এবং আমি যা তাদেরকে দান করেছি তা হতে ব্যয় করে। ইসলামী শরীআতের পরিভাষায় নামায বলা হয়- রুকু, সিজদাসহ নির্দিষ্ট আহকাম সম্বলিত এমন বিশেষ ইবাদত অনুষ্ঠানকে যার মাধ্যমে বান্দা ও স্রষ্টার মাঝে সুনিবিড় সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। দৈনিক পাচঁ ওয়াক্ত নামায প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্ক নর-নারী মুসলিমের ওপর আদায় করা ফরয।
সালাতের অনেক উপকারিতা রয়েছে, যা বলে শেষ করার মতো নয়। সালাতের মূল উপকারিতা হচ্ছে, অন্যায় ও অশ্লীলতা থেকে মানুষকে বিরত রাখা। এ ব্যাপারে মহাগ্রন্থ পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন : নিশ্চয় সালাত অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখে। তারপর তিনি তার সন্তানদের সালাতের প্রতি আকর্ষণ তৈরী হওয়ায় জন্য মুসলিম শরীফের সেই হাদিসে মোবারকা বর্ণানা করেন। হযরত আবু হোরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, যদি কোনো ব্যক্তি পাচঁ ওয়াক্ত নামায ও প্রতিটি জুমার নামায রীতিনীতি আদায় করে এবং প্রতি বছর রমযানের রোযাগুলো যথাযথভাবে পালন করে, তাকে আল্লাহ তায়ালা এক নামায হতে অপর নামায, এক জুমা হতে অপর জুমা এবং এক রমযান হতে অপর রমযানের মধ্যকার সময়ে সংঘটিত যাবতীয় গুনাহ ক্ষমা করে দেন। তবে শর্ত হলো তাকে কবীরা গুনাহ থেকে বিরত থাকতে হবে। কেননা আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- তোমরা যদি নিষেধাজ্ঞাসমূহের পাশাপাশি কবীরা গুনাহ থেকে বিরত থাক, তবে আমি তোমাদের সগীরা গুনাগুলো মিটিয়ে দেব। সুতরাং সগীরা গুনাহ থেকে ক্ষমালাভের জন্য আমাদের উচিত কবীরা গুনাহ থেকে বিরত থেকে যথাযথভাবে পাচঁ ওয়াক্ত নামায, জুমা ও রমযানের রোযাগুলো পালন করা। এ মূল উপকারিতা অর্জনের পাশাপাশি সালাতের মাধ্যমে অনেক বৈষয়িক উপকারিতা ও অর্জিত হয়ে থাকে। যেমন :
১. মুসলিম ঐক্য: নামায মুসলিম ঐক্যের এক শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। মুসলমানগণ দৈনিক পাচঁ বার নামাযের উদ্দেশ্য মসজিদে একত্রিত হয়ে ঐক্যের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। ২. আনুগত্যের শিক্ষা : নামাযে ইমামের অনুসরণ ও আনুগত্যের মাধ্যমে নেতার আনুগত্যে শিক্ষা লাভ হয়। ৩. চরিত্র গঠন: নামায চরিত্র গঠনের উত্তম উপায়। দৈনিক পাচঁ বার তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাতকে স্মরণের মাধ্যমে চরিত্রের মন্দ দিকগুলো দূরীভূত হয়ে যায়। ৪. নেতৃত্বের দায়িত্ববোধ: নামায দ্বারা নেতৃত্বের দায়িত্ববোধের শিক্ষা অর্জিত হয়। এমনকি সমাজ ও জাতিকে নেতৃত্ব দেয়ার শিক্ষা এখান থেকে অর্জিত হয়।
৫. পারস্পরিক সহযোগীতায় : সমাজে মসজিদ তৈরী ও এর রক্ষণাবেক্ষণকারী ইত্যাদি কার্যাবলী মাধ্যমে মানুষ মধ্যে পারস্পরিক সহযোগীতামূলক সামাজিক গুণ সৃষ্টি হয়। ৬. পারস্পরিক সম্প্রীতি সৃষ্টি : মুসলমানগণ প্রত্যহ পাচঁ বার সালাত কায়েমের লক্ষ্যে মসজিদে সমবেত হওয়ায় তাদের মাঝে সামাজিক সম্প্রীতি, একতার বন্ধন, ভ্রাতৃত্ব ও পারস্পরিক সহযোগীতা মনোভাব গড়ে ওঠে। ৭. শৃঙ্খলার প্রশিক্ষণ : মুসলমানগণ সালাত আদায়ের লক্ষ্যে প্রত্যহ পাচঁ বার নির্ধারিত সময়ে মসজিদে সমবেত হয় এবং কাতারবন্দি হয়ে কঠোর নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলার সাথে সালাত আদায় করে। এতে মানুষ নিয়ম শৃঙ্খলার প্রশিক্ষণ লাভ করে।
সালাত পরিত্যাগের পরিণাম : ইচ্ছেকৃতভাবে সালাত পরিত্যাগকারীর ব্যাপারে রাসূল (সা.) কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। বে-নামাযীর জন্য ১৪ প্রকার শাস্তি নির্ধারিত হয়েছে : হাদীস শরীফে এসেছে : যে ব্যক্তি নামাযের ব্যাপারে অবহেলা প্রদর্শন করে। আল্লাহ তায়া’লা তাকে চৌদ্দ প্রকার শাস্তি প্রদান করেন। দুনিয়ায় পাঁচ প্রকার শাস্তি : ১. তার জীবন ও জীবিকার বরকত কেড়ে নেয়া হবে। ২. তার চেহারা হতে নেক্কার লোকদের নূর মুছে ফেলা হবে। ৩. সে যেকোন নেক আমল করুক আল্লাহ তায়া’লা তাতে কোন ছওয়াব দান করেন না। ৪. তার কোন দো’য়াই কবুল হয়না। ৫. নেককারদের দো’য়ায় তার কোন অংশ থাকে না। অর্থাৎ উক্ত দো’য়ার বরকত হতে বঞ্চিত থাকে।
মৃত্যু কালিন তিন প্রকার শাস্তি : ১. অপমানিত ও লাঞ্ছিত অবস্থায় তার মৃত্যু হবে। ২. ক্ষুধার্ত অবস্থায় মৃত্যু বরন করবে। ৩. চরম তৃষ্ণার্ত অবস্থায় সে মৃত্যুবরণ করে। যদি সমস্ত পৃথিবীর সাগরের পানিও তাকে পান করান হয়, তবুও তার তৃষ্ণা নিবৃত্ত হবেনা।
কবরের তিন প্রকার শাস্তি : ১. তার কবর এত সংকীর্ণ করা হবে যে, তার এক পাঁজরের হাড় অন্য পাঁজরের মধ্যে ঢুকে যায়। ২. তার কবরে আগুন জ্বালানো হয়, সে উহার শিখার উপর দিনরাত উলট-পালট অবস্থায় দগ্ধ হতে থাকে। ৩. তার কবরে একটি ভয়ংকর বিষধর অজগর নিয়োগ করা হবে। যার চোখ দু’টি আগুনের এবং নখরগুলি লোহার তৈরী হবে। অজগরটি বজ্রের ন্যায় আওয়াজ দিবে এবং মৃত ব্যক্তিকে চব্বিশ ঘন্টা রাতদিন কিয়ামত পর্যন্ত দংশন করতে থাকবে।
কিয়ামতের তিন প্রকার শাস্তি : ১. অত্যন্ত কড়াকড়ি ভাবে বে নামাযীর হিসাব নেয়া হবে। ২. তার উপর আল্লাহর কহরের শাস্তি হবে। ৩. অত্যন্ত অপমানের সাথে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। অপর এক বর্ণনায় এসেছে : কিয়ামতের দিন বে-নামাযীর কপালে তিনটি লাইন লিখা অবস্থায় উঠবে। ‘হে আল্লাহর হক বিনষ্ট কারী। হে আল্লাহর গজবের পাত্র। দুনিয়াতে তুমি যেভাবে আল্লাহর হক নষ্ট করেছ, সে রূপ আজ তুমি আল্লাহর রহমত হতে বঞ্চিত’। (জাওয়াজেরে ইবনে হাজর মককী, ফাজায়েলে নামায)।
সালাত পরিত্যাগকারীর ব্যাপারে শরয়ী দিকনির্দেশনায় ওলামায়ে কেরামগণ কি অভিমত ব্যক্ত করে গেছেন। যেমন : আহলে যাওয়াহেরর মতে, ইচ্ছেকৃতভাবে নামায পরিত্যাগকারী কাফের হবে। কেননা হাদিসে মোবারকায় এসেছে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের মতে, সালাত পরিত্যাগকারীর কাফের হয় না, তবে কুফরীর নিকটবর্তী চলে যায়। ইমাম মালেক ও শাফেয়ী (রহ.) মতে, সালাত পরিত্যাগকারী কাফের না হলেও তাকে হত্যা করা ফরয। ইমাম আযম আবু হানীফা (র) মতে, সালাত আদায় না করা পর্যন্ত তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া ও জেলে আবদ্ধ রাখা ওয়াজিব।
অতএব, জ্ঞান থাকতে কোন মুমিনের পক্ষে কোনো অবস্থাতেই সালাত পরিত্যাগ করা বৈধ নয়। সালাত কায়েমে সরকারের ভূমিকা : সূরা হজ্জের ৪১ নং আয়াতে সালাত কায়েমে মুসলিম দেশের সরকার ভূমিকা সম্পর্কে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। অর্থাৎ, পৃথিবীতে তাদেরকে রাষ্ট্র ক্ষমতা দেয়া হলে তারা সালাত কায়েম করে। দেশের জনগণকে সৎ ও ন্যায়-নিষ্ঠাবান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য একটি মুসলিম দেশের সরকারের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে সমাজে যথাযথভাবে নামায প্রতিষ্ঠা করা।
যাতে মানবজাতি সালাত আদায়ের মাধ্যমে যাবতীয় অন্যায় ও অশ্লীলতা থেকে দূরে অবস্থানপূর্বক এর বিনিময় নিজেদেরকে সৎ ও নিষ্ঠাবান লোক হিসেবে গড়ে তুলতে পারে এবং সমাজে শান্তি ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে বিশ্বকে সুখী সমৃদ্ধিশালী আবাসভূমি হিসেবে রুপান্তর করতে পারে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।