পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে এসে পিছনে ফিরে তাকালে দেখা যাবে, জাতি হিসেবে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। এই দীর্ঘ সময় বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের পরিচিতির ক্ষেত্রে যত অর্জন তার উল্লেখযোগ্য অংশ খেলাধুলার মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে। এক্ষেত্রে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদের অর্জনও অনেক।
খেলাধুলায় নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে ১৯৭২ সালের ১৯ ফেব্রæয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। এ ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকার মেয়েদের খেলাধুলার উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সম্প্রতি ইউনিসেফ ও বাফুফে (১২-১৬ বছর বয়সী মেয়েদের) দেশব্যাপী ফুটবল প্রতিভা অন্বেষণের কার্যক্রম শুরু করেছে। আশা করা যাচ্ছে, এ কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত এবং দুর্গম অঞ্চলে বসবাস করা মেয়েরা উঠে আসবে। এ কথা সত্য আমাদের দেশের মেয়েদের এখনো খেলাধুলায় সুযোগ সুবিধার অভাব রয়েছে, পাশাপাশি রয়েছে বৈষম্য। যেখানে ছেলেদের প্রায় সকল টুর্ণামেন্টে পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া যায়, মেয়েদের ক্ষেত্রে তা নেই বললেই চলে। এক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকদের উচিত মেয়েদের খেলাধুলার উন্নয়নের জন্য পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া। এর বাইরে পারিবারিক অনীহা এবং নিরাপত্তাহীনতাও আমাদের মেয়েদের খেলাধুলার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। আশার কথা হচ্ছে, এরপরও খেলাধুলায় এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের নারীরা। গত কয়েক বছর ধরে খেলাধুলায় আমাদের মেয়েরা ভালো করছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গেমসে মেয়েরা পুরুষের সমান পদক জয়ের নজির রাখছে।
আমাদের দেশের বেশিরভাগ মেয়েই খেলাধুলায় আসে নি¤œ ও মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে। কিছু উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়েরা খেলায় এলেও তা সংখ্যায় কম। একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য খেলে। তারা খেলায় লেগে থাকে না, অনেকে শখে আসে, আবার চলে যায়। খেলাকে তারা পেশা হিসেবে নেয় না। শখের বসে আসা এসব মেয়েদের খেলাধুলা নিয়মিত করতে পারলে খেলায় অগ্রগতি আরো বেশি হবে। শিক্ষিত মেয়েরা যত বেশি খেলাধুলায় আসবে, ততই খেলার উন্নতি ঘটবে। আমাদের মেয়েদের নিয়ে বিদেশিদের ধারণাও বদলে যাবে। অনেকক্ষেত্রে নি¤œ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরা খেলাধুলা করে অর্থ উপার্জন করলে, উপার্জিত অর্থ যেন তাদের জন্য বড় পাওয়া হিসেবে ধরে নেয় সমাজ, যদিও এ অল্প পরিমাণ টাকাই পরিবারকে দিতে পেরে তারাও খুশি থাকে। তবে সামান্য সুযোগ-সুবিধা সবসময় মেয়েদের খেলায় টানবে না। তাই এই অল্প সুযোগ-সুবিধায় একশ্রেণির মেয়েরা খেলাধুলায় ঝুঁকলেও আরেক শ্রেণি মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে না পারলে মেয়েদের খেলাধুলা বেশিদিন টিকানো যাবেনা। বর্তমান কঠিন বাস্তবতায় জীবিকার জন্য মেয়েরা খেলা থেকে ভালো অর্থ না পেলে তারা খেলাধুলায় নিরুৎসাহী হবে। এক্ষেত্রে আর্থিক বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ।
জোবেরা রহমান লিনুুকে বলা হয় বাংলাদেশের টেবিল টেনিসের রাণী। দুই যুগ নারীদের টেবিল টেনিসে রাজত্ব করছেন তিনি। ১৬ বার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়ে কেবল নিজেকেই অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাননি, বাংলাদেশের নামও তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক পরিমÐলে। সবচেয়ে বেশি জাতীয় শিরোপা জিতে নিজের নামটি লিখিয়েছেন গিনিস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে। বাংলাদেশের নারীদের খেলাধুলার রোল মডেলও তিনি।
খেলাধুলায় মেয়েদের অংশগ্রহণ অনেক কম হলেও, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফুটবলে মেয়েদের আগ্রহ বাড়ছে। এরমধ্যে লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, মেয়েদের ফুটবলে শুরু থেকেই দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্ত¡ার মেয়েদের অংশগ্রহণ বেশি। তারপরও আন্তর্জাতিক অঙ্গণে দেশের নারী খেলোয়াড়রা অভূতপূর্ব সাফল্য দেখিয়েছে। গত ২২ ডিসেম্বর রাতে সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ নারী ফুটবলের ফাইনালে ১-০ গোলে ভারতকে হারিয়ে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশের মেয়েরা। এর আগে সাফ অনূর্ধ্বÑ১৮ নারী চ্যাম্পিয়নশিপ ২০১৮-এ অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছে তারা। ২০১৬ এএফসি অনূর্ধ্ব ১৬ চ্যাম্পিয়ন, ২০১৫ সালে অনূর্ধ্ব ১৫, ২০১৮ সালের জকি কাপ, ২০১৯ সালের বঙ্গমাতা আন্তর্জাতিক ফুটবলে অনূর্ধ্ব ১৯ যুগ্মভাবে জয় করে আমাদের মেয়েরা। ২০১৮ সালেই মালয়েশিয়ায় ভারতকে হারিয়ে এশিয়া কাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশের নারী ক্রিকেট দল। এছাড়া টানা দুইবার (২০১৮Ñ১৯) আইসিসি নারী টিÑ২০ বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে সালমা বাহিনী। দক্ষিণ এশিয়ার অলিম্পিকখ্যাত এস এ গেমেসের নারী ক্রিকেটে বাংলাদেশ নারীদল প্রথম চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। এ আসরেই বাংলাদেশের নারী তীরন্দাজরা স্বর্ণ জিতে রেকর্ড করে। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি পুরুষ দলের নারী কোচ হওয়ার গৌরব অর্জন করেন ২৬ বছর বয়সী বাগেরহাটের মেয়ে মিরোনা।
গত বছর এসএ গেমসে ব্যক্তিগত ইভেন্টে ৬টি স্বর্ণ পদক জিতেছে বাংলাদেশের মেয়েরা, এক্ষেত্রে মারিয়া আক্তার সীমাও টানা দুইবার সোনা আনেন দেশের জন্য। এছাড়াও ২০১৬ সালের এসএ গেমসে বাংলাদেশ যে চারটি স্বর্ণ পদক জয় করে, তার ৩টিতে মেয়েরা জিতেছিলো। ২০১০ সালে ঢাকা এসএ গেমসে ১৮টি স্বর্ণ পদকের মধ্যে ৮টি পায় বাংলাদেশের মেয়েরা।
আমাদের দেশের মেয়েদের খেলাধুলায় বড় বাধা হচ্ছে বাল্যবিয়ে। খেলায় প্রতিভার স্বাক্ষর রাখার পরও অনেক মেয়েকে বাল্যবিয়ের শিকার হতে হচ্ছে। ২০১৭ সালে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুনন্নেছা মুজিব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গোল্ডকাপে জাতীয় পর্যায়ে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হয়েছিলো স্বরলিকা পারভীন। বয়স হওয়ার আগেই সেই মেয়েটির বিয়ে হয়েছে কিছুদিন আগে। শুধু সে একা নয়, কুড়িগ্রামের বাঁশজানি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্বরলিকাদের ফুটবল দলের সাত কিশোরী ফুটবলার বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। এভাবেই খেলা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের মেয়েরা।
একসময় আমাদের মেয়েদের খেলাধুলায় অংশগ্রহণে অনেক বাধা ছিল। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশে প্রমিলা ফুটবল চালু করে। স্কুল পর্যায়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গোল্ডকাপ এবং বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা গোল্ড কাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন এবং প্রাথমিক স্কুল পর্যায় থেকে মেয়েদের ফুটবল দল গঠনের মাধ্যমে ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের গড়ে তোলার উদ্যোগও গ্রহণ করে বর্তমান সরকার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্টে ৬৩ হাজার ৫০৯টি দল এবং বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব গোল্ডকাপ ফুটবল-২০১৫তে ৬৩ হাজার ৪৩১ দল অংশগ্রহণ করেছে। বিশ্বের আর কোথাও এত বৃহৎ আয়োজনে ফুটবল টুর্নামেন্ট হয় না।
শত প্রতিবন্ধকতা, প্রতিক‚লতা, বৈষম্য পেরিয়ে খেলাধুলায় দিনদিন এগিয়ে যাক আমাদের নারীরা। তাদের মাধ্যমেই দেশের সুনাম ছড়িয়ে পড়–ক সারাবিশ্বে। যেমনটি হয়েছিলো নিশাত মজুমদারের বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্ট জয়ের মাধ্যমে। আর এমন অনেক সাফল্য নিয়ে ক্রিড়াঙ্গনে এগিয়ে যাবে আমাদের মেয়েরা, এমন প্রত্যাশা নিশ্চয় পূরণ করতে পারবে তাদের নিজ যোগ্যতার আলোয়।
লেখক : সহকারী তথ্য অফিসার, পিআইডি, ঢাকা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।