পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আজ পয়লা জানুয়ারি। ইংরেজি নববর্ষ। নিউ ইয়ার। পয়লা জানুয়ারিতে জাঁকজমকের সঙ্গে উৎসব হয় প্রায় সব দেশেই। তবে দিনটা সর্বত্র নিউ ইয়ারস ডে নয়। মূলত খ্রিস্টান অধ্যুষিত এবং ইংরেজি ভাষাভাষি দেশ যেমন ইংল্যান্ড-আমেরিকায় পয়লা জানুয়ারি মানেই নিউ ইয়ারস ডে। আরব দেশে পয়লা জানুয়ারিতে নববর্ষ হয় না। ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলংকা কিংবা তিউনিসিয়ায় নতুন বছর শুরু আগস্ট থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যে। চীন আর ইতালিতে নববর্ষ শুরু হয় যথাক্রমে নভেম্বর এবং মার্চ মাসে।
ইংরেজি নববর্ষ বলে পয়লা জানুয়ারির সঙ্গে একটা খ্রিস্টান-খ্রিস্টান ভাব জড়িয়ে আছে। অথচ, বিশ্বের তাবড় ইতিহাসবিদরা অনেক খুঁজেও পয়লা জানুয়ারিরর সঙ্গে যিশু, বাইবেল বা ধর্মের কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাননি, যদিও জগৎ জুড়ে সব দেশে পয়লা জানুয়ারি পালনের পিছনে মজার-মজার গল্প আছে। কেন হঠাৎ এবং কীভাবে পয়লা জানুয়ারিটাই ইংরেজি নববর্ষের প্রথম দিন হয়ে গেল, বড় বড় হিসাবকারী পন্ডিতরা এখনো তা নিয়ে একমত হতে পারেন নি।
নামে ইংরেজি নববর্ষ হলে কী হবে, আদতে পয়লা জানুয়ারির জন্ম কিন্তু ব্রিটিশ বা মার্কিন মুলুকে নয়। রোম সাম্রাজ্যে। রোমে তখন সভ্যতার ছোঁয়া তেমন লাগেনি বললেই চলে। পাথর কেটে মানুষের ঘরবাড়ি, শিকার করে খাবার দাবার, এভাবে বেশ চলছিল। হঠাৎ মোগাস নামের মাতব্বর গোছের এক জন্মখ্যাপার মাথায় কী বুদ্ধি চাপল কে জানে! লোকজনকে ডেকে বাতলে দিল, সূর্য উঠে, আর যায়, আবার উঠে। এর মাঝে সময় টুকুকে ধর এক দিন। আর পাথর দিয়ে পাথরের গায়ে একটা করে দাগ কেটে যাও। ব্যস, দিন যায়, দাগ বাড়ে। রোমের লোককথায় এ হলো গিয়ে মোগাসের কাহিনী, যার নাম থেকে মেগাস অর্থাৎ জ্ঞানী শব্দটা এসেছে।
সেটা খ্রিস্টের জন্মের ৬০০ বছর পরের কথা। আরও পাঁচটা রোম-শিশুর মতই একদা বাল্যকালে বিকালের আলোয় বাগানে বসে গৃহ শিক্ষকের কাছে মোগাসের গল্প শুনছিলেন সিজার। অস্ত্রে যতটা পাকা, অঙ্কে ততটাই কাঁচা ছিলেন তিনি। অথচ, মোগাসের ভূতুড়ে তাড়ায় তাঁর মাথাতেই দিব্যি খেলে গেল ক্যালেন্ডার বা বর্ষপুঞ্জির আইডিয়া। যিশুর জন্মের তখন হাজার বছর পেরিয়ে গেছে। আমরা ঘটা করে বলি বটে, ২৫ ডিসেম্বর অর্থাৎ বড়দিনেই যিশু জন্মেছিলেন। কিন্তু আসলে এ নিয়ে তর্ক-বিতর্কের শেষ নেই। বিশেষ করে ইহুদি দার্শনিকদের হিসাবে যিশুর জন্ম মার্চ বা এপ্রিল মাসের কোনো এক সময়ে। কাজেই সিজারের ক্যালেন্ডারের বর্ষ শুরুর দিনটি নিয়ে গোলমাল ছিল। বলা ভালো, যিশুর জন্মের দিনক্ষণ মাথায় রেখে একটা জোড়াতালি মেরেছিলেন সিজার। সেই গোঁজামিলে এক জানুয়ারির অস্তিত্ব ছিল না। তাহলে পয়লা জানুয়ারির সর্বস্বত্ব কার নামে সংরক্ষিত?
অবশ্যই ফাদার গ্রেগরি। হ্যাঁ, তিনিই আধুনিক ইংরেজি ক্যালেন্ডার তৈরি করেছিলেন। ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকের কোনো একটা সময়ে। পোপ হওয়ার পরে। ফাদার গ্রেগরি ছিলেন ইতালির লোক। তিনি ধার্মিক ছিলেন। কিন্তু সংস্কারবাদী ছিলেন না। যিশু ছাড়া তিনি আর একটি জিনিসই বুঝতেন, তা হলো নিঃসর্গ। কারণ তাঁর ধারণা ছিল, এ অসীম-অনন্ত প্রকৃতি যিশুর মহত্তর দান। তাই তিনি চেয়েছিলেন, ক্যালেন্ডারের সঙ্গে ঋতুচক্রের ছন্দটাকে মেলাতে। সেটা পেরেও ছিলেন তিনি।
একদিন প্রার্থনা সেরে বেরিয়ে গ্রেগরি অনুভব করলেন, বরফ শীতল হাওয়াটা যেন একটু আঁচ পেয়েছে। গাছদের শাখা প্রশাখায় খানিক সবুজের আভা লেগেছে। শীতে ঘুম ভেঙে উঠে পাখিরা গান গাইছে, যেমন বসন্তে হয়। গ্রেগরি ভাবলেন, এটাই যদি নতুন দিন হয়। এভাবেই যদি শুরু করা যায় নতুন আবহাওয়ার লীলাখেলা, তা হলে কেমন হয়! নিজের ঘরে ফিরে এসে সিজারের ক্যালেন্ডারকে রেখে গ্রেগরি বসলেন সপ্তাহ, পক্ষ আর মাসের হিসাব মিলাতে। একেবারে শীতের শেষ বা বসন্তের সূচনার জন্য অপেক্ষা করে লাভ নেই। শীত-বসন্তের এ পরিবর্তনের জন্য বরং কিছুটা সময় ধরে রাখা যাক। আজকের দিনটা এ দিনটাই হোক বছরের শুর। সিজারের ক্যালেন্ডার ধরলে এ আবিষ্কারের দিনটা নাকি দাঁড়ায় পয়লা জানুয়ারি। এখন যে নিউ ইয়ারস ডে উৎসব হয়ে ওঠে, তা ইংরেজদেরই কীর্তি। কারণ চতুর ইংরেজরা গ্রেগরির যুক্তিবাদী ক্যালেন্ডারটা মেনে নিয়ে পয়লা জানুয়ারিকে ইংরেজি নববর্ষে পরিণত করেছিল।
অবশ্য এটা ইংরেজদের উদারতা নয়, বরং কূটনীতি। ইংল্যান্ডে তখন অ্যাস্ট্রোনমির চর্চা শুরু হয়েছে জোর কদমে। স্কটল্যান্ডের বিজ্ঞানী ইভান টমাস ততদিনে জোয়ার-ভাঁটা বা পূর্ণিমা-অমাবস্যার সঙ্গে চাঁদ-সূর্য-তারা-গ্রহ-নক্ষত্রের সম্পর্ক খুঁজে বের করেছেন। ব্রিটিশরা চাইছিল, নিজেদের কর্তৃত্ব ফলাতে অ্যাস্ট্রোনমিকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে। তারা বাহন করল সেই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারকে। তবে ইংরেজরা যতটা আধুনিক ততটা কুসংস্কারবাদী। তারা বলল, বেশ তো আমরা অ্যাস্ট্রোনমিটার সঙ্গে মিলিয়ে দেখি। মানুষের মতো দিন ক্ষণের একটা ঠিকুজি কোষ্ঠী থাকে। শুরু হলো গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থানের বিচারে অঙ্কের কাটাকুটি আর জোড়াজুড়ির ছক এবং হিসাব মিলল। ইংল্যান্ড বিশ্ব সম্মেলন ডেকে ফতোয়া দিল, ধরে নিতে হবে, পয়লা জানুয়ারি থেকে ইংরেজি নববর্ষ শুরু।
আর যায় কোথায়। ইংরেজদের অনুগ্রহপ্রার্থী দেশগুলো হাত তুলে দিল। তারা বলল, আমাদের নিজেদের দেশ-জাতির কাছে নববর্ষ যখনই শুরু হোক না- কেন, পয়লা জানুয়ারিটাকে সেলিব্রেট করতে দোষ কী! শত হোক ব্রিটিশরা যখন বের করেছে, তখন সেটাই ইন্টারন্যাশনাল ক্যালেন্ডার। এই আন্তর্জাতিক ইস্যুটা এমন হিট করল যে, দেশকে দেশ ভেসে গেল পয়লা জানুয়ারির নিউ ইয়ারস ডে-তে।
এবার আমেরিকায় কী ঘটল দেখা যাক। আমেরিকানরা এবার অনেক ভেবে চিন্তে পয়লা জানুয়ারির সঙ্গে একটু ধর্মকর্ম জুড়ে দিল। উত্তর-আমেরিকা ধর্ম প্রচারে গিয়ে এক লাতিন-যাজক যোসেফ হান্ট অদ্ভূত ব্যাখ্যা দিলেন। তিনি বললেন, যিশু জন্মেছিলেন ২৫ ডিসেম্বর। সেদিন শুরু হয়ে খ্রিস্ট উৎসব অর্থাৎ কিনা ক্রিসমাস চলবে সপ্তাহকাল। তার যে সমাপ্তি অনুষ্ঠান, সেটাই হোক পয়লা জানুয়ারি। মার্কিন মদত জুটে গেল। ইংরেজের সঙ্গে যিশুর কালচার ঢুকে পড়াই তো বিশ্বে এখনো পয়লা জানুয়ারি এত রমরমা। ফ্রান্সে তখন বিপ্লব হয়নি। দেশজুড়ে মড়ক লাগল খেতখামারে। দেখা দিল মন্বত্বর, দুর্ভিক্ষ। টান পড়ল রাজা হেনরি লুইয়ের রন্ধনশালায়। রয়েল কিচেনের ‘হেডকুক’ রিচার্ড একদিন রাজাকে খেতে দিতে গিয়ে দেখল, রুটির মতো এক ধরনের খাবার পচে ফুলে গেছে। তাতে খানিক ফলের রস ছড়িয়ে রিচার্ড দেখল, স্বাদ লাগছে বেশ। রাজাকে তা-ই দেয়া হলো। রাজা অবশ্য খেলেন না। দয়ার শরীর ছিল হেনরির। তিনি বললেন, আমি না, আমি না। আগে কর্মচারীদের দাও। সেই রসালো পঁচা খাবার রাজা নিজের হাতে বেটে দিলেন অনাহারী লোকগুলোর মধ্যে। শোনা যায়, এ অখাদ্য খাবারটাই নাকি কেকের পূর্বপুরুষ। এ ঘটনার পরেই নাকি দিন ফিরে গেল ফ্রান্সের। হেনরির প্রাসাদে খাদ্যের রমরমা এলো। গ্রেগরির ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, দিনটা ছিল পয়লা জানুয়ারি।
পয়লা জানুয়ারি ইংরেজি নববর্ষ ছড়িয়ে পড়েছে দেশ-দেশান্তরে। তাকে কোনো সময়ের ঘড়িতে, ভূগোলের কাঁটা তারে, ইতিহাসের বিস্মৃতিতে বেঁধে রাখা যায়নি। এ দিনে ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ যেন সর্বত্র। পূর্ব-পশ্চিমে দুই গোলার্ধেই পয়লা জানুয়ারি মানে কেক, গ্রিটিং কার্ড, পিকনিক। ইংরেজি নববর্ষের দিনটায় ইতালিরসব গির্জায় প্রভাতী প্রার্থনার শেষে একবার ঘণ্টা বাজে গ্রেগরির স্মরণে। ইতালিতে গ্রেগরির পরিচয় ধর্মগুরু হিসেবে নয়, দার্শনিক হিসাবে, বিজ্ঞানী হিসাবে। ধর্মের মানুষ না হয়েও তিনি জড়িয়ে আছেন, ইতালিতে ইংরেজি নববর্ষের মতো একটা সামাজিক অনুষ্ঠানের শিরোমণি হয়ে। ইতিহাস বিখ্যাত বিপ্লবের দেশ ফ্রান্সের ইংরেজি নববর্ষের যথেষ্ট কদর, কারণ সে-দেশের গ্রামগুলিতে এদিনে এখনো রাজা হেনরি লুইয়ের স্মরণে প্রার্থনা বসে। লুই মানেই তো রিচার্ডের তৈরি সেই কেকের পূর্বসুরির গল্পটা। হ্যাঁ, পয়লা জানুয়ারি দিনটায় শহুরে ফরাসিরা মেতে থাকেন কেক ফেস্টিভ্যালে। গ্রিস কিংবা ইন্দোনেশিয়ায়ও কিন্তু ব্যতিক্রম নয়। ইংরেজি নববর্ষের সাহেবী উৎসবের সঙ্গে সঙ্গে তারা লোককথার গল্পগুলি ভুলে যায় না। গ্রিসের বড় বাণিজ্য-প্রতিষ্ঠানগুলোতে মেষপূজা হয় এখনো সেই পয়লা জানুয়ারিতেই। আর ইন্দোনেশিয়ায় গৃহস্থরা পয়লা জানুয়ারিতে সন্তান-সন্তুতির মঙ্গল কামনায় আরাধনায় বসেন।
নববর্ষ শুরুর দিনটা এর থেকে বেশি কী আর পেতে পারে সারা দুনিয়ার কাছে! ইংরেজি ক্যালেন্ডারের আন্তর্জাতিকতার কল্যাণেই পয়লা জানুয়ারির দিনটায় সারা পৃথিবীর মানুষ এক সঙ্গে উৎসবের আনন্দ অনুষ্ঠানে মেতে উঠে। বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য, বিবিধের মাঝে এমন মিলন বছরের আর কোনদিন দেখা যায় না।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।