Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দেশে গণতন্ত্র ও সুশাসন কোন অবস্থায় আছে

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ৩১ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:০২ এএম

আমাদের সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রেও এমন অঙ্গীকার করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা-যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ এ অনুযায়ী বলা যায়, আমাদের স্বাধীনতার মূল স্পিরিট এবং দেশ কিভাবে পরিচালিত হবে, তা উল্লেখিত সাংবিধানের অনুচ্ছেদ ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বর্ণিত হয়েছে। এটাই হবে আমাদের স্বাধীন দেশের চরিত্র। এ বছর আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর বা সুবর্ণজয়ন্তী পালন করেছি। ৫০ বছরের বাংলাদেশে উল্লেখিত মৌলিক বিষয়গুলো স্বাধীনতা পরবর্তী সরকারগুলো কতটা বাস্তবায়িত করেছে, তা নিয়ে যেমন প্রশ্ন করা যেতে পারে, তেমনি বিচার-বিশ্লেষণও করা যেতে পারে।

দুই.
আমরা যদি স্বাধীনতার অন্যতম বিষয় গণতন্ত্রের কথা বিবেচনা করি, তাহলে সেটা কি অবস্থায় রয়েছে এবং কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে, তা বিচার করার দাবী রাখে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা মানুষের স্বাধীন মতামত প্রকাশ তথা বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করে। গণতান্ত্রিক ধারণা উদ্ভবের আগে সাধারণ মানুষের কথা বলার মতো অবস্থা বা অধিকার ছিল না। তারা অনেকটা প্রভুত্ববাদী শাসনে দাস হিসেবে পরিগনিত হতো। সমাজের এলিট, প্রভাবশালী বা ধনিক শ্রেণীর কথাই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হতো। তারাই ছিল দন্ডমুন্ডের কর্তা। নিজেদের মতামতের ভিত্তিতে যেভাবে তাদের অধীনস্থদের পরিচালনা করত, সেভাবেই শাসন কাজ পরিচালিত হতো। সাধারণ মানুষের কথার কোনো মূল্য দেয়া হতো না। তাদের শাসন ‘টাইরেনি’ বা স্বৈরতান্ত্র হিসেবে পরিচিত ছিল। এই স্বৈরতন্ত্র যারা চালাতেন, তাদের মধ্যে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন কিছু লোকজনও ছিল, যারা সাধারণ মানুষের মতামত প্রকাশের বিষয় নিয়ে চিন্তা করতেন। খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ শতকে গ্রিসের এথেন্সে যখন এলিট শ্রেণীর টাইরেনি শাসন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল, তখন দার্শনিক ক্লিসথেনিস চিন্তা করলেন, শাসন ব্যবস্থায় যদি সাধারণ মানুষের মতামত যুক্ত করা যায় বা তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয়গুলো প্রাধান্য দেয়া হয়, তাহলে মানবিকতার প্রকাশ ঘটবে। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ কমবে। শাসনকর্তারা শুধু নিজের কল্যাণে ব্যস্ত থাকবে না, কিংবা সাধারণ মানুষকে দাস না ভেবে মানবতার কল্যাণে সেবক হিসেবে কাজ করতে পারবে। ক্লিসথেনিসের এই ধারণা থেকেই মূলত গণতন্ত্রের উদ্ভব ঘটে, যা এথেনিয়ান গণতন্ত্র হিসেবে পরিচিত। সেই থেকে গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়ে মানুষের সভ্যতার অগ্রযাত্রায় পরিবর্তিত, পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত হয়েছে এবং হচ্ছে। গণতন্ত্রের এই রূপান্তর ঘটানো হয় সাধারণ মানুষের অধিক কল্যাণ সাধনের জন্য। এ ধারাবাহিকতায় বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং সিংহভাগ দেশ তা ধারণ করে। এর মধ্যে নামকাওয়াস্তে গণতন্ত্রও রয়েছে। বিশ্বের পরাশক্তি ও ধনী দেশগুলো, অন্যান্য দেশের ওপর যাদের প্রভাব রয়েছে, তারা নিজেরা গণতন্ত্র ধারণ করে এবং খর্বিত, খন্ডিত ও ক্ষয়ীষ্ণু গণতান্ত্রিক দেশগুলোর প্রতি নজরদারি করে থাকে। আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা মূলত গণতন্ত্রকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং সাধারণ মানুষের আকাক্সক্ষার কারণেই দেশের স্বাধীনতা ত্বরান্বিত হয়েছে। দুঃখের বিষয়, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন দল ক্ষমতায় এলেও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র কিংবা সংবিধানের ধারা মোতাবেক গণতন্ত্রকে সুদৃঢ় ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে খুব একটা কাজ করেনি। যে যার মতো কিংবা নিজের সুবিধা ও বুঝ মতো গণতন্ত্রকে ব্যবহার করেছে এবং করছে। বিগত এক দশকে তো গণতান্ত্রিক এবং সংবিধানিক ধারা রক্ষার কথা বলে, অগ্রহণযোগ্য ও বিতর্কিত নির্বাচন করে পুরো ধারাটিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলা হয়েছে। নির্বাচন গণতন্ত্রের অন্যতম মৌলিক উপকরণ এবং জনগণের মতামত প্রকাশের মাধ্যম হলেও, এখন এ মতামত প্রকাশ সংকুচিত অবস্থায় রয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারিতে যে জাতীয় নির্বাচন হয়, তাতে ১৫৩ জন বিনাপ্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত হয়ে নজিরবিহীন ইতিহাস রচনা করে। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় বিশ্বের আর কোথাও এ ধরনের নির্বাচন হওয়ার দৃষ্টান্ত নেই। তার অর্থ হচ্ছে, শাসকদল গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার কথা বললেও, গণতান্ত্রিক মানসিকতার অভাবে বা স্বেচ্ছাচারি মনোভাবের কারণে, গণতন্ত্রকে ভুলুণ্ঠিত করতে দ্বিধা করছে না। আমাদের দেশে সাধারণত গণতন্ত্র বলতে ভোটের গণতন্ত্রকে ধরে নেয়া হয়। গণতন্ত্রে যে, কথা বলার স্বাধীনতা, সমঅধিকার নিশ্চিত করা, যেকোনো বিষয়ে মতপ্রকাশের অধিকারের কথা বলা হয়েছে, এ বিষয়ে আমাদের দেশের সাধারণ-অসাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে। তাদের এই অসচেতনতাকে পুঁজি করেই শাসকরা তাদের ইচ্ছামতো গণতন্ত্রকে ব্যবহার করেছে এবং করছে। বরং নানা ধরনের কালাকানুনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের অধিকারগুলো রুদ্ধ করা হয়েছে। মানুষের মধ্যে ভয় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। শাসকরা যা করে, এমনকি অপছন্দনীয় কাজ করলেও তা নিয়ে যাতে কোনো ধরনের সমালোচনা করতে না পারে, এ ব্যবস্থা করা হয়েছে। যে ভোটের গণতন্ত্র এবং ভোট দেয়ার অধিকারের বিষয়টি মানুষ বোঝে, ৫০ বছরে এসে এ অধিকারটুকুও তারা হারিয়েছে। বিগত দুটি জাতীয় নির্বাচন এবং চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, আমাদের শাসকরা মানুষের ভোটের গণতন্ত্রকে কিভাবে পদদলিত করেছে। ৫ জানুয়ারির বিনাভোট ও ২০১৮ সালের রাতের আঁধারের নির্বাচন এবং তৎপরবর্তী সংসদের উপনির্বাচনসহ স্থানীয় নির্বাচনে মানুষের ভোটের অধিকার বলে কিছু ছিল না, এখনও নেই। সাধারণ মানুষের মধ্যে ভোট দেয়ার আগ্রহ বলতে কিছু নেই। ধাপে ধাপে অনুষ্ঠিত চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের কথাই যদি ধরা হয়, তাহলে সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, এ পর্যন্ত চেয়ারম্যান, সাধারণ সদস্য ও সংরক্ষিত সদস্যসহ ১৫৭০ জনপ্রতিনিধি বিনাপ্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত হয়েছে। এর মধ্যে চেয়ারম্যান ৩৫১ জন, সাধারণ সদস্য ৮৫৮ ও সংরক্ষিত সদস্য ৩৬১ জন রয়েছেন। এর আগে ২০১৬ সালে বিনাপ্রতিদ্ব›িদ্বতায় ২০৭ জন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০১৯ সালে উপজেলা পরিষদে বিনাপ্রতিদ্ব›িদ্বতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন ১১১ জন। দেখা যাচ্ছে, যতই দিন যাচ্ছে, ভোটের গণতন্ত্রও দেশ থেকে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এই ভোটের গণতন্ত্রই যদি না থাকে, তাহলে দেশের পূর্ণ গণতন্ত্রের কি অবস্থা, তা সহজেই অনুমান করা যায়। এর চিত্র বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপেও উঠে এসেছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইকোনোমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) ২০০৬ সাল থেকে ১৬৭টি দেশ নিয়ে ‘ডেমোক্রেসি ইনডেক্স’ বা গণতন্ত্র সূচক প্রকাশ করে আসছে। নির্বাচন পদ্ধতি ও বহুত্ববাদ, নাগরিক স্বাধীনতা, সরকার পরিচালনা, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি-এই পাঁচ বিষয় নিয়ে গণতন্ত্র সূচক তৈরি করা হয়, যার নম্বর থাকে ১ থেকে ১০। এই গণতন্ত্র সূচকে ২০০৬ সালে বাংলাদেশের নম্বর ছিল ৬.১১। ২০২০ সালে ৫.৯৯। প্রতিষ্ঠানটির মতে, বাংলাদেশ একটি হাইব্রিড রিজিম বা শংকর গণতান্ত্রিক দেশ, যেখানে গণতন্ত্রের সব অনুষ্ঠান-আনুষ্ঠানিকতা এবং প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান থাকলেও এগুলো বহুলাংশে অকার্যকর। জার্মানির থিঙ্কট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠান বার্টেলসমান স্টিফটুং গভর্ন্যান্স এবং ডেমোক্রেসি সূচক তৈরি করে থাকে, যার নম্বর ১ থেকে ১০। প্রতিষ্ঠানটির গর্ভন্যান্স সূচক অনুযায়ী, ২০১০ সালে বাংলাদেশের নম্বর ছিল ৪.৯ এবং ২০২০ সালে ৪.৫। গণতন্ত্র সূচকে ২০১০ সালে নম্বর ছিল ৬.১ এবং ২০২০ সালে ৪.৪। দেখা যাচ্ছে, উভয় প্রতিষ্ঠানের গণতন্ত্র সূচকে ২০০৬ সালের পর থেকে ক্রমাবনতি ঘটেছে। ইন্টারন্যাশনাল আইডিইএ ২৮টি দিক বিবেচনায় প্রতিনিধিত্বশীল সরকারের সূচকের ভিত্তিতে ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশকে দুর্বল গণতন্ত্র বলে আখ্যায়িত করা হয়। এরপর থেকে বাংলাদেশ কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি পায়। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, বাংলাদেশের গণতন্ত্র ক্রমশ নিম্নমুখী এবং ৫০ বছরে এসে তা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। গণতন্ত্রের যে আশা-আকাক্সক্ষা নিয়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, সেই গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে দেশের মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে। শাসকরা সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার দাবিয়ে শাসন করে যাচ্ছে।

তিন.
গণতন্ত্রে মানবাধিকার, আইনের শাসন, সুশাসন ও বাকস্বাধীনতার বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত। আমাদের দেশে মানবাধিকারের বিষয়টি যদি বিবেচনা করা হয়, তবে দেখা যাবে, সাধারণ মানুষ এ অধিকার সম্পর্কে খুব কমই জানে। এ অধিকার সম্পর্কে কোনো সরকারই মানুষকে অবহিত বা ব্যাখ্যা করতে কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি। কেবল বক্তৃতা-বিবৃতিতে এ অধিকারের কথা বলে গেছে। মানুষ হিসেবে একজন মানুষের যে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছ থেকে জীবনযাপনের আর্থিক, মানবিক সুযোগ-সুবিধা, আচার-ব্যবহার পাওয়ার অধিকার রাখে, তা পরিস্কার করে বলা হয় না। এর কারণ হচ্ছে, রাজনীতিক ও শাসকরা সাধারণ মানুষকে দমিয়ে বা অসচেতন রেখেই ক্ষমতায় যেতে এবং থাকতে চায়। মানুষ যদি যার যার অবস্থান থেকে মানবাধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে, তাহলে ক্ষমতাবান বা শাসকরা শাসন করার ক্ষেত্রে অসুবিধায় পড়ে যাবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে অপরাজনীতির সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে এবং তাদের সুবিধার্থে তা লালন-পালন করছে, সেক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের অসচেতনতাকে পুঁজি করে রাজনীতি করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। এজন্য শাসক দলের পক্ষ থেকে নতুন একটি তত্তে¡র উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তত্ত¡টি হচ্ছে, ‘কম গণতন্ত্র, বেশি উন্নয়ন।’ এর মাধ্যমে জনগণকে বোঝাতে চেষ্টা করা হয়েছে, গণতন্ত্র নিয়ে তোমাদের এত ভাবার দরকার নেই, তোমাদের উন্নয়ন দরকার। এটি যে চাতুরতা এবং শাসকদের ক্ষমতা প্রলম্বিত করার একটি অপকৌশল, তা সচেতন মহল বুঝলেও সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা সহজ নয়। সাধারণ মানুষ সরলভাবে বুঝবে, আমাদের উন্নয়ন হলেই হলো। শাসক দলও তাদের সামনে উন্নয়নের প্রতীক হিসেবে কিছু মনুমেন্টাল প্রকল্প তুলে ধরে দেখাচ্ছে, আমাদের উন্নয়ন হচ্ছে। বাস্তবতা হচ্ছে, প্রকৃত গণতন্ত্রিক অধিকার খর্ব করে যে উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে, তাতে শাসক গোষ্ঠীর লাভ হলেও সাধারণ মানুষ গণতান্ত্রিক অন্যান্য উপাদান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। উন্নয়ন করতে গিয়ে তাদের পকেট থেকে অর্থ বের করে নিয়ে যে বেসুমার দুর্নীতি হচ্ছে, তা নিয়ে কথা বলার অধিকার বা বাকস্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে। এর কারণ হচ্ছে, মানুষ যদি কথা বলা শুরু করে, তাহলে তা শাসক গোষ্ঠীর জন্য বেকায়দার হয়ে দাঁড়াবে। মানুষের বাক স্বাধীনতার অবস্থা এখন কোথায়, তা বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে দেখানো হয়, বাকস্বাধীনতায় সর্বোচ্চ ১০০ নম্বরের মধ্যে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ পেয়েছিল ৫০ নম্বর এবং ২০২০ সালে এ নম্বর কমে দাঁড়ায় ২৬.৫৭-এ। আন্তর্জাতিক সংস্থ ফ্রিডম হাউস-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ সালে বাংলাদেশ পেয়েছে ১০০ নম্বরের মধ্যে ৪৭ এবং ২০২১ সালে পেয়েছে ৩৯। অর্থাৎ মানুষের বাকস্বাধীনতা বছরের পর বছর ধরে কমেছে। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, শাসক দলগুলো মানুষের মতামতকে কেবল অবদমিত করেছে। শুধু সাধারণ মানুষের বাকস্বাধীনতা নয়, গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকেও খর্ব করা হয়েছে। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে ২০১৫ সালে ১৮০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬৪ এবং ২০২১ সালে ১৫২। বলার অপেক্ষা রাখে না, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও বাকস্বাধীনতা খর্ব করে বা এগুলোকে পাশ কাটিয়ে যে উন্নয়ন করা হয়, তা যেমন টেকসই হয় না, তেমনি দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার রোধ করা যায় না। এক সময় এ ধরনের শাসনের অবসান হলে তার উন্নয়ন তত্তে¡র কঙ্কাল বের হয়ে আসে। বিভিন্ন দেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে পদদলিত করে স্বৈরশাসক বা কর্তৃত্ববাদী শাসকদের মূল স্লোগানই থাকে উন্নয়ন। দেখা গেছে, তাদের পতনের পর সেই উন্নয়ন যে তাদের শাসন ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা এবং দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার ছিল, তা প্রকাশ হয়ে পড়েছে। এর মূল কারণ হচ্ছে, তারা গণতন্ত্র এবং জনগণের মৌলিক অধিকারগুলো দমিয়ে রেখেছিল। এ কথা না বললেই নয়, যেনতেনভাবে নির্বাচন করে গণতন্ত্রের মোড়কে পরিচালিত সরকারের কাছে অনেক সময় স্বৈরতন্ত্রও হার মানে। তারা তখন জনগণের মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা, আইনের শাসন ভুলুণ্ঠিত করলেও বলার কিছু থাকে না।

চার.
স্বাধীনতার ৫০ বছরে দাঁড়িয়ে আমাদের সংবিধানে বর্ণিত গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সুশাসন, বাকস্বাধীনতা, আইনের শাসনের বিষয়গুলো পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়নে সরকারগুলোর আন্তরিকতার অভাব অত্যন্ত দুঃখজনক। এসব বিষয় বাস্তবায়নে সরকার ও বিরোধীদলগুলো কেবল বক্তৃতা-বিবৃতি ও পারস্পরিক দোষারোপের রাজনীতি করে চলেছে। জনগণের মৌলিক অধিকারগুলো অবারিত করার কোনো ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। এমনও নয় যে, এসব অধিকার সংকুচিত করে দেশের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সংকট থেকে পুরোপুরি মুক্ত করতে পেরেছে। এখনও দেশের অর্ধেকের বেশি জনগোষ্ঠী দরিদ্র অবস্থায় রয়েছে। এ অবস্থা হয়তো শাসক গোষ্ঠীকে সুবিধা করে দিয়েছে। দরিদ্র মানুষগুলো জীবনযাপনের টানাপড়েনে ব্যস্ত থাকায় গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা, আইনের শাসন, সুশাসন নিয়ে ভাবার সুযোগ ও সময় তাদের হয়ে উঠছে না। ফলে সচেতন মহল ও বিদেশি বিভিন্ন সংস্থাকে এসব নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ ও কথা বলতে হচ্ছে। এতে সরকারের মধ্যে সাময়িক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলেও সময় গড়ানোর সাথে সাথে তা মিলিয়ে যায়। সে তার মতো করেই শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও এ নিয়ে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া বা সমাধানের কথা বলা হয় না। তারা অপেক্ষায় থাকে কখন সরকার বিদায় নেবে এবং ক্ষমতায় যাবে। ক্ষমতায় যাওয়ার আগে সংবিধানে বর্ণিত জনগণের মৌলিক অধিকারগুলো বাস্তবায়নে কি ভূমিকা নেবে, তার কোনো সুনির্দিষ্ট রূপরেখা তারা তুলে ধরে না। দেশের ৫০ বছরেও যদি সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এ বোধোদয় না হয়, তাহলে এর চেয়ে পরিতাপের বিষয় আর কিছু হতে পারে না।

[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন