পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
এশিয়া মহাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত আমাদের বাংলাদেশকে প্রকৃতি উপহার হিসাবে দিয়েছে চোখে পড়ার মতো নৈসর্গিক বৃক্ষরাজি, দুর্লভ প্রজাতির জীব, পশু, পাখি ও উদ্ভিদ। দেশের পশ্চিমাঞ্চলে রয়েছে সবুজ সুন্দরবন, দক্ষিণে রয়েছে কক্সবাজারের বিস্তৃত সমুদ্র সৈকত। প্রাচীনকাল থেকেই এ ঐতিহ্যময় দেশে বিকশিত হয়েছে নানা ধর্মীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি। বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ঐতিহাসিক কীর্তিস্তম্ভ বা ধ্বংসাবশেষগুলোই প্রমাণ করে দেশটির অতীত শৌর্য-বীর্যের।
এ অনুপম সম্পদ ও সৌন্দর্যগুলো আমরা এতদিন নিজেরাই উপভোগ করে বিভোর হবার পাশাপাশি ‘আমরা গরিব নই’ শ্লোগান দিয়ে চলেছি। অথচ, সম পরিমাণের অথবা এর চেয়েও কম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সম্পদ নিয়ে এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশ বিকশিত করে তুলছে তাদের পর্যটনশিল্প। তারা সুপরিকল্পিতভাবে সীমিত সম্পদকে বিশ্বের চোখে এমনভাবে আকর্ষণীয় করে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে যে, সেসব দেশে দেশি-বিদেশি পর্যটকের জমজমাট গমনাগমন লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। ফলে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে প্রচুর পরিমাণে অর্থ উপার্জন সম্ভব হবার পাশাপাশি পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের পথও খুলেছে। পর্যটনের আনুসঙ্গিক বিষয়ের বাজার সৃষ্টির ফলে দেশগুলোর অর্থনৈতিক দিকে ঘটেছে অভাবনীয় পরিবর্তন। দেশে আসছে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা।
পর্যটনশিল্প যে লাভজনক, তা পৃথিবীজুড়েই স্বীকৃত হয়েছে। এর জন্য প্রয়োজন নেই যথেষ্ট পরিমাণের কাঁচামাল, উচ্চমাপের প্রযুক্তি তথা অভিজ্ঞ মানবসম্পদের। প্রকৃতির সহজাত আর কিছু পরিমাণে মানবসৃষ্ট সম্পদকে কাঁচামাল হিসেবে নিয়ে একে কৌশলপূর্ণভাবে আকর্ষণীয় রূপে বিশ্ববাসীর কাছে উপস্থাপন করতে পারলেই বিপণনযোগ্য উৎকৃষ্ট সামগ্রী হয়ে ওঠে। এগুলো করার জন্য প্রয়োজন হয় কিছু সংখ্যক নিষ্ঠাবান মানুষ আর ন্যূনতম পরিকাঠামো, যাদের উপর ন্যস্ত থাকবে পর্যটনের সম্ভাবনার স্থান নির্বাচনের দায়িত্ব। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উপর চাপ প্রয়োগ করে যাতায়াতের উন্নয়ন, যাত্রীনিবাস স্থাপন, স্থানীয় ঐতিহ্যবহনকারী বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রীর পরিকল্পিত বাজার স্থাপনের দায়িত্ব তাদের উপরে বর্তাবে। তাছাড়া এ উদ্যোক্তারা পর্যটকদের আকর্ষণ করতে জৈব-বৈচিত্র্যপূর্ণ বিভিন্ন ক্ষেত্রে, সবিশেষ তথ্য বিশ্বের চোখের সামনে তুলে ধরার জন্য প্রচার কার্যের মতো অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ কার্য সম্পাদন করবেন। আন্তঃপরিকাঠামোর উন্নয়ন, পর্যটনস্থলের নির্বাচন ইত্যাদির ক্ষেত্রে কিছু সতর্কতা প্রয়োজন হয়। উন্নয়নের ব্যয় অনুপাতে হ্রস্বকালীন আয়ের পরিমাণ যদি নগণ্য হয় তাহলে সে ধরনের পর্যটনস্থলে উন্নয়নে হাত দেওয়া উচিত নয়।
তাছাড়া, একেকটি অঞ্চলের যাতায়াত ব্যবস্থা বহুলাংশে নির্ভর করে সরকার আর স্থানীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থার উপর। প্রয়োজন সাপেক্ষে পর্যটকদের থাকা-খাওয়ার সুবিধার্থে যাত্রীনিবাস, অতিথিগৃহ নির্মাণ অন্য এক প্রয়োজনীয় বিষয়। পর্যটকদের অধিকাংশ যেহেতু সৌন্দর্যপিয়াসী আর আরামপ্রিয় হয়, তাই তারা স্বাস্থ্যকর খাদ্য, আরামদায়ক নিবাসের প্রতি আগ্রহী হয়। তাদের চাহিদার প্রতি লক্ষ রেখে বিলাসী যাত্রীনিবাস অথবা হোটেল নির্মাণ করতে হবে। এমন পর্যটক রয়েছে, যারা শুধু না জানাকে জানার অথবা না দেখাকে দেখার জন্য আগ্রহী। এছাড়া সীমিত বাজেটের কিছু পর্যটকও রয়েছে। সে সকল পর্যটকের জন্য ন্যূনতম সুবিধার যাত্রীনিবাস, অতিথিগৃহের প্রয়োজন হয়। এ দ্বিতীয় শ্রেণীর নিবাসগুলো বিত্তবান আর মধ্যবিত্ত উভয়ের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম। এ দু’ ধরনের নিবাস স্থাপনের জন্য সরকারি-বেসরকারি উভয় পর্যায়ে উদ্যোগ নেয়া যায়।
যোগাযোগ আর তথ্য-প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতির ফলে সমগ্র বিশ্ব একটি গ্রামে পর্যবসিত হওয়ার মুহূর্তে বিশ্ব পর্যটনের ক্ষেত্রে স¤প্রতি ‘ইকো-ট্যুরিজম’ নামের এক নতুন ধারণা প্রবর্তিত হয়েছে, যা বর্তমানে বিশ্ব পর্যটন ক্ষেত্রে এক শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এ ব্যবস্থায় ভূভাগের সে অঞ্চলগুলোকে অর্ন্তভুক্ত করা হয়, যেখানে এতদিনে প্রাকৃতিক সম্পদরাজি আপেক্ষিকভাবে অক্ষত অবস্থায় সংরক্ষিত হয়ে রয়েছে, অথচ সে সম্পদের যথোপযুক্ত ব্যবহারের মাধ্যমে সে অঞ্চলগুলো ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত পর্যটনস্থলের নিকটবর্তী হয় তা হলে নতুন এক লাভজনক পর্যটনক্ষেত্র গড়ে ওঠার সম্ভাবনা বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। এ নতুন পর্যটন ক্ষেত্রের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের সুবিধা দেয়া, এখানে থাকা পশুপাখি, উদ্ভিদাদির বিষয়ে জ্ঞান লাভের সুযোগ দেয়ার পাশাপাশি এ অঞ্চল তথা নিকটবর্তী অঞ্চলের সামাজিক রীতিনীতি, ঐতিহ্য, পারস্পরিক কৃষ্টি-সংস্কৃতি সম্পর্কীয় অনুষ্ঠান পরিবেশনের দ্বারা মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা করার উপর ইকো-ট্যুরিজম বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়।
এ ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য উপাদান হলো স্থানীয় বাসিন্দাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ। কেন না, সংরক্ষিত প্রাকৃতিক পরিবেশ যে পর্যটনের মূলউপজীব্য, সে ধারণাটি তখন এ লোকদের মনে দৃঢ়ভাবে প্রবেশ করবে। প্রকৃতির প্রতি প্রেম আর আর্থিক লাভালাভের চিন্তায় স্থানীয় লোকদের উদ্বুদ্ধ করতে পারলে বাইরে থেকে কোনো ধরনের সংরক্ষণ ব্যবস্থার প্রয়োজন পড়বে না। এর ফলে তারা ইকো-ট্যুরিজমের সমগ্র প্রক্রিয়াটির শুধু অংশগ্রহণকারী নয় এর অংশীদার হয়ে পড়বে। স্থানীয়ভাবে পাওয়া দ্রব্যসামগ্রীর দ্বারা নির্মিত আর সীমিত পরিসরে সুবিধা প্রদানের দ্বারা একেকটি আকর্ষণীয় পর্যটন ক্ষেত্র গড়ে তুলতে পারাটা ইকো-ট্যুরিজমের অন্য এক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।
আজকাল পরিবেশানুকূল পর্যটন ব্যবস্থায় বিভিন্ন ক্ষুদ্র অথবা মাঝারি ধরনের কর্মসংস্থানের অজস্র সুযোগ-সুবিধা বেরুচ্ছে। এর ফলে বৃহৎ সংখ্যক কর্মপ্রার্থী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এতে জড়িত হয়ে পড়ছে। সাধারণ একজন পর্যটক সুবিধাজনক যাতায়াত, আরামদায়ক অথচ সহজলভ্য থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থার প্রতি লক্ষ রেখে একটি স্থানের প্রতি আকর্ষিত হয়। অন্যদিকে, একজন ইকো-ট্যুরিস্ট যে কোনো একটি অঞ্চলের সৌন্দর্য, কৃষ্টি-পরম্পরা, ঐতিহ্য ইত্যাদির প্রত্যক্ষ স্বাদ স্বাভাবিক আর অপরিবর্তনীয় রূপে পেতে আগ্রহী হয়। স্থানীয় ইতিহাস আর ভৌগোলিক জ্ঞান সমৃদ্ধ যুবক-যুবতীরা অনায়াসে পর্যটকদের পথ প্রদর্শক রূপে নিযুক্ত হয়ে বেকার সমস্যা সমাধানে উল্লেখযোগ্য অবদান যোগাতে যে সক্ষম হবে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। উল্লেখ্য, পর্যটনের সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে আজ অনেক শিক্ষিত যুবক-যুবতী নিয়োজিত হয়েছে, যা গৌরবের বিষয়। বহু জাতি-উপজাতি, গোষ্ঠি-উপগোষ্ঠির মিলনভূমি তথা ঐতিহ্যময় স্বকীয় ভাষা-সংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ নীল পাহাড়ের এখানে প্রকৃতি দিয়েছে শুধু সবুজ আর সবুজ যার সৌন্দর্য তুলনাবিহীন। সময়োপযোগী সরকারি দৃঢ় পদক্ষেপ তথা নিষ্ঠাবান অগ্রণী ব্যক্তি, অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠানের সুপরিকল্পিত এবং ঐকান্তিক সমন্বয়ের মাধ্যমে সামান্য সম্পদকে যথোপযুক্ত সুব্যবহার করে দেশের পর্যটন ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিকে আরো অধিক ত্বরান্বিত করার সময় এখন সমাগত। এর জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের সততা ও আন্তরিকতা এবং দেশপ্রেম থাকা দরকার।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।