পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
দক্ষিণ আফ্রিকায় স্বেতাঙ্গ সংখ্যালঘু শাসনের বিরুদ্ধে নেলসন মেন্ডেলার রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রামের পাশাপাশি যে সব ধীমান মানবিক কণ্ঠস্বর বিশ্ব জনমতকে নাড়া দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে আর্চ বিশপ ডেসমন্ড টুটু অন্যতম। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী স্বৈরশাসন বিরোধী সংগ্রামের পাশাপাশি বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তের নিপীড়িত মজলুম মানুষের পক্ষে তিনি আমৃত্যু কথা বলেছেন। ১৯৮৪ সালে নেলসন মেন্ডেলা যখন পলসমুর কারাগারে অবরুদ্ধ, তখন নোবেল শান্তি পুরষ্কারে ভ’ষিত করার মধ্য দিয়ে বিশ্বসম্প্রদায় এই নৈতিক-মানবিক ব্যক্তিত্বকে যথাযথ মর্যাদায় অভিসিক্ত করেছিল। এর এক দশক পর ১৯৯৪ সালে বর্ণবাদ বিরোধি আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস নেতা নেলসন মেন্ডেলাকেও শান্তিতে নোবেল পুরষ্কারে ভ’ষিত করা হয়। মন্ডেলা ২০১৩ সালে জোহানেসবার্গে মৃত্যুবরণ করেন। নেন্ডেলার অন্যতম আদর্শিক সহযোদ্ধা ডেসমন্ড টুটু গত রবিবার ৯০ বছর বয়েসে জোহানেসবার্গে পরলোক গমন করেছেন। এই মহান ব্যক্তিত্বের আত্মার প্রতি আমরা গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। মেন্ডেলার পাশে ডেসমন্ড টুটুর মত মহান ব্যক্তিত্বরা ছিলেন শত বছরের স্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী শাসনে চরমভাবে নিপীড়িত-নির্যাতিত সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষ্ণাঙ্গরা প্রবল অত্যাচারি স্বেতাঙ্গদের সাথে রাজনৈতিক সমঝোতা ও সহাবস্থানের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রৃথ এন্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন(টিআরসি) রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক দ্বন্দ নিরসন করে প্রতিশোধ, প্রতিহিংসার বদলে শান্তি ও সহাবস্থানের বহুপাক্ষিক গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করার অন্যতম উদাহরণ। পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শাসনের এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোতে যে সামাজিক-রাজনৈতি ও অর্থনৈতিক বৈষম্য ও অস্থিতিশীলতার জন্ম হয়েছিল দেশে দেশে তা দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দ্বন্দ-সংঘাতের জন্ম দিয়েছিল। এরপর স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের সংগ্রাম রক্তক্ষয়ী রাজনৈতিক আন্দোলন থেকে রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের পটভ’মি রচনা করেছে। সে সব যুদ্ধে ও লড়াই-সংগ্রামে লাখো মানুষের মৃত্যু, হতাহতের ঘটনাবলী সমাজ ও রাষ্ট্রদেহে দগদগে ক্ষতচিহ্ন এঁকে দিয়েছে। সেই ক্ষত মুছে দিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজকে শান্তির পথে সমৃদ্ধতর ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় থেকেই রিকনসিলিয়েশন বা রাজনৈতিক সমঝোতার কোনো বিকল্প থাকে না। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদি দখলদারিত্বের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসিরা প্রায় বিলুপ্তির পথে। ঔপনিবেশিক ও আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সাথে তাদের ঐতিহাসিক-সাংস্কৃতিক বিরোধ অগ্রাহ্য করা যায়নি। অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার নাগরিক ও রাজনৈতিক পক্ষগুলো এ বিষয়ে রিকনসিলিয়েশনের ধারণাকে সামনে রেখে কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ আফ্রিকার মাইলফলক অর্জন সংঘাতপূর্ণ বিশ্বের কাছে শান্তির অন্যতম দৃষ্টান্ত হিসেবে আখ্যায়িত হতে পারে।
ঊনবিংশ শতকের শুরু থেকে বিংশ শতকের শেষ দশক পর্যন্ত বৃটিশ ঔপনিবেশিক দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাস হচ্ছে, শতকরা ১০ ভাগ সাদা চামড়ার শাসকশ্রেণীর দ্বারা শতকরা ৯০ ভাগ কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানের দেড়শ বছরের বেশি সময় ধরে শাসিত, নির্যাতিত ও নিগৃহিত হওয়ার ইতিহাস। বর্ণ ও ধর্মীয় বিভাজনকে কাজে লাগানোর পাশাপাশি শাসকগোষ্ঠির অভ্যন্তরে পারস্পরিক দ্বন্দ, ক্ষমতা ও অর্থলিপ্সার টোপ দিয়ে বৃটিশ বেনিয়ারা ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে নবাব সিরাজদ্দৌলাকে পরাজিত করার পর পৌনে দুইশ বছর ধরে শাসন টিকিয়ে রাখতে ডিভাইড অ্যান্ড রোল পলিসি গ্রহণ করেছিল। দেশে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ছদ্মাবরণে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অনুগত রাজনৈতিক গোষ্টিগুলো এখনো সমাজ ও রাষ্ট্রকে দুর্বল করে পুঁজিবাদী সংখ্যালঘু শ্রেণীর স্বার্থে রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার ফর্মুলা কায়েম রেখে চলেছে। নেলসন মেন্ডেলা ও ডেসমন্ড টুটু সেই অদৃশ্য আদর্শিক শক্তিকে যথাযথভাবে চিহ্নিত করেই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও জাতীয় ঐক্যের জন্য সামাজিক-রাজনৈতিক রিকনসিলিয়েশনের অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস নেতা নেলসন মেন্ডেলা তার দেশের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অধিকারের পক্ষে লড়াই করতে গিয়ে তিনদশক ধরে জেলের ভেতর কাটিয়েছেন। অন্যদিকে শতকরা ৮০ ভাগ ক্যাথলিক ধর্মীয় নেতা ডেমন্ডমন্ড টুটু রাজনীতির রক্তচক্ষুকে পাশ কাটিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে অধিকার ও নৈতিক মূল্যবোধের গণতান্ত্রিক শাসনের চেতনাকে প্রোথিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর প্রজ্ঞা ও সংগ্রাম তাঁকে বিংশ শতকের অন্যতম শান্তির পথিকৃতের ভ’মিকায় উত্তীর্ণ করেছিল। তিনিই প্রথম জোরের সাথে বলেছেন, ‘নো ফিউচার উইদাউট ফরগিভনেস’। এ শিরোনামে ডেসমন্ড টুটুর লেখা গ্রন্থটি আমাদের মত অধ:পতিত রাজনৈতিক জনগোষ্ঠির রাজনৈতিক নেতাদের অবশ্য পাঠ্য। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী শাসন শেষ হওয়ার পর প্রায় দৃইশ বছর নির্যাতিত-নিগৃহিত হওয়ার প্রতিশোধ ও আক্রোশ যেন রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল, ভঙ্গুর ও দুর্বল করে না ফেলে, সেই লক্ষ্যেই টিআরসি গঠিত হয়েছিল। টিআরসি’ র চেয়ারম্যান হিসেবে এবং একজন প্রজ্ঞাবান নাগরিক হিসেবে ডেসমন্ড টুটুর দৃষ্টিভঙ্গি উঠে এসেছে ‘নো ফিউচার উইদাউট ফরগিভনেস’ গ্রন্থে। টুটু অতীতকে ভুলে যাওয়ার কথা বলেননি, অতীতের ভুল-ত্রæটি স্মরণে রেখে নিজেদের সংশোধন ও প্রতিপক্ষকে মার্জনা করে জাতির সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের যাত্রা সমুন্নোত রাখাই হচ্ছে জাতীয় ঐক্য ও সহাবস্থানের মূল লক্ষ্য।
২০১৭ সালে রাখাইন অঞ্চলে বার্মিজ জান্তা সরকারের ব্যাপক এথনিক ক্লিনজিংয়ের মুখে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার বহু আগে থেকেই সেখানে গণহত্যা চলছিল। রোহিঙ্গাদের জাতিগত নিধন প্রক্রিয়ার প্রতি তীক্ষ্ন দৃষ্টি ছিল ডেসমন্ড টুটুর। ২০১৫ সালে মার্কিন সাময়িকী নিউজউইকে প্রকাশিত টুটুর লেখা নিবন্ধের শিরোনাম ছিল, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নিরব গণহত্যা (‘দ্য ¯েøা জেনোসাইড এগেইন্স্ট দি রোহিঙ্গা’)। সে সময় হাজার হাজার রোহিঙ্গা সমুদ্রপথে ইন্দোনেশিয়া-মালয়েশিয়া পাড়ি দেয়ার দৃশ্যের বর্ণনা দিয়েছিলেন টুটু। তিনি লিখেছেন- ‘ এ কান্ট্রি দ্যাট ইজ নট অ্যাট পিস উইদ ইটসেল্ফ, দ্যাট ফেইলস টু অ্যাকনোলেজ অ্যান্ড প্রটেক্ট দ্য ডিগনিটি অ্যান্ড র্ওথ অব অল ইটস পিপল, ইজ নট অ্যা ফ্রি কান্ট্রি। ফ্রিডম ইজ ইন্ডিভিজিবল। অল মাস্ট বি ইনভাইটেড।’ অর্থাৎ- ‘রাষ্ট্র যদি ভেতর থেকে শান্তিকে ধারণ করতে না পারে, সে যদি তার সব নাগরিকের মর্যাদা ও নিরাপত্তাকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, তাকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র বলা যায় না। রাষ্ট্রের স্বাধীনতা হচ্ছে অবিভাজ্য সত্তা। এখানে প্রবেশাধিকার সকলের সমান।’ রাষ্ট্র পরিচালকদের ক্ষীন দৃষ্টিভঙ্গি যে রাষ্ট্রকে দুর্বল ও ভঙ্গুর করে তোলে তা বোঝার ক্ষমতা মিয়ানমারের সরকার বা সামরিক কমান্ডারদের না থাকলেও টুটুর মত প্রজ্ঞাবান মনীষি যথাসময়ে আঁচ করে অং সান সুচিকে সতর্ক করেছিলেন। ২০১৭ সালে ডেসমন্ড টুটু সুচিকে চিঠি লিখে, মিয়ানমারে গিয়ে তার সাথে দেখা করে এ বিষয়ে তার বক্তব্য রেখেছিলেন। টুটু, বান কি মুনের মত বিশ্বব্যক্তিত্ব ছাড়াও আন্তর্জাতিক নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকেও রোহিঙ্গা গণহত্যা বন্ধ করে রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার পক্ষে বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে জোরালো দাবি উঠে এসেছে। সে সব ঐতিহাসিক সত্য বা ফ্যাক্টসগুলোকে অস্বীকার করে রোহিঙ্গাদের রাষ্ট্রহীন-নাগরিকত্বহীন করে তোলা বা রাখাইন থেকে বিতাড়িত করার ন্যুনতম আইনগত, ঐতিহাসিক বা মানবিক অবস্থান তাদের পক্ষে কেউ দেখাতে পারেনি। রোহিঙ্গাদের বর্তমান দুর্দশার জন্য সীমান্তরেখা নির্ধারণ ও জাতিগত অধিকার প্রতিষ্ঠায় বৃটিশদের অপরিনামদর্শি ভ’মিকার কথাই তুলে ধরেছেন ডেসমন্ড টুটু। টেবিলে বসে কলমের খোঁচায় সীমান্তরেখা নির্ধারণকালে রাখাইনের ভ’মিপুত্র রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিষয়টি অগ্রাহ্য করা হয়েছিল। অথচ বার্মার স্বাধীনতার পর ১৯৪৮ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত চলা প্রথম সামরিক জান্তা শাসকরাও রোহিঙ্গাদের আদিবাসি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। সে সব নির্বাচনে পার্লামেন্টে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্বও ছিল। তবে ভেতরে ভেতরে রোহিঙ্গাদের বার্মার ভ’-খন্ড থেকে নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা বৃটিশদের ধারাবাহিকতায় বার্মিজ রাজনীতিক-সামরিক নেতাদের মধ্যেও সক্রিয় ছিল। ডেসমন্ড টুটু তার নিবন্ধে লিখেছেন, ১৯৭৮ সালে ফার-ইস্ট ইকোনমিক রিভিওতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বার্মায় রোহিঙ্গাদের জাতিগত নিস্পেষণের বর্ণনা উঠে এসেছিল। এর কয়েক বছর পর বার্মিজ জান্তা সরকার নতুন সিটিজেনশিপ আইনে ইন্ডিজেনাস বার্মিজদের তালিকা থেকে রোহিঙ্গাদের বাদ দিয়ে তাদেরকে প্রতিবেশি দেশ বাংলাদেশ থেকে আসা অভিবাসি বলে দাবি করা হয়। আরাকান বা রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ইতিহাস প্রায় হাজার বছরের।
প্রায় অর্ধশত বছর ধরে বার্মিজ সামরিক জান্তা ও বর্ণবাদী বৌদ্ধিস্টদের দ্বারা জাতিগত নির্মূল পরিকল্পনার শিকার। বার্মার স্বাধীনতার অন্যতম স্থপতি অং সানের কন্যা সু-চি সে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অনেক ত্যাগ ও সাগসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। বিশ্বের মানুষ মনে করেছিল, সু-চির হাত ধরে বার্মায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে সেখানে জাতিগত বৈষম্য দূর হবে, রাজনৈতিক কারণে কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও মানবাধিকারের সংকট দূর হবে। সে কারণেই জান্তা বিরোধি সু চিকে নোবেল শান্তি পুরষ্কারে ভ’ষিত করা হয়েছিল। নোবেল কমিটি ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানও তাকে বিভিন্নভাবে সম্মানীত করেছিল। কিন্তু তার শাসনামলেই ২০১৭ সালে এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড়, ন্যক্কারজনক রোহিঙ্গা গণহত্যার ঘটনা ঘটেছিল। সে সময় ডেসমন্ড টুটু সুচির নিরবতায় বিষ্ময় প্রকাশ করে লিখেছিলেন, ‘ ‘সাইলেন্স ইজ টুও হাই এ প্রাইজ’। সুচি সে সতর্ক বার্তা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাকে এবং তার দেশকে এখন উচ্চ মূল্য দিতেই হচ্ছে। মিয়ানমারে আজকের রাজনৈতিক বাস্তবতাই প্রমান করে তাদেরকে এখন সে সব নির্মমতা, রাষ্ট্রীয় সহিংসতা ও গণহত্যার মূল্য কিভাবে দিতে হচ্ছে। শুধুমাত্র নোবেল পুরস্কারের স্মারকটি ছাড়া বিশ্বের কাছ থেকে পাওয়া সব সম্মাননা ও মর্যাদা ইতিমধ্যেই হারিয়েছেন সু চি। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী এখন অন্তত ১০টি এথনিক ফ্রন্টে প্রতিরোধের সম্মুখীন হচ্ছে। মাঝে মধ্যেই ব্যাপক প্রতিরোধ ও রক্তক্ষীয় সংঘাতের খবর প্রকাশিত হচ্ছে। নিজদেশের বিভাজিত শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে মিয়ানমার একদিন সাম্রাজ্যবাদী অর্থনৈতিক শক্তির পিঠাভাগের শিকার হয় কিনা তাই এখন দেখার বিষয়। মিয়ানমারের পাশাপাশি বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এই আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। সামরিক জান্তার রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অং সান সুচির নিরবতা বা নিরব সমর্থনের চরম খেসারতের সতর্ক বার্তা দিয়েছিলেন টুটু। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী এবং তার ডি-ফ্যাক্টো নেতাদের এখন সেই খেসারত গুনতে হচ্ছে।
বিশ্বে মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মানবিক মর্যাদা রক্ষার কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আর্চ বিশপ ডেসমন্ড টুটুর ভ‚মিকা দেশকালের সীমারেখা অতিক্রম করে আবহমানকালের অনুপ্রেরনার উৎস হয়ে থাকবে। সুদীর্ঘদিন ধরে তিনি বিশ্বের জ্ঞানী-গুনীজনদের দ্বারা উদ্ধৃত হয়ে আসছেন। ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত মার্কিন ধর্মত্বাত্তি¡ক রবার্ট ব্রাউন ম্যাকাফি’র একটি গ্রন্থে ডেসমন্ড টুটুর একটি উক্তি উদ্ধৃত করেছেন, উক্তিটি হচ্ছে- ‘তুমি যদি অবিচার-অনাচারের সময় নিজেকে নিরপেক্ষ বলে দাবি করতে চাও, তাহলে নিশ্চিতভাবেই তুমি অত্যাচারির পক্ষাবলম্বন করছ। হাতির পা যদি ইঁদুরের লেজের উপর পড়ে, আর যদি বল তুমি নিরপেক্ষ, তখন ইঁদুর নিশ্চয়ই তোমার তথাকথিত নিরপেক্ষতাকে সমর্থন করবে না।’ আফ্রিকায় পশ্চিমা উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা, কেনিয়ার প্রথম প্রেসিডেন্ট, জুমো কেনিয়াতার একটি উক্তিকে টুটু প্রায়শ উদ্ধৃত করতেন, সেটি হচ্ছে- ‘মিশনারীরা যখন প্রথম আফ্রিকায় এসেছিল, তাদের হাতে ছিল বাইবেল এবং আমাদের ছিল জমি। তারা বলল, আস আমরা প্রার্থনা করি, আমরা প্রার্থনায় চোখ বন্ধ করলাম, যখন চোখ খুললাম, দেখলাম আমাদের হাতে বাইবেল, ওদের হাতে জমি’। এভাবেই ভিনদেশি চাতুরিতে দেশে দেশে সম্পদ ও স্বাধীনতা হারিয়ে যায়। স্বাধীনতার অভিভাজ্য সামগ্রিকতাকে উপলব্ধি করতে না পারা নেতৃত্ব কখনো জাতির সমৃদ্ধির সম্ভাবনাকে অক্ষুন্ন রাখতে পারেনা। নেলসন মেন্ডেলা ও ডেসমন্ড টুটুরা শুধু দক্ষিণ আফ্রিকার সম্পদ নন, তারা বিশ্বের সম্পদ। বিশ্বের অনেক গলাবাজ রাজনৈতিক নেতা আছেন, কর্পোরেট ধনকুবের আছেন, উচ্চ ডিগ্রীধারি অধ্যাপক, ধর্মবেত্তা আছেন। কিন্তু বর্তমান ও অনাগত বিশ্বে টুটুর মত আরেকজন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা তা বলা মুস্কিল। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা কি রিকনসিলিয়েশনের মানে বোঝেন? না বুঝলে মেন্ডেলা ও টুটুর জীবন ও সাধনার পথ ও রচনাগুলো তাদের পাঠ্য হওয়া উচিৎ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।