Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পদে পদে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ২৭ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:০৩ এএম

মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারগুলোকেই আমরা মানবাধিকার বলি। এই মৌলিক অধিকারগুলো হলো: নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মর্যাদাপূর্ণ জীবন ধারণের স্বাধীনতার অধিকার, ব্যক্তিজীবনে নিরাপত্তার অধিকার, অন্য ব্যক্তির দাসত্ব ও অত্যাচার থেকে রক্ষা পাওয়ার অধিকার, শিক্ষা ও জীবিকার অধিকার, ধর্ম-পালন এবং বিবাহের অধিকার ইত্যাদি। মানুষের এই মৌলিক অধিকারগুলোই হলো ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ কর্তৃক মানবাধিকার সনদের মর্মবস্তু। মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো শুধুমাত্র ব্যক্তি জীবনের জন্যই নয়। দেশ বা জাতির ক্ষেত্রেও কয়েকটি অধিকার অত্যাবশ্যকীয়। যেমন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা বা সার্বভৌমত্ব প্রতিটি দেশের মৌলিক অধিকার। সেক্ষেত্রে প্রতিটি জাতির সাংস্কৃতিক এবং শিক্ষাগত নিজস্বতা রক্ষার অধিকার থাকা একান্ত প্রয়োজনীয়। এইসব অধিকারের উপর কোনো রকম হস্তক্ষেপ মানবাধিকার লঙ্ঘন ছাড়া আর কিছু নয়। জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ গৃহীত হওয়ার বহু আগে বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নে সর্বপ্রথম শোষিত-নিপীড়িত মানুষের কাজের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, বাসস্থানের অধিকার, স্বাস্থ্যের অধিকার প্রভৃতি মানবাধিকারের মৌলিক উপাদানগুলোকে পরিপূর্ণ স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। লিঙ্গ বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে স্বীকৃত হয় নারীর পূর্ণ অধিকার। চীন, কিউবা ও অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ইতিবাচক ভূমিকা নিয়েছে। কিন্তু বিশ্বের কোনো পুঁজিবাদী দেশের সরকার নিজের দেশে মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে দায়বদ্ধতার পরিচয় দেয়নি। এমনকি, ভেঙে যাওয়া সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে উদ্ভূত রাষ্ট্রগুলোতে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তনের পর মানবাধিকারের অবনতি ঘটেছে। ১৭৮৯-এ ফরাসি বিপ্লবের মাধ্যমে ফ্রান্সের স্বৈরতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের পতন ঘটেছিল। নবোদিত ফরাসি বুর্জোয়া শ্রেণি সংবিধান রচনার মাধ্যমে একটি প্রতিনিধিমূলক আইনসভা গড়ে তুলতে চেয়েছিল। গড়ে তুলতে চেয়েছিল একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র। এই প্রয়াসের পরিণতি হিসাবে জন্ম নিয়েছিল সংবিধান সভা বাConsititutent Assembly (১৭৮৯-১৭৯১) । সংবিধান সভার সদস্যরা নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই সংবিধান সভা গড়ে ওঠার প্রাক্কালে একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল জারি করা হয়। দলিলটি মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকারের ঘোষণাপত্র বা Declaration of the Rights of Man and Citizen নামে পরিচিত। অনেকেই মনে করেন, এই দলিলটি ছিল নতুন সংবিধানের প্রস্তাবনা। দলিলে তিনটি কথা বলা হয়েছিল। (এক) সকল মানুষ জন্মগত স্বাধীন এবং চিরকাল স্বাধীন থাকবে, (দুই) সকল মানুষের সমান অধিকার এবং (তিন) সংবিধান সভা বিশ্বের সমস্ত নির্যাতিত মানুষের প্রতি তার ভ্রাতৃত্বের কথা জানান দিচ্ছে। এই ঘোষণাপত্র থেকে তিনটি মূলনীতি সহজেই বেরিয়ে আসে- স্বাধীনতা, সাম্য এবং ভ্রাতৃত্ব।

আমরা যদি ঊনিশ শতকের বিশ্ব ইতিহাসের পাতা ওলটাই তাহলে দেখব, মানব জাতির অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সমানাধিকার স্বীকৃত হয়নি। ইউরোপ ও আমেরিকায় তখনও ক্রীতদাস প্রথা থেকে গিয়েছিল। নেপোলিয়ান বোনার্পোটের পতনের পর ১৮১৫ সালে ইউরোপে যে ভিয়েনা সম্মেলন বসেছিল, তাতে ক্রীতদাস প্রথা উচ্ছেদের সপক্ষে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। এই প্রস্তাব গ্রহণের পেছনে শিল্পোন্নত ব্রিটেনের চাপ কাজ করছিল। কিন্তু একথা মনে করা সঠিক হবে না যে, ব্রিটেন গভীর মনবতাবোধের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে ক্রীতদাস প্রথা তুলে দেওয়ার জন্য সরব হয়েছিল। সে সময় দাস ব্যবসা ব্রিটেনের কাছে বিশেষ লাভজনক ছিল না। ব্রিটেন দাসপ্রথার উচ্ছেদ চেয়েছিল যাতে ব্রিটেনের দরিদ্র মানুষেরা সেখানে শিল্প-বিল্পবের পর গড়ে ওঠা নতুন কারখানাগুলোতে তাদের মুক্ত শ্রম বিক্রি করতে পারে। তা ছাড়া ভিয়েনা চুক্তি (১৮১৫) অনুযায়ী দাস প্রথার উচ্ছেদ স্বীকৃত হলেও অধিকাংশ দেশেই এই প্রথা থেকে গিয়েছিল।

ঊনিশ শতকের ইউরোপীয় নারীরা ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। তাছাড়াও নারীরা নানাবিধ বঞ্চনার শিকার হত। শিল্প ও খনিতে কর্মরত নারী শ্রমিকরা পুরুষ শ্রমিকদের থেকে কম মজুরি পেত। দরিদ্র মেহনতি মানুষও নানা ধরনের বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হতো। তাদের ভোটাধিকার ছিল না, কারণ সাধারাণত সম্পত্তির ভিত্তিতে ভোটাধিকারই স্বীকৃত ছিল। এমনকি শ্রমজীবীদের সংগঠিত হওয়ার জন্য ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের অধিকারও ইউরোপীয় কোনো রাষ্ট্র ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকে মেনে নেয়নি। বিশ শতকের প্রথমার্ধেও পাশ্চাত্য পুঁজিবাদী দেশগুলো নাগরিকদের আর্থ-সামাজিক অধিকারগুলোকে স্বীকৃতি দেয়নি। কাজের অধিকার, নারী ও পুরুষের সমান মজুরির অধিকার, সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকার ইত্যাদি উন্নত পাশ্চাত্য দেশগুলোর সংবিধানে স্থান পায়নি। কিন্তু এই সমস্ত দেশের নাগরিকরা উপরোক্ত অধিকারগুলো আদায়ের সুদীর্ঘ সংগ্রামের অবতীর্ণ হয়েছিল। একদিকে গণআন্দোলনের চাপ, অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার উত্থান, পাশ্চাত্য পুঁজিবাদী দেশগুলো স্বীকৃতি দিতে বাধ্য করেছিল।

সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো উপরোক্ত অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকারগুলোকে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকার করে নিয়েছিল। ফলে এক বিরাট সংখ্যক দরিদ্র মানুষ সমাজতান্ত্রিক শিবিরের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। পাশ্চাত্য পুঁজিবাদী দেশগুলোও নাগরিকের আর্থ-সামাজিক অধিকারগুলোকে স্বীকৃতি দিয়েছিল; কিন্তু সেগুলো মৌলিক অধিকার হিসাবে মেনে নেয়নি। এই দেশগুলোতে আর্থ-সামাজিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে নাগরিকদের আদালতে যাওয়ার অধিকার ছিল না। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর জাতিসংঘ গঠিত হয়। জাতিসংঘ গঠিত হবার পরই সদস্য রাষ্ট্রগুলো মানবাধিকার রক্ষার বিষয়ে আলাপ আলোচনা শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিধ্বংসী পরিণতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে আতঙ্কিত করেছিল। এই আতঙ্কই তাদের মানবাধিকার রক্ষার বিষয়ে সচেতন করে তুলেছিল। ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ সভা ((General As-sembly)) প্যারিসে মানবাধিকার সংক্রান্ত ত্রিশটি অনুচ্ছেদ নিয়ে একটি সনদ প্রকাশ করে। এই ত্রিশটি অনুচ্ছেদ হলো: ১) সমানাধিকার, ২) বৈষম্য থেকে স্বাধীনতার অধিকার ৩) জীবনের স্বাধীনতা, ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অধিকার, ৪) দাসত্ব থেকে মুক্তির অধিকার, ৫) অত্যাচার থেকে স্বাধীন হওয়ার অধিকার, ৬) আইনের চোখে স্বীকৃতি পাওয়ার অধিকার, ৭) আইনের চোখে সকলের সমানাধিকার, ৮) যোগ্য ট্রাইব্যুনাল দ্বারা সমাধানের অধিকার, ৯) বিধিবর্হিভূত গ্রেফতার এবং যাবজ্জীবনের বিরুদ্ধে অধিকার, ১০) ভালো মকদ্দমার শুনানি শ্রবণের অধিকার, ১১) দোষী সাব্যস্ত না-হওয়া পর্যন্তনির্দোষ বিবেচিত হওয়ার অধিকার, ১২) গোপনীয়তা বজায় রাখার অধিকার, ১৩) স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার অধিকার, ১৪) অত্যাচার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অপর দেশে আশ্রয়প্রার্থী হওয়ার অধিকার, ১৫) নাগরিকত্বের অধিকার, ১৬) বিবাহ ও পারিবারিক সুরক্ষার অধিকার, ১৭) নিজস্ব সম্পত্তির অধিকার, ১৮) ধর্মাচরণের অধিকার, ১৯) মতামত প্রকাশের অধিকার, (২০) শান্তিপূর্ণভাবে সংগঠন এবং সমবেত হওয়ার অধিকার, ২১) সরকারের কাজে অংশগ্রহণ করার অধিকার, ২২) সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, ২৩) কাজ করার অধিকার, ২৪) বিশ্রাম নেওয়ার অধিকার, ২৫) সুস্থ শরীরে বাঁচার অধিকার, ২৬) শিক্ষার অধিকার, ২৭) সংস্কৃতিমূলক কাজে অংশগ্রহণের অধিকার, ২৮) সামাজিক ও আন্তর্জাতিক অনুশাসন মানার অধিকার , ২৯) কমিউনিটির প্রতি দায়িত্ববোধের অধিকার এবং ৩০) উপযুক্ত সনদে ঘোষিত নীতি লঙ্ঘন না-করার অধিকার। এই সনদ মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা বা ((Universal Declaration of Human Rights)) নামে পরিচিত। প্রাথমিকভাবে এই সনদে ৩০টি ধারা ছিল। পরবর্তীকালে জাতিসংঘের মানবিধকার রক্ষার বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়।

মানবাধিকার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও পদে পদে মানবাধিকার লঙ্ঘিত ও পদদলিত হচ্ছে, এই বিষয়ে চিন্তা করতে হবে এবং মানবাধিকারের লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে এগিয়ে আসতে হবে। যে সমস্ত দুর্বল শ্রেণির মানুষ স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পানীয় পানি ও পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে পিছিয়ে রয়েছে, তাদের উন্নয়ন ও সচেতন করে তুলতে না-পারলে মানবাধিকতাবোধ অপূর্ণই থেকে যাবে। আজ সমাজের সবস্তরের মানুষকে অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন ও সজাগ দৃষ্টি নিয়ে সংঘবদ্ধ হতে হবে যাতে মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিহত করা যায়। সর্বস্তরের মানুষের সচেতনতা এবং উন্নয়নের মাধ্যমেই মানবাধিকার রক্ষার প্রয়াস সফল করা সম্ভব হতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।



 

Show all comments
  • jack ali ২৯ ডিসেম্বর, ২০২১, ১০:১৭ পিএম says : 0
    Allah law guarantees 100% human right. Enemy of Allah is ruling our beloved country as they have turned our country like living hell. O'Allah install a Muslim ruler who will rule by Qur'an so that we can live in our country without any fear with human dignity.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন