Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রচেষ্টা সফল করতে হবে

আবু নাসের অনীক | প্রকাশের সময় : ২৭ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:০৩ এএম

বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্য বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার, যা বর্তমানে করোনাসংক্রমণের চেয়েও বেশি ভয়াবহ। মানুষের শরীরে তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব কাজ করে ধীরে ধীরে, যে কারণে তাৎক্ষণিকভাবে এর নেতিবাচক প্রভাব প্রত্যক্ষ করা যায় না।

বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটি’র ‘দ্য ইকোনমিক কস্ট অফ টোবাকো ইউজ ইন বাংলাদেশ: আ হেলথ কস্ট অ্যাপ্রোচ’ শীর্ষক গবেষণায় জানা যায়, তামাক ব্যবহারের কারণে ২০১৮ সালে বাংলাদেশে প্রায় ১ লক্ষ ২৬ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে, যা সেই বছরের মোট মৃত্যুর ১৩.৫%। একই বছরে প্রায় ১৫ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহারজনিত রোগে এবং প্রায় ৬২ হাজার শিশু পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়ে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। তামাক ব্যবহারের কারণে স্বাস্থ্যখাতে মোট ব্যয়ের পরিমাণ ওই বছরে ছিলো প্রায় ৮ হাজার ৪শ’ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭৬% খরচ বহন করেছে ব্যবহারকারীর পরিবার আর ২৪% মেটানো হয়েছে জনস্বাস্থ্যের বাজেট থেকে।

তামাক ব্যবহারজনিত অসুস্থতা ও এর কারণে অকালমৃত্যুর ফলে বার্ষিক উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায় প্রায় ২২ হাজার ২শ কোটি টাকা। ফলে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতি ছিলো ৩০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। এর বিপরীতে ২০১৮ সালে দামের হিসাবে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জিডিপিতে তামাক খাতের অবদান ছিলো ২২ হাজার ৯শ’ কোটি টাকা। এই খাতে অর্থনৈতিক ব্যয়ের চেয়ে আয় কম হয়েছে ৭ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। এই তথ্যকে পাশ কাটিয়ে তামাক কোম্পানির পক্ষ থেকে প্রতিনিয়ত প্রচার করা হয় তারা সর্বোচ্চ করদাতা। পরিতাপের বিষয়, এই করপ্রাপ্তির মাশুল হিসাবে সরকারকে কয়েক হাজার কোটি টাকা বাড়তি ব্যয় মেটাতে হয়, কতো মানুষ অকালে মৃত্যুবরণ করে! বাংলাদেশে এমন দ্বিতীয় একটি বেসরকারি খাত খুঁজে পাওয়া যাবে না, যার আয়করের জন্য উল্টো সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি পায়, জনস্বাস্থ্য মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এমন ক্ষতিকে মেনে নিয়ে এ খাতকে যারা বিভিন্নভাবে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করছে, এর পক্ষে কথা বলার চেষ্টা করছে, তারা ‘রূপকল্প ২০৪১’ কে নিশ্চিতভাবেই বাধাগ্রস্ত করতে চায়। কারণ জনস্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ‘ভিশন বাংলাদেশ ২০৪১’ অর্জন অসম্ভব ব্যাপার।

তামাক কোম্পানিগুলো প্রশ্ন উত্থাপন করছে, তামাক নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কেনো সম্পৃক্ত হচ্ছে? স্থানীয় সরকার (পৌরসভা/সিটি কর্পোরেশন) আইন ২০০৯ অনুসারে নাগরিক স্বাস্থ্য ও পরিবেশ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনের। জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগ ‘স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন নির্দেশিকা’ প্রকাশ করেছে। এর ধারা ৮.১ অনুসারে তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রেতাদের লাইসেন্সের আওতায় আনা হয়েছে বিক্রয় সীমিতকরণের লক্ষ্যে। এই লাইসেন্সিং ব্যবস্থাটি তামাক কোম্পানিগুলোর গাত্রদাহের কারণ হয়ে উঠেছে। ব্যবস্থাটিকে বানচালের জন্য তারা একের পর এক অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। সংবাদ মাধ্যমসহ বিভিন্ন জায়গায় পরিকল্পিতভাবে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রচার করে নীতিনির্ধারকদের বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তামাক কোম্পানিগুলো তাদের অনুগত বুদ্ধিজীবীদের মাধ্যমে বলাচ্ছে, এই ব্যবস্থার মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় ও বাড়তি লাইসেন্স বোঝা চাপিয়ে স্বল্প আয়ের মানুষের জীবনকে দূর্বিষহ করে তুলবে। এটাও বলছে, সরকার অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

স্বল্প আয়ের মানুষদের কী একমাত্র বিক্রয়পণ্য তামাকাকজাত দ্রব্য? বিড়ি-সিগারেট-জর্দা-গুল বিক্রয়ের পরিবর্তে স্বল্প পুঁজিতে কী তার পক্ষে আর কোনো দ্রব্য বিক্রয় করা সম্ভব নয়? অবশ্যই সম্ভব। কারণ দেশের সকল স্বল্প আয়ের মানুষ যারা ব্যবসা করে তারা সবাই তো তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় করে না! তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় না করে এ সমস্ত প্রান্তিক মানুষরা খাদ্যদ্রব্য অথবা নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যবহার্য এমন আরো অনেক কিছু নিয়েই হকারী করে তাদের জীবনযাত্রা নির্বাহ করছে।

যাদের হোল্ডিং নাম্বার নেই তারা তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় করতে পারবে না। সরকারতো তাকে অন্যকিছু বিক্রয় করতে নিষেধ করছে না। এর জন্য লাইসেন্সও নিতে বলছে না। তামাকজাত দ্রব্যের পরিবর্তে অন্য কিছু বিক্রয় করলেই তো কোনো সমস্যা থাকছে না। বিষয়টি কোনভাবেই অনানুষ্ঠানিক খাতকে জোর করে আনুষ্ঠানিক খাতে আনার বিষয় নয়। সমস্যাটি স্বল্প আয়ের মানুষদের বা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের না, সমস্যা হবে তামাক কোম্পানিগুলোর। কারণ তাদের উৎপাদিত দ্রব্যের বিক্রি কমে যাবে।

সরকার সেটাই চাইছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ‘২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ ঘোষণা বাস্তবায়ন করার জন্য নিয়ন্ত্রণ আরোপের মাধ্যমেই ব্যবহার-উৎপাদন এভাবেই কমিয়ে আনতে হবে। বাংলাদেশে এমন অনেক ব্যবসা আছে, যার জন্য দ্বৈত লাইসেন্স গ্রহণ করতে হয়। সেক্ষেত্রে যাদের হোল্ডিং নাম্বার আছে এবং তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় করা ছাড়া যদি তাদের না চলে, তারা লাইসেন্স ব্যবহার করে ব্যবসা করবে। যাদের দুটি লাইসেন্স করার সামর্থ্য নেই তামাকজাত দ্রব্যের পরিবর্তে অন্য কিছু বিক্রয় করবে। সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার কর তফসিল পর্যবেক্ষণ করলে আমরা দেখবো, জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর তামাকজাত দ্রব্যের কোম্পানির লাইসেন্স ফি ৫ হাজার টাকা, এজেন্টের ৫ হাজার টাকা, খুচরা বিক্রেতার ৫শ-৩শ টাকা। অন্যদিকে প্রাইভেট হাসপাতালের জন্য ৩৫ হাজার টাকা, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ৭ হাজার ৫শ টাকা, হেলথ ক্লাব ৫ হাজার টাকা।

তুলনামূলক বিচার করলে দেখা যাবে, এদের মধ্যে সবচেয়ে আয় বেশি তামাক কোম্পানির এবং লাইসেন্স ফি সবচেয়ে কমও তাদের। অথচ, স্বাস্থ্য-শিক্ষা-শরীর চর্চা যা জনস্বাস্থ্য রক্ষায় সরাসরি ভূমিকা রাখে তাদের লাইসেন্স ফি বেশি। প্রকৃতপক্ষে দেশের অন্য সবকিছুর তুলনায় তামাক কোম্পানির লাইসেন্স ফি হওয়া উচিত সবচেয়ে বেশি। তা নয় কী?

২০৪০ হতে বাকি মাত্র ১৮ বছর! যারা তামাক কোম্পানির পক্ষে এখনো ওকালতি করেন, জানতে ইচ্ছা করে, আপনারা কী স্বপ্ন দেখেন ২০৪১ সালেও বাংলাদেশে তামাক কোম্পানি সর্বোচ্চ করদাতা প্রতিষ্ঠান হিসাবে থাকবে? যদি এই স্বপ্ন দেখে থাকেন তাহলে সেটিতো প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক! অতএব, ইনিয়ে-বিনিয়ে না বলে জোর গলায় বলুন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ এই ঘোষণা আপনারা মানেন না।
লেখক: উন্নয়ন কর্মী



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন