Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা উদ্বেগজনক

রিন্টু আনোয়ার | প্রকাশের সময় : ২৬ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:০৫ এএম

র‌্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ওপর গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র তার ‘গেøাবাল ম্যাগনিটস্কি জবাবদিহি আইনে’ আমাদের দেশের র‌্যাব এবং এর সাবেক ও বর্তমান এই শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিষিদ্ধ করেছে। ২০১৬ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা হিসেবে ওই আইন প্রয়োগ করে আসছে। এই আইনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ঘোষিত নিষিদ্ধ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়। এ ছাড়া ওই নিষিদ্ধ ব্যক্তিরা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে পারেন না। কানাডা, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে একই ধাঁচের জবাবদিহি আইন আছে। এ অবস্থায় অনেক দেশই নিষিদ্ধ সংস্থা ও তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণ করবে। পশ্চিমা দেশগুলোতে ভিসা আবেদনের সময় আবেদনকারীকে জানাতে হয় তিনি কোনো দেশে নিষিদ্ধ কি না এবং এর কারণ কী।


এই আইনে নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্ত হওয়ার পথও বাতলানো আছে। ম্যাগনিটস্কি আইনের ৪০৪ ধারায় নিষেধাজ্ঞা থেকে বেরোনোর তিনটি পথের কথা উল্লেখ আছে। এক. যে অভিযোগে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তেমন অপরাধ সংঘটনে যুক্ত নয়, এমন বিশ্বাসযোগ্য তথ্য দিতে হবে। দুই. অভিযুক্ত ব্যক্তিকে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় বিচার করা। তিন. অভিযুক্ত ব্যক্তির আচরণে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসা, অপরাধের উপযুক্ত শাস্তি হওয়া এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের অপরাধ করবেন না বলে বিশ্বাসযোগ্য অঙ্গীকার করা। ওই তিনটি উপায়ের কোনো একটি অবলম্বন করে নিষিদ্ধ ব্যক্তি বা সংস্থা এসংক্রান্ত কংগ্রেস কমিটির সভাপতি ও র‌্যাংকিং সদস্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে চিঠি লিখে জানাতে পারে। সে ক্ষেত্রে ১২০ দিনের মধ্যে প্রেসিডেন্ট তাঁর জবাব দেবেন। জাতীয় নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিষয় হলে প্রেসিডেন্ট গোপনীয় চিঠির মাধ্যমেও জবাব দিতে পারেন। সন্তুষ্ট হলে তিনি ন্যূনতম ১৫ দিন পর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আদেশ জারি করবেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের করা নির্বাহী আদেশে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের এই ক্ষমতা সে দেশের অর্থমন্ত্রীকে দেওয়া হয়েছে।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে ১০ ডিসেম্বর ২০২১ উল্লিখিত সাত র‌্যাব কর্মকর্তার সঙ্গে চীন, মিয়ানমার ও উত্তর কোরিয়ার বিভিন্ন কর্মকর্তা ও প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। চীন, মিয়ানমার ও উত্তর কোরিয়ার প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। ওই তিন রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বহুদিনের রাজনৈতিক বিভেদ ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিরোধিতা রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে বিশেষ করে বর্তমান সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ভালো। তাই আচমকা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের এই নিষেধাজ্ঞা দেশে ও বিদেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।

বাংলাদেশ সরকার র‌্যাবের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের এই অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছে। আবার একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তি করার চেষ্টার কথাও বলেছে।

ঘটনাকে অত হালকা করে দেখার অবকাশ নাই। সরকারের লোকেরা সাফাই গাইছেন, কেউ কেউ আবার যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের গুলিতে নিহতের পরিসংখ্যান দিয়ে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এ প্রয়াস শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা ছাড়া কিছু না। বাংলাদেশে কে কী বললো, যুক্তরাষ্ট্র তা থোড়াই কেয়ার করে। বিশ্বব্যপী মানবাধিকার লঙ্ঘনের হাজারো অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে, নিজ দেশে হানাহানি গোলাগুলি নিত্য ঘটনা। তারপরও যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রই। আমেরিকাকে এড়িয়ে, তাদের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আজকের বিশ্বে টিকে থাকা খুবই দুরূহ, তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলোর জন্য তা প্রায় অসম্ভব। উত্তর কোরিয়া কিউবাসহ হাতেগোনা দুই-চারটা দেশ টিকে আছে অন্য পরাশক্তির সমর্থনে বা নিজেদের রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার দৃঢ়তার কারণে।

আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, কয়েকজন ব্যক্তি বা কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে স্যাংশন আরোপ- এ আর এমন কী! কিন্তু পর্যবেক্ষক মহল বলছে, এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে পারে। এ ধরনের স্যাংশন শুধু যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা না, যার নামে স্যাংশন তার ইমিডিয়েট রিশেলশন বা স্ত্রী/স্বামী পুত্র কন্যা ভাইবোন পিতামাতারাও এতে বিভিন্ন জটিলতার সম্মুখীন হতে পারেন। যে বাহিনীর নামে স্যাংশন তার সকল সদস্যই এর আওতায় এসে যেতে পারে। এর প্রতিক্রিয়া শান্তিরক্ষী মিশন পর্যন্ত গিয়ে ঠেকতে পারে বলেও কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন।

আমেরিকার সবচাইতে বড় হাতিয়ার হচ্ছে ডলার। বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ডলারই হচ্ছে প্রধান লেনদেন মাধ্যম। আর এই লেনদেন পুরোটাই নিয়ন্ত্রিত হয় আমেরিকা থেকে। বিভিন্ন দেশের ফরেন কারেন্সি রিজার্ভও মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে গচ্ছিত থাকে। অবাধ্য কোনো জাতিকে শায়েস্তা করতে ওই একটা অস্ত্রই যথেষ্ট। শুধু তাই না, তারা চাইলে ডলারের মাধ্যমে রেমিটেন্স পাঠানোও বন্ধ করে দিতে পারে। পণ্য আমদানি রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দিতে পারে। আমেরিকার প্রশাসনিক সিস্টেম খুবই জটিল। কোন প্যাঁচে কোনটা ধরে বসে, বলা মুশকিল।

এসব কারণে সাধারণত মাজায় জোর না থাকলে কেউ আমেরিকাকে ঘাঁটাতে যায় না। আমরা যে আমেরিকাকে চটিয়েছি তেমন কিন্তু না, খুবই ভালো সম্পর্ক। সরকারের দায়িত্বশীল লোকেরা রাষ্ট্রদূতকে ‘কাজের মেয়ে মর্জিনা’ বা আমেরিকার মন্ত্রীকে ‘দুই ট্যাকার মন্ত্রী’ বলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করলেও ওরা সেসব গায়ে মেখেছে বলে মনে হয় না। সেসব কারণে যে এই স্যাংশন, তাও মনে হয় না। বলা হচ্ছে, বিদেশে বসে কিছু লোক সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, করতেই পারে। এরা কেউ কেউ বিতাড়িত, নির্বাসিত, কেউ কেউ হয়তো নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। প্রতিশোধ নেবে, দেশে ফিরে আসার চেষ্টা করবে এটা তো স্বাভাবিক। কিন্তু জনগণের কষ্টের টাকায় প্রতিপালিত রাষ্ট্রদূতগণ কী করছেন? স¤প্রতি এই ধরনের কিছু কথাবার্তাও শোনা যাচ্ছে, টিভি টক শো’তে। দলকানা কাউকে এমনও বলতে শুনেছি, দেশে কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে নাই, দেশে কোনো সংকট নাই, চমৎকার গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিরাজ করছে আরো কত কী! স্টেট ডিপার্টমেন্টে গিয়ে এসব বললে চলবে? প্রতি বছর মানবাধিকার কমিশনগুলো রিপোর্ট পাঠাচ্ছে, আবার সরকারের দায়িত্বশীল লোকগুলো গৎবাধা বুলি আউড়ে তা প্রত্যাখ্যান করেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় কী হতে পারে সেটা আগেই অনুমান করা উচিত ছিল। সেই বুদ্ধিমত্তা এবং ধীশক্তির মানুষ কই! কিছুটা ব্যবস্থা নিলে হয়তো আজকের এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না।

এটা খুবই লজ্জার বিষয় যে, স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে স্যাংশন নামের একটা কালো স্ট্যাম্প কপালে সেঁটে গেল। এতে গোটা বিশ্বে শুধু দেশের ভাবমর্যাদাই ক্ষুণœ হলো না, একই সাথে বড় কোনো ক্ষতির আশঙ্কাও কেন জানি তৈরি হলো। সেই সাথে মানুষের মনে তৈরি হচ্ছে নানা প্রশ্ন। অনেককেই নানা কাজে ইউরোপ-আমেরিকা যাতায়ত করতে হয়। অনেকের ব্যবসা সহায়-সম্পত্তি আছে সেসব দেশে। আত্মীয়-পরিজনও সেটেল্ড। এখন তারা ভয় পেতে শুরু করেছে, এর পর আরও এমন কোনো স্ট্যান্ড আসে কিনা, যাতে লেখাপড়ার সুযোগ সীমিত হয়ে যায়, ভিসা পাওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে বা ইমিগ্রেশন চেকপয়েন্টে হেনস্থার শিকার হতে হয়! অভিবাসনের সুযোগ রহিত হয়ে যায়।

এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সরকারের মন্ত্রীরা নানা কথা বলেছেন। সর্বশেষ জানা গেল, স্যাংশন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের কথা হয়েছে। জনগণকে আস্বস্ত করা হয়েছে, এই ঘটনায় দুই দেশের সম্পর্কের কোনো অবনতি হবে না। সরকারের স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের এই নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে কাজ করছেন। খুবই ভালো কথা। মানুষ এই কথার ওপর আস্থা রাখতে চায়। মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করার সাথে সাথে দেশে গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন, স্বচ্ছ নির্বাচন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করলে দেশ আবার হারানো গৌরব ফিরে পেতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।



 

Show all comments
  • মোঃ আবুল খায়ের ২৭ ডিসেম্বর, ২০২১, ৪:০৬ এএম says : 0
    মূল্যায়ন সঠিক
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন