Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী : সামগ্রিক ব্যর্থতা ও চ্যালেঞ্জের প্রেক্ষাপট

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ২২ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:০২ এএম

স্বাধীনতা ও বিজয়ের ৫০তম বার্ষিকী উদযাপন করল বাংলাদেশ। যেকোনো জাতির রাজনৈতিক স্বাধীনতার ইতিহাসে প্রথম ৫০ বছর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের রাজনৈতিক ভূগোলে ভারতীয় উপমহাদেশে বাঙ্গালি মুসলমানের একমাত্র স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় অনেক বড় ঘটনা। একটি রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষের জীবনের বিনিময়ে এই অর্জনকে আমরা সম্ভব করেছি। নয় মাসের যুদ্ধের শেষ প্রান্তে এসে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মিত্র বাহিনী হিসেবে ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের অংশগ্রহণ করার আগেই লাখো মুক্তিযোদ্ধা নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে পাক বাহিনীর পরাজয় ও মুক্তির সংগ্রামের বিজয় সুনিশ্চিত করে তুলেছিলেন। এ উপমহাদেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতার ইতিহাসে প্রায় পৌনে দুইশ’ বছরের বৃটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে ভারতীয় মুসলমানদের অবদান অন্য যেকোনো জাতির চেয়ে বেশি। যে আন্দোলনের জেরে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববাংলা পাকিস্তান রাষ্ট্রের অঙ্গিভুত হয়েছিল। যেখানে সত্তুর বছরের বেশি সময় ধরে রক্তাক্ত প্রতিরোধ যুদ্ধ করেও ফিলিস্তিন-কাশ্মির স্বাধীনতা অর্জন করতে পারেনি, সেখানে তেইশ বছরের মাথায় ৯ মাসের রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। ভূরাজনৈতিক কারণে সেই যুদ্ধে ভারত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও এটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, কিছুতেই তা ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বলে মেনে নিতে রাজি নই। তবে ইতিহাসকে বিকৃত করার ফন্দি-ফিকির আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শেষ প্রান্তে এসে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ভারতীয় কমান্ডারদের কাছে পাক বাহিনীর আত্মসমর্পনের ঘটনাক্রমই প্রতিফলিত হয়ে ওঠে। সেখানে পাকিস্তান ও ভারতীয়দের মধ্যে একটি চমৎকার সমঝোতা লক্ষ্য করা যায়। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এমএজি ওসমানী এবং সেক্টর কমান্ডারদের টেবিলের বাইরে রাখার মধ্য দিয়ে এ দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের অসামান্য অবদান ও আত্মত্যাগের বিষয়টিকে উপেক্ষা করা হয়। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই সময়ে এসেও সেসব অস্বচ্ছতা ও দুরভিসন্ধি অপনোদনের কোনো প্রয়াস দেখা যায়নি। উপরন্তু ১৬ ডিসেম্বরকে সামনে রেখে ভারতের বিজেপি সরকারের স্বারাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং এক বক্তৃতায় বলেছেন, একাত্তুরে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে ভারত বিজয়ী হয়েছে। তাঁর এই বক্তব্যে বাংলাদেশের কোটি মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ দেখা গেলেও এর তেমন কোনো রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানমালায় একটি আন্তর্জাতিক আবহ থাকার কথা থাকলেও আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে শুধুমাত্র ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দকেই দেখা গেছে। আমাদের জাতীয় পত্রিকাগুলোতেও ভারতে পাক-ভারত যুদ্ধে বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী পালনের খবর প্রকাশিত হয়েছে। এভাবেই আমাদের বিজয়ের গৌরবকে খÐিত ও ¤øান করার আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত অব্যাহত রয়েছে।

একযুগের বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় রয়েছে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই আওয়ামী লীগ(তৎকালীন মহাজোট) একের পর এক দীর্ঘ মেয়াদি উন্নয়ন ও রাজনৈতিক পরিকল্পনা-মহাপরিকল্পনার ঘোষণা দিতে শুরু করে। সেখানে ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপরেখা, একদশক পরে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন, স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী পালন এবং ২০৪১ সাল পর্যন্ত উন্নয়নের মহাপরিকল্পনার রূপরেখা তুলে ধরা হয়। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, গণতন্ত্র, সামাজিক-অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়লেও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই সময়ে সেসব লক্ষ্য সম্পর্কে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে উদাসিনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিরোধীদলকে নির্বাচনের বাইরে রেখে, রাতের বেলায় ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভরে ক্ষমতায় থাকার মধ্য দিয়ে দেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। স্বাধীনতার সুর্বণজয়ন্তী জাতির জন্য একটি অসামান্য গৌরবের বিষয় হলেও জাতীয় প্রোগ্রামগুলোর সাথে দেশের মানুষের মধ্যে তেমন কোনো আন্তরিক অংশগ্রহণ ও উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছে না। নির্বাচন ব্যবস্থাকে আস্থাহীন করে তোলার মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে দেশের সরকার ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিও মানুষকে আস্থাহীন করে তোলা হয়েছে। কয়েক মাস ধরে সারাদেশে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন চলছে। এর আগে এই নির্বাচনে দলীয় প্রতীক নিয়ে প্রধান বিরোধীদল বিএনপি অংশগ্রহণ করলেও এবার তারা বর্জন করেছে। তবে কোথাও কোথাও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিএনপি ও জামায়াতের প্রার্থীদের অংশগ্রহণ দেখা যাচ্ছে। ইতিমধ্যে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে শত শত ইউনিয়ন পরিষদে নৌকা প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত হয়েছেন। যেসব ইউনিয়নে বিরোধীদলের শক্ত প্রতিদ্ব›িদ্বতা থাকতে পারে এবং ভোটের হিসাবে তাদের সম্ভাব্য অবস্থান অপেক্ষাকৃত ভাল, স্থানীয় এমপি-মন্ত্রীরা সেসব ইউনিয়নে নিজেদের প্রার্থীদের বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতা বা নামমাত্র প্রতিদ্ব›িদ্বতায় পাশ করিয়ে আনার অপকৌশল গ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে। নানা ধরণের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা সত্তে¡ও যেসব এলাকায় জনগণ ভোট দেয়ার সুযোগ পেয়েছে, কোথাও কোথাও নৌকা মার্কার প্রার্থীদের বিস্ময়করভাবে পরাজিত হতেও দেখা গেছে। এর মানে হচ্ছে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কুক্ষিগত করার একচেটিয়া ব্যবস্থায় জনমতকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয় না। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে বিরোধীদলকে নির্মূল করার নানামুখী তৎপরতা চলেছে। হাজার হাজার মামলায় বিরোধীদলের লাখ লাখ নেতা-কর্মীকে হয়রানি ও বিপন্ন করার পাশাপাশি গুম-খুন হয়ে যাওয়ার বাস্তব হুমকির সম্মুখীন নেতাকর্মীরা গত একযুগে কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলতে না পারলেও, বিভিন্ন স্থানীয় নির্বাচনে ভোটের হিসাব-নিকাশ থেকে বোঝা যায়, একতরফা রাজনৈতিক ব্যবস্থায়ও মাঠের জনমতে তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।

গত একযুগ ধরে দেশে এক ধরণের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিরাজ করায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সূচকে অনেক এগিয়েছে বটে, তবে কিছু মেগা স্ট্রাকচারাল ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট ছাড়া অর্থনৈতিক অগ্রগতির সূচকে ভারত ও পাকিস্তানকে ডিঙিয়ে বাংলাদেশের এগিয়ে থাকার বাস্তব প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। প্রায় দেড় দশক ধরে ধরে গণতান্ত্রিক দেশগুলোর আন্তজার্তিক তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই। বৃটিশ পন্ডিত, স্কুল অব ইকোনমিক্স অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সের অধ্যাপক প্রফেসর ড্যাভিড লেউইস স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামাজিক অর্জন ও প্রেক্ষাপট নিয়ে একটি বই লিখেছেন। ‘বাংলাদেশ: পলিটিক্স, ইকোনমি অ্যান্ড সিভিল সোসাইটি’ নামের এই গবেষণা গ্রন্থে ২০১০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের সামগ্রিক অবস্থার একটি নিরপেক্ষ প্রতিবেদন তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশকে মডারেট মুসলিম ডেমোক্রেটিক কান্ট্রি বলে আখ্যায়িত করার পাশাপাশি স্বাধীনতার লক্ষ্য ও রাজনৈতিক বিবেচনায় একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের কাছাকাছি অবস্থানকে চিহ্নিত করেছিলেন। ২০১১ সালে বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর গত এক দশকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অবস্থায় বেশকিছু পরিবর্তন ঘটে গেছে। এই প্রেক্ষাপটে, ২০২১ সালে এই গবেষণা গ্রন্থটির পরিবর্তিত নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হওয়ার কথা রয়েছে। ২০০৬ সাল থেকে লন্ডনের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) গণতান্ত্রিক বিশ্বের সূচক নির্ধারণে জরিপ ফলাফল প্রকাশ করে আসছে, প্রথম বছর ত্রæটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশের তালিকায় স্থান পেলেও এরপর ক্রমাবনতিশীল হাইব্রিড রিজিমের তালিকা থেকে আর বের হতে পারেনি বাংলাদেশ। স্বাধীনতার সুর্বণজয়ন্তীর এ সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জো বাইডেন প্রশাসনের আয়োজনে অনুষ্ঠিত ডেমোক্রেসি সামিটে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বর্তমান ও সাবেক ৭ শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করার ঘটনা একই সঙ্গে সরকার এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি মানুষকে হতাশ ও বিক্ষুব্ধ করেছে। আমাদের কোনো সংস্থাই পুরোপুরি স্বাধীন নয়, সরকারের রাজনৈতিক মতাদর্শ ও নির্বাহী আদেশে এসব সংস্থার শীর্ষ ব্যক্তিদের পদায়ণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কর্মকাÐ পরিচালিত হয়ে থাকে। সেখানে আইনগত নিরপেক্ষতা অনেকাংশেই লঙ্ঘিত হয়ে আসছে। সেই লঙ্ঘনের দায় সরকারের হলেও এসব সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারাও জবাবদিহিতার বাইরে থাকতে পারেন না। বর্তমান অবস্থায় দেশের কোনো নাগরিক তাদের বিরুদ্ধে আইনগত চ্যালেঞ্জ গ্রহণের সাহস করতে না পারলেও পরবর্তীতে তাদেরকে বিচারের সম্মুখীন হওয়ার অনেক উদাহরণ রয়েছে। তবে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মত সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনে এসব বিষয়ে যে চিত্র বেরিয়ে আসছে, তা এক সময় বিচার ও গবেষণার প্রামান্য দলিল হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। তবে ক্ষমতাকেন্দ্রিক বিচার ও বেøইম গেমের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নিমজ্জিত থেকে আমরা জাতি হিসেবে নিজেদের সমুন্নোত ও মর্যাদার আসনে উন্নীত করতে কিংবা শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠন করতে পারব না। এখনো আমরা অব্যাহতভাবে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক আধিপত্যবাদ ও ভূরাজনৈতিক সা¤্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের শিকার। এক ভাষা, এক ধর্মীয়-নৃত্বাত্তি¡ক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ একক সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগনকে হীন রাজনৈতিক স্বার্থে বিভাজিত করে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সা¤্রাজ্যবাদীরা ফায়দা লুটছে।

গত একযুগে পর পর তিনটি প্রশ্নবিদ্ধ জাতীয় নির্বাচনের পর সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে আবারো এক চরম সন্ধিক্ষণে পড়েছে বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক সূচকে প্রভুত সাফল্য অর্জনের পর রাজনৈতিকভাবে মুখ থুবড়ে পড়ার বেশ কিছু উদাহরণ আমাদের আশপাশেই আছে। এ ক্ষেত্রে দুই দশক আগের নাইজেরিয়া, গৃহযুদ্ধপূর্ব শ্রীলঙ্কা কিংবা ন্যাটো আগ্রাসনের আগের ইরাক ও গৃহযুদ্ধপূর্ব সিরিয়ার কথা স্মরণ করা যেতে পারে। শুধুমাত্র জনবিচ্ছিন্নতা ও শাসনক্ষমতার দুর্বলতার কারণে এসব দেশ তাদের রাজনৈকিত-অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে নষ্ট করে অনেক রক্ত ঝরিয়ে ইতিহাসের চোরাগলিতে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। অন্যদিকে, সিভিল সোসাইটি ও রাজনৈতিক সমঝোতার মধ্য দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা ও তিউনিসিয়ার মত রাজনৈতিক গোলযোগের আশঙ্কা থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে শান্তি ও সমৃদ্ধির সোপানে এগিয়ে যাওয়ার চমৎকার দৃষ্টান্তও আছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে এসে আমরা কি আরো একটি একপাক্ষিক জাতীয় নির্বাচনের পথে হাঁটবো, নাকি রাজনৈতিক সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাব? খরা-বন্যা ও দুর্ভীক্ষের ঘটনাক্রমের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদ শিরোনাম হওয়া বাংলাদেশ যখন এক কোটি প্রবাসী কর্মী ও অর্ধকোটি গার্মেন্টস শ্রমিক ও বিনিয়োগকারির শ্রমে অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, তখন রাজনৈতিক নেতৃত্বের অদূরদর্শিতা ও হীনমন্যতার কারণে বাংলাদেশ অনিশ্চয়তার আবর্তে পিছিয়ে থাকতে পারে না। দেশের ১৭ কোটি মানুষের কাছে ক্ষমতার দেশপ্রেমের চটকদার বিজ্ঞাপনের চেয়ে রাজনৈতিক ও মানবিক অধিকার, সাম্য, নিরাপত্তা ও সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের সংরক্ষণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দেশের মানুষ গুম-খুন-বিচারহীনতার অবসান চায়। হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের ক্ষমতার অবসান চায়। সর্বোপরি প্রত্যেক নাগরিক তার ভোটাধিকারের নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তার গ্যারান্টি চায়। এ দেশের মানুষ বিশ্বাস করে, দেশপ্রেম ইমানের অঙ্গ। দল বা গোষ্ঠীর চাপিয়ে দেয়া ফর্মুলায় দেশপ্রেমের চেতনাবাজি গণতন্ত্রকে ফ্যাসিবাদে পরিনত করে। গণতন্ত্রে কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দল অপরিহার্য্য নয়, চিরস্থায়ী নয়, এখানে নির্মূলের রাজনীতির কোনো স্থান নেই।

পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের প্রপাগান্ডা ও পাতানো খেলায় সন্ত্রাসবাদের নামে, জঙ্গিবাদের নামে, মৌলবাদের নামে, নাস্তিক্যবাদের নামে, কাউকে বিনাবিচারে হত্যার অধিকার কোনো দেশের সংবিধান বা ধর্মীয় অনুশাসনে গ্রহণযোগ্য নয়। স্বাধীনতার সুর্বণজয়ন্তীতে বাংলাদেশের মানুষ এসব বিষয়ে একটি রাজনৈতিক সমঝোতা মতৈক্য দেখতে চায়। তা নাহলে, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক আধিপত্যবাদের থাবার নিচে ক্রমশ পিষ্ট হতে থাকব আমরা। দেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বিচারব্যবস্থা, প্রশাসনিক ব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিদেশি শক্তির অভিযোগের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। দুর্নীতি, বৈষম্য ও অধিকার হরণের শিকার দেশের অসংখ্য মানুষ বিদেশিদের এসব অভিযোগের পক্ষে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমর্থন ব্যক্ত করে সত্যতা ও বস্তুনিষ্টতার সাক্ষ্য দিচ্ছে। ঢাকা বইমেলার বাইরে হত্যাকাÐের শিকার হয়েছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত মার্কিন সিটিজেন অভিজিত রায় এবং তার স্ত্রী গুরুতর আহত হয়েছিলেন। সেই ঘটনার বিচারিক প্রক্রিয়া ্এবং মোহাম্মদপুরে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বার্নিকাটের উপর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনাটিকে ঘিরে নিজেদের মত করে তথ্য-প্রমান সংগ্রহ ও বিচারের ফাঁক-ফোঁকড় ও দুর্বলতাগুলো বের করে মার্কিন প্রশাসন এখন আমাদের পুরো সিস্টেমের উপর চাপ সৃষ্টি করছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। পুলিশের চোখে পলাতক আসামিদের ধরিয়ে দেয়ার জন্য মিলিয়ন ডলার পুরষ্কার ঘোষণা করেছে তারা। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, সেসময় হামলার সাথে আল-কায়েদা সংশ্লিষ্ট একটি গ্রæপের দায় শিকারের তথ্য প্রচার করা হয়েছিল। আন্ত:দেশীয় সন্ত্রাসবাদের সাথে সা¤্রাজ্যবাদের গোয়েন্দা সংস্থার ফল্স ফ্লাগ অপারেশনের অভিযোগ মিথ্যা নয়। ভুল গোয়েন্দা তথ্যের কারণে গত দুই দশকে ইরাক-আফগানিস্তান দখল করে নেয়ার পর এসব দেশে শত শত বিমান হামলায় হাজার হাজার নিরপরাধ সাধারণ মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী। মিথ্যা গোয়েন্দা তথ্যে রাষ্ট্রদখলের সামরিক আগ্রাসন এবং হাজার হাজার মানুষ হত্যা স্পষ্টতই যুদ্ধাপরাধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘন। তাদের এসব অপরাধের বিচার না হলেও আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দুর্বল দেশগুলোকে প্রতিনিয়ত তাদের অভিযোগ ও নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হতে হয়। ভূরাজনৈতিক কৌশলগত কারণে তারা এসব বিষয়কে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। বাংলাদেশ এখন আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিভক্তি, নির্মূল ও প্রতিহিংসার রাজনীতির কারণে অত্যন্ত দুর্বল। এ সময়ে আমরা চীন-মার্কিন সামরিক-অর্থনৈতিক পরাশক্তির আঞ্চলিক বিরোধে কৌশলগত অবস্থানের মূল টার্গেটে পরিনত হয়েছি। এসব বিষয়ে সরকার ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের শক্ত অবস্থান নিশ্চিত করতে হলে প্রথমেই আভ্যন্তরীন রাজনৈতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধানে আসতে হবে। প্রবল পরাশক্তির সাথে লড়াই করতে হলে প্রথমেই জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলতে হবে। গণতন্ত্র, সুশাসন ও দুর্নীতিমুক্ত সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ছাড়া জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে একটি নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের রূপরেখা বাস্তবায়নই হতে পারে সব অপশক্তির মোকাবেলায় সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ।

[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: স্বাধীনতা


আরও
আরও পড়ুন