চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
আল্লাহর নবী ঈসা (আ.) যখন ইহুদিদের মধ্যে আল্লাহর একত্ববাদের দাওয়াত দিলেন তখন তারা তাঁর নবুওয়াতকে অস্বীকার করে। এমনকি তাকে দাজ্জাল সাব্যস্থ করে। তারা তাকে হত্যা করার জন্য উঠে পড়ে লেগে যায়। হত্যা করার জন্য তার ঘর ঘেরাও করে। তখন সবার আগে শামউন কারিনি নামে এক ব্যক্তি ঘরে প্রবেশ করে। তখন আল্লাহ নবীকে নিজ কুদরতে আসমানে উঠিয়ে নেন। আর সঙ্গে সঙ্গে তাদের ওই ব্যক্তির চেহারা ঈসা (আ.)-এর মতো করে দেন। বাকি লোকেরা ঘরে প্রবেশ করে তাকে ধরে ফেলে এবং তাকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করে। কেউ কেউ বলতে থাকে, তার চেহারা তো ঈসা (আ.)-এর মতো মনে হয়; কিন্তু তার শরীর তো আমাদের লোকের মতো মনে হয়। কেউ কেউ বলতে লাগে, এ নিহত ব্যক্তি যদি ঈসা হয়, তাহলে আমাদের লোক গেল কোথায়? আর সে যদি আমাদের লোক হয়, তাহলে ঈসা (আ.) কোথায় গেল? এভাবে ধারণা করে একেকজন একেক রকম কথা বলতে থাকে। কারও কাছে সঠিক জ্ঞান ছিল না।
আল্লাহ তায়ালা প্রকাশ করে দেন, ঈসা (আ.) নিহত হননি; বরং তাকে আসমানে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে এবং ইহুদিদের ধাঁধায় ফেলা হয়েছে। মহাগ্রন্থ কোরআনে রয়েছে, ‘বরং আল্লাহ তার কাছে তাকে তুলে নিয়েছেন এবং আল্লাহ মহা পরাক্রমশালী। তাদের (এ) কথার কারণে, আমরা আল্লাহর রাসুল মারিয়াম পুত্র ঈসা মাসিহকে হত্যা করেছি। অথচ তারা তাকে হত্যা করেনি এবং তাকে শূলেও চড়ায়নি; বরং তাদের ধাঁধায় ফেলা হয়েছিল। আর নিশ্চয় যারা তাতে মতবিরোধ করেছিল, অবশ্যই তারা তার ব্যাপারে সন্দেহের মধ্যে ছিল। ধারণার অনুসরণ ছাড়া এ ব্যাপারে তাদের কোনো জ্ঞান নেই। আর এটা নিশ্চিত, তারা তাকে হত্যা করেনি।’ (সুরা নিসা : ১৫৭-১৫৮)।
বর্তমানে ইহুদি-খ্রিস্টান উভয় দল ভুলের শিকার। ইহুদিরা গর্ব করে বলে, আমরা ঈসা (আ.)-কে হত্যা করে ক্রুশবিদ্ধ করেছি। আর খ্রিস্টানরা মনে করে, ঈসা (আ.) ক্রুশবিদ্ধ হয়ে নিজের উম্মতের গুনাহের কাফফারা আদায় করেছেন। অথচ ঈসা (আ.) আসমানে জীবিত আছেন। কেয়ামতের আগে দাজ্জাল বের হলে তিনি পৃথিবীতে অবতরণ করবেন এবং তাকে হত্যা করবেন। সে সময় ইহুদি-খ্রিস্টান সবার দৃঢ় বিশ্বাস হয়ে যাবে যে, নবী ঈসা (আ.)-কে হত্যাও করা হয়নি, শূলিতেও চড়ানো হয়নি; বরং তাকে আসমানে তুলে নেয়া হয়েছে। সেখানে তিনি জীবিত আছেন। তিনি তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেবেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘কিতাবিদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যে ঈসার মৃত্যুর পূর্বে তার প্রতি ঈমান আনবে না এবং কেয়ামতের দিনে তিনি তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী হবেন।’ (সুরা নিসা : ১৫৯)।
ঈসা (আ.)-এর অবতরণের পর (আহলে কিতাব) ইহুদি-খ্রিস্টান সবাই তার মৃত্যুর আগে তার প্রতি ঈমান আনবে। তাফসিরগ্রন্থগুলোতে বর্ণিত এ ব্যাখ্যাটিকে ইমাম ইবনে জারির তাবারি (রহ.) শুদ্ধতার বিচারে উত্তম বলেছেন। (তাফসিরে তাবারি : ৯/৩৮৬)। ইমাম ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, ইবনে জারির (রহ.) যা বলেছেন তাই সঠিক। কেননা পরবর্তী আয়াতগুলো দ্বারা তাই বুঝা যায়। (তাফসিরে ইবনে কাসির : ২/৪৫৪)।
কেয়ামতের পূর্বে ঈসা (আ.) পৃথিবীতে অবতরণ করার পক্ষে এ আয়াতটিও প্রমাণ-‘তিনি মায়ের কোলো থাকাকালীন মানুষের সঙ্গে কথা বলবেন, মধ্যবয়সেও।’ (সুরা আলে ইমরান : ৪৬)। অর্থাৎ তাকে জীবিত অবস্থায় আসমানে উঠিয়ে নেয়া হবে। তারপর মধ্যবয়সে পৃথিবীতে নামানো হবে, তখনও তিনি মানুষের সঙ্গে কথা বলবেন।
ঈসা (আ.)-এর পৃথিবীতে অবতরণ কেয়ামতের একটি আলামত। মহান আল্লাহ বলেন, ‘সুতরাং তা হলো কেয়ামতের নিদর্শন। কাজেই তোমরা কেয়ামতে সন্দেহ করো না এবং আমার কথা মান। এটা এক সরল পথ।’ (সুরা জুখরুফ : ৬১)। ঈসা (আ.)-এর অবতরণ কেয়ামত নিকটবর্তী হওয়ার বিষয়টি বোঝার মাধ্যম হবে। আয়াতটি এ বিষয়ে প্রায় স্পষ্ট। হজরত ইবনে আব্বাস, আবু হুরাইরা, তাবেয়িদের মধ্যে আবুল আলিয়া, ইকরিমা, কাতাদা, হাসান, দাহহাক প্রমুখের মতে আয়াতটিতে ঈসা (আ.)-এর কথাই বলা হয়েছে। পরবর্তী আয়াতগুলো দ্বারাও তাই বুঝা যায়। এ প্রসঙ্গে তাফসিরকার মুজাহিদ (রহ.) বলেন, কেয়ামতের আগে ঈসা ইবনে মারিয়ামের আগমন কেয়ামতের নিদর্শন। তাহলে আয়াতের মর্মার্থ দাঁড়াল-নিশ্চিত বিষয় হলো, ঈসা (আ.)-এর অবতরণ কেয়ামতের নিদর্শন। অতএব এতে কোনো সন্দেহ করো না। (তাফসিরে তাবারি : ২১/৬৩১; তাফসিরে দুররে মানসুর : ৭/৩৮৭)।
ঈসা (আ.) কোথায় এবং কখন অবতরণ করবেন?
তিনি ফজরের নামাজের সময় অবতরণ করবেন। দামেস্কের উমাইয়া জামে মসজিদে তাকবিরে উলা বলা হয়ে যাবে এমন সময় অবতরণ করবেন। নামাজের জন্য প্রথম কাতারে দাঁড়াবেন। দায়িত্বরত মুসলিম ইমাম তখন শ্রদ্ধাভরে অনুরোধ করবেন, হে রুহুল্লাহ, আসুন, আমাদের ইমামতি করুন। তিনি বলবেন, না, তোমরা বরং একে অন্যের আমির। এটাই সেই সম্মান, যা আল্লাহ তায়ালা এই উম্মতকে দান করেছেন।’ (মুসলিম : ১৫৬)। অন্য হাদিসে আছে, দায়িত্বরত ইমাম হবেন ইমাম মাহদি। নাওয়াস ইবনে সামআন (রা.) থেকে বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদিসে এসছে, নবী ঈসা (আ.) জাফরানের রঙের দুটি পোশাক পরে এবং দুজন ফেরেশতার পাখার ওপর হাত রেখে দামেশক শহরের পূর্বে অবস্থিত সাদা মিনারের উপরে অবতরণ করবেন।’ (মুসলিম : ২৯৩৭)।
দাজ্জালকে হত্যা করবেন
পৃথিবীতে তখন দাজ্জালের আবির্ভাব হবে। সে ধোঁকাবাজি ও শঠতার জাল বিস্তার করে নিজেকে মাসিহ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ছড়াবে। এক পর্যায়ে সে নিজেকে খোদা বলে দাবি করবে। নবী ঈসা (আ.) ‘লুদ’ ফটকের কাছে তাকে হত্যা করবেন। মুজাম্মি ইবনে জারিয়া (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, ঈসা ইবনে মারিয়াম দাজ্জালকে বাবে লুদে হত্যা করবেন।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা : ৩৮৬৮৯)। লুদ হচ্ছে বাইতুল মাকদিসের পশ্চিমে উপকূলীয় নগরী তেল আবিব ইয়াফু থেকে রামাল্লাহগামী রাজপথের ধারে ফিলিস্তিনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নগরী। বর্তমানে ইসরাঈল সেখানে একটি বিশাল বিমানবন্দর বানিয়ে রেখেছে। (আউনুল মা‘বুদ, মুহাম্মদ আবাদিকৃত : ১১/৩০২)।
সুবিচার প্রতিষ্ঠা : ঈসা (আ.) ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ। অচিরেই ন্যায় বিচারক শাসক হিসেবে ঈসা (আ.) তোমাদের মাঝে আগমন করবেন। তিনি ক্রুশচিহ্ন ভেঙ্গে ফেলবেন, শুকর হত্যা করবেন এবং জিযইয়া প্রত্যাখ্যান করবেন। ধন-সম্পদ প্রচুর হবে এবং তা নেওয়ার মতো কোনো লোক পাওয়া যাবে না। এমনকি মানুষের কাছে একটি সেজদা দুনিয়া এবং তার মধ্যকার সমস্ত বস্তু হতে শ্রেষ্ঠ হবে।’ (বুখারি : ৩৪৪৮)।
ঈসা (আ.) পৃথিবীতে থাকার সময়কাল? ঈসা (আ.) বর্তমানে চতুর্থ আসমানে আছেন। কেয়ামতের আগে পথিবীতে এসে ৪৫ বছর জীবিত থাকবেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ঈসা ইবনে মারিয়াম জমিনে অবতরণ করবেন। এরপর তিনি বিয়ে করবেন এবং তার সন্তানাদিও জন্মলাভ করবে এবং তিনি ৪৫ বছর অবস্থান করবেন। অতঃপর তিনি ইন্তেকাল করবেন। তাকে আমার সঙ্গে আমার কবরের সঙ্গে দাফন করা হবে। কেয়ামতের দিন আমি ও ঈসা ইবনে মারিয়াম একই কবরস্থান থেকে আবু বকর ও ওমরের মাঝখান থেকে উত্থিত হব।’ (মিশকাত : ৫৫০৮)।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।