Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আর্সেনিক দূষণ রোধে সচেতনতার বিকল্প নেই

সেলিমা খাতুন | প্রকাশের সময় : ২৬ নভেম্বর, ২০২১, ১২:০৬ এএম

সুস্থ জীবনের জন্য নিরাপদ পানির কোনো বিকল্প নেই। পানির অপর নাম জীবন, তবে সেটা বিশুদ্ধ পানি। কারণ দূষিত পানি অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়ায়। আর্সেনিক দূষণ নিরাপদ জীবনের জন্য অন্যতম প্রধান অন্তরায়। বিশেষজ্ঞগণের মতে, আর্সেনিক হলো একটি রাসায়নিক পদার্থ। ভূগর্ভে আর্সেনিকের সৃষ্টি হয়। নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভ থেকে অতিরিক্ত পরিমাণ আর্সেনিক খাবার পানির সাথে মিশে সৃষ্টি হয় আর্সেনিক দূষণ। এ সমস্যা বাংলাদেশের জন্য একটি মারাত্মক জনস্বাস্থ্য সমস্যা। বাংলাদেশের সমগ্র ভূখণ্ডের ভূগর্ভস্থ পানিতেই রয়েছে আর্সেনিক। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫৯টি জেলার ভূগর্ভস্থ পানিতেই আর্সেনিকের পরিমাণ সহনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি রয়েছে।

আর্সেনিকযুক্ত পানি দেখে বোঝা যায় না এতে আর্সেনিক রয়েছে এবং পানিতে আর্সেনিকের স্বাদ বা গন্ধ পাওয়া যায় না। সাধারণত পানিতে কিছু না কিছু পরিমাণ আর্সেনিক সবসময়ই থাকে। খাবার পানিতে আর্সেনিকের সহনীয় মাত্রা ০.০৫ মিলিগ্রাম। এক লিটার পানিতে ০.০৫ মিলিগ্রাম মাত্রার আর্সেনিক মানুষের শরীরে কোনো ক্ষতি করে না। কোনো নলকূপের পানি পরীক্ষা করে যদি দেখা যায়, ঐ মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণ আর্সেনিক রয়েছে তাহলে সেই নলকূপের পানি খাওয়া ও রান্নার কাজে তা ব্যবহার করা যাবে না। অনেকের ধারণা, ফুটালেই পানি আর্সেনিকমুক্ত হয়। কথাটি সম্পূর্ণ ভুল। তবে আর্সেনিকযুক্ত পানি খাওয়া ও রান্নার কাজ ছাড়া অন্য সব কাজে ব্যবহার করলে ক্ষতি নেই।

আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করে মানুষ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। পরিণাম হচ্ছে মৃত্যু। দেশের গ্রামের অধিকাংশ মানুষ টিউবওয়েলের পানির ওপর নির্ভরশীল। ১৯৯৩ সালে প্রথম জানা যায়, টিউবওয়েলের পানিতেই রয়েছে আর্সেনিক, যা পান করলে একজন সুস্থ ব্যক্তি আর্সেনিক দূষণজনিত রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে দুই এক মাস আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করলেই যে কোনো ব্যক্তি এ রোগে আক্রান্ত হবে, এমন ধারণা ঠিক নয়। কতদিন আর্সেনিকদূষিত পানি পান করলে কোনো ব্যক্তি আর্সেনিক দূষণে আক্রান্ত হবে, তা নির্ভর করে পানিতে আর্সেনিক দূষণের পরিমাণের ওপর। দেখা গেছে, আর্সেনিকদূষিত টিউবওয়েলের পানি পান করে ৫ থেকে ৮ বছর পরও মানুষের দেহে রোগের উপসর্গ দেখা যায়।

আর্সেনিক আক্রান্ত রোগীর প্রাথমিক পর্যায়ে গায়ে কালো কালো দাগ দেখা যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরো ত্বকও কালো হয়ে যেতে পারে। হাত ও নখের চামড়া শক্ত ও খসখসে হয়ে যাওয়ার মতো লক্ষণ দেখা যায়। চোখে কনজংটিভাইটিস দেখা দিতে পারে বা চোখ লাল হয়ে যেতে পারে, বমি বমি ভাব বা পাতলা পায়খানা হওয়ার ক্ষলণও দেখা দিতে পারে। আর্সেনিক সংক্রমণের দ্বিতীয় পর্যায়ে ত্বকের বিভিন্ন স্থানে সাদা-কালো দাগ দেখা দেয়; রোগীর হাত ও পায়ের তালুর চামড়ায় শক্ত হয়ে তাতে গুটি বা গুটলি দেখা যায়; পা ফুলে যায়। তৃতীয় বা শেষ পর্যায়ে রোগীর হাত ও পায়ে গ্র্যাংগ্রিন বা শরীরের প্রান্তদেশীয় অঙ্গে পচন ধরার মতো লক্ষণ দেখা দেয়। ত্বক, ফুসফুস ও মূত্রথলির ক্যান্সারও হতে পারে। লিভার সিরোসিস ও কিডনির কার্যক্ষমতাও লোপ পাওয়া আর্সেনিক দূষণের কারণে হতে পারে।

বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মতে, আর্সেনিক আক্রান্ত রোগীদের প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার খাওয়াতে হবে। এছাড়া প্রাথমিক পর্যায়ে এ রোগ ধরা পড়লে আর্সেনিকযুক্ত পানি খাওয়া বন্ধ করে দিলে রোগী আপনা আপনিই ভালো হয়ে যায়। আর্সেনিকের কার্যকর কোনো চিকিৎসা এখন পযর্ন্ত আবিষ্কার হয়নি। তাই আর্সেনিক সম্পর্কে সচেতন থাকলে এ রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। মনে রাখতে হবে, আর্সেনিক কোনো ছোঁয়াচে বা বংশগত কোনো রোগ নয়। আমাদের সচেতনতাই পারে আর্সেনিক দূষণ থেকে আমাদের রক্ষা করতে।

ভূগর্ভের পানিতে আর্সেনিক থাকার কারণে এখন গ্রামের মানুষদের ভূগর্ভস্থ পানির পাশাপাশি বিকল্প পদ্ধতিতে পানি বিশুদ্ধ করে পান করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। আর এ বিকল্প পদ্ধতিকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। আর্সেনিক দূষণযুক্ত পানি পরিশোধন করে এবং আর্সেনিক দূষণমুক্ত পানি ব্যবহার করার মাধ্যমে।

আর্সেনিক দূষণযুক্ত পানি পরিশোধনের জন্য পর্যায়ক্রমে কিছু ধাপ অনুসরণ করতে হয়। আর্সেনিকমুক্ত নলকূপ যদি পাওয়া না যায় তাহলে বিকল্প হিসেবে পুকুর, নদী, খাল-বিল ইত্যাদির পানি ব্যবহার করা যায়। সে ক্ষেত্রে এক কলসি (বিশ লিটার পরিমাণ পানি) সংগ্রহ করার পর তাতে দশ মিলিগ্রাম বা আধা চামচ পরিমাণ ফিটকিরি মিশিয়ে দুই থেকে তিন ঘণ্টা রেখে দিতে হবে। ফিটকিরি ব্যবহারের ফলে পানির ময়লা তলানি হিসেবে কলসির নিচে জমা হবে। উপরের পরিষ্কার পানি অন্য একটি পাত্রে ঢেলে তলানিযুক্ত পানিটুকু ফেলে দিতে হবে। এবার পরিষ্কার পানিটুকু ভালো করে ফুটিয়ে পান করা যাবে। তবে কুয়ার পানি পান করতে চাইলে আর্সেনিক পরীক্ষা করে নিতে হবে। আর্সেনিক পাওয়া না গেলে কুয়ার পানি ফুটিয়ে পান করতে হবে।

আর্সেনিক দূষণমুক্ত পানি ব্যবহার করতে চাইলে বৃষ্টির পানি ও সংরক্ষণ করে রাখতে হবে। কারণ, একমাত্র বৃষ্টির পানি সম্পূর্ণ আর্সেনিকমুক্ত। এছাড়া পুকুরপাড়ে বালির ফিল্টার, তিন ও চার কলস বিশিষ্ট ফিল্টার ইত্যাদির মাধ্যমে পানি পরিশোধন করা যায়। ফিল্টারের মাধ্যম হিসেবে লোহার গুঁড়া ব্যবহার করা হয়। এই ফিল্টার ইউনিটটি নির্মাণ করতে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা খচর হয়। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর এই ফিল্টার ইউনিট নির্মাণে দীর্ঘ দিন ধরে গ্রাম পর্যায়ে সহযোগিতা করে আসছে।

আর্সেনিক দুই দশকের পুরোনো সমস্যা। প্রাথমিকভাবে এ সমস্যাটিকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হয়নি। বর্তমানে সমস্যাটি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। আর্সেনিক বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বেশ কিছু মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এক জরিপে দেখা গেছে, আট কোটিরও বেশি মানুষ আর্সেনিক দূষণের শিকার। আর্সেনিক দূষণের কারণে নারী ও শিশুসহ বিপুল সংখ্যক মানুষ দীর্ঘস্থায়ী বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত, যা স্বাস্থ্যগত এবং সামাজিক কাঠামোর প্রতি বিরাট হুমকি।

লেখক: ফ্রিল্যান্স রাইটার



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আর্সেনিক দূষণ
আরও পড়ুন