Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অনৈতিক নির্বাচনী সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন রুখতে চাই সুশাসন ও শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ২৪ নভেম্বর, ২০২১, ১২:০৪ এএম

করোনাকাল পেরিয়ে বিশ্ব এখন নিও-নরমাল বাস্তবতায় উপনীত হয়েছে। তবে করোনা মহামারিতে নিরব মৃত্যু ও বিভীষিকার কালোছায়া পুরো বিশ্বব্যবস্থায় স্থায়ী ছাপ রেখে যাচ্ছে। করোনা ভ্যাক্সিনেশন ও সুরক্ষা ব্যবস্থায় বাংলাদেশ বিশ্ব থেকে অনেক পিছিয়ে থাকলেও গত ৬ মাসে প্রাদুর্ভাব কমতে কমতে এখন এক ধরণের সহনীয় মাত্রায় এসে উপনীত হয়েছে। দেড় বছরের বেশি সময়ের মধ্যে গত ২০ নভেম্বর বাংলাদেশে করোনায় কোনো প্রাণহানি ঘটেনি। তবে পরের দিনই ৭ জনের মৃত্যুর খবর আসে। এর মানে হচ্ছে, করোনা ভাইরাস এখনো আমাদের উপর চোখ রাঙাচ্ছে। সব মানুষের টিকাদান নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত সবাইকে সাবধানে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে জীবন যাপন করতে হবে। করোনাভাইরাসের জন্যই শুধু নয়, এই ভাইরাস আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে, চলমান জীবনব্যবস্থা ও সামাজিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতায় আমাদেরকে সর্বদা স্বাস্থ্য সচেতনতা ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার উপর গুরুত্ব দিতে হবে। সেই সাথে সামাজিক-রাজনৈতিক নেতৃত্বকেও মনে রাখতে হবে, যে কোনো সময় যে কোনো ধরণের দুর্যোগ নেমে আসতে পারে। সম্পদের পুঞ্জিভবন এবং পরিসংখ্যানের প্রবৃদ্ধি দিয়ে অর্থনৈতিকভাবে সবকিছু মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। সর্বশেষ তথ্য অনুসারে গত ১০ মাসে বাংলাদেশে মাত্র ২০ ভাগ মানুষকে ২ ডোজ ভ্যাক্সিন দিতে সক্ষম হয়েছে সরকার। চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোতে পূর্ণ ডোজ ভ্যাক্সিনেশনের হার শতকরা ৮০ ভাগের বেশি। তবে বৈশ্বিক গড় হার প্রায় ৪২ শতাংশ। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, করোনা ভ্যাক্সিনেশনে বাংলাদেশের অবস্থান বৈশ্বিক গড় হারের অর্ধেক। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ায় এখনো সবচেয়ে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। দেশের মন্ত্রী এমপিরা ডিসেম্বরের মধ্যে কোটি কোটি ডোজ ভ্যাক্সিন এনে দেশ ভাসিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, শুধু তাই নয়, দেশে কোটি কোটি ডোজ ভ্যাক্সিন তৈরী করে বিদেশে রফতানির কথা বলে মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার করছেন। এসব বলে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা কতটুকু ঢাকা যাবে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। তবে করোনাকালে জরুরি চিকিৎসা সেবা, হাসপাতাল পরিষেবা, স্বাস্থ্য বিভাগের বিশেষ অর্থ বরাদ্দ নিয়ে যে সব দুর্নীতি-অনিয়ম ও অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় লুটপাট হয়েছে, তা কিছুতেই ঢেকে রাখা যাচ্ছে না। সচিবালয় থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ১৭ ফাইল ও ডক্যুমেন্ট চুরি করে সরিয়ে ফেলার মধ্য দিয়ে সে সব কুকর্মের হোঁতারা আত্মরক্ষার শেষ অপচেষ্টা হিসেবে গ্রহণ করেছে।

করোনাকালে লাখ লাখ মানুষ চাকরি ও কর্মসংস্থান হারিয়েছেন। পরিসংখ্যান আনুসারে, গত দেড় বছরে আয় কমে যাওয়ায় কয়েক কোটি মানুষের অবস্থান এখন দারিদ্র্য সীমার নিচে। করোনাকাল পেরিয়ে ধীরে ধীরে অর্থনীতিতে স্বাভাবিক গতি ফিরতে শুরু করলেও কর্মহীন কোটি মানুষের কর্মসংস্থান ও আয়বৃদ্ধির তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। তবে জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানোর কথা বলে লিটার প্রতি ডিজেলের দাম ১৫ টাকা বাড়িয়ে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া পরিবহন মালিকদের বাড়তি আয়ের সুযোগ করে দিতে ক্ষেত্র বিশেষে ৩০-৪০ ভাগ ভাড়াবৃদ্ধির ঘোষণা দিতে দুইদিনও সময় নেয়নি সরকার। সারাদেশে গণপরিবহন বন্ধ করে দিয়ে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে এই ভাড়াবৃদ্ধির কৌশল কাজে লাগিয়েছে সরকারের বশংবদ পরিবহন মালিকরা। এমনিতেই গত কয়েক মাসে নিত্যপণ্যের মূল্য লাগামহীন হয়ে পড়েছিল, ডিজেলের মূল্য ও গণপরিবহণের ভাড়া বৃদ্ধির সুযোগে পণ্যমূল্য আরেক দফা বাড়িয়ে কোটি কোটি দরিদ্র মানুষের জীবনযাপনের ব্যয় নির্বাহ করা দুর্বহ করে তোলা হয়েছে। শহুরে নিম্নমধ্যবিত্ত এবং গ্রামীন অর্থনীতিতে কর্মসংস্থানের সংকট ও দারিদ্র্যবৃদ্ধির প্রভাব সমাজের সব স্তরেই পড়তে দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ করে সমাজে অস্থিতিশীলতা ও সহিংসতার মাত্রা বেড়ে যাওয়া তারই প্রতিফলন। বিশেষত ইউনিয়ন পরিষদের মত তৃণমূল স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিরোধিদল বিএনপি সরাসরি অংশগ্রহণ না করায় রাজনৈতিক উত্তাপ না থাকলেও ভোটারদের মনোভঙ্গিতে বড় ধরণের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একই দলের নেতাকর্মীরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করলেও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বার নির্বাচনে টাকা দিয়ে ভোট কেনা এবং সহিংস রক্তপাতের ঘটনা সাম্প্রতিককালে এর আগে দেখা যায়নি। কোটি কোটি মানুষের দারিদ্র্য, পণ্যমূল্য বৃদ্ধিতে জীবনযাপনের ব্যয়বৃদ্ধির কারণে একশ্রেণীর সাধারণ মানুষ নির্বাচনের প্রার্থীদের উপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে টাকা আদায় করে নিচ্ছে, এমনটাই ধরে নেয়া যায়। অন্যদিকে ক্ষমতার দ্বন্দ ও প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত দলীয় নেতাকর্মীরা প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় হাট-ঘাটের ইজারা, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি করে যে অর্থ জমিয়েছেন, নির্বাচনে তার কিছুটা খরচ করে নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি ধরে রাখার চেষ্টা করছে। নির্বাচনী সহিংসতা কমিয়ে আনার জন্য অনেকগুলো ধাপে দীর্ঘ সময় নিয়ে নির্বাচন করা হলেও গত তিনটি ধাপে নির্বাচনী সহিংসতায় শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। স্থানীয় নির্বাচনে পাস করা চেয়ারম্যান-মেম্বারদের বেশিরভাগ নির্বাচনের খরচ তুলে পরবর্তি নির্বাচনের বৈতরনী পার হওয়ার জন্য অর্থ জমানোর টার্গেট নিয়েই কাজ করেন। এর ব্যতিক্রমও আছে, স্থানীয় বিশিষ্ট্য ব্যবসায়ী ও ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানরাও শুধুমাত্র পদবির জন্য লাখ লাখ টাকা খরচ করে চেয়ারম্যান-মেম্বার হওয়ার প্রতিযোগিতায় নামতে দেখা যায়। তবে দলীয় প্রভাবশালী এমপির ছত্রছায়ায় থাকা প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় পদ লাভের মওকা পাচ্ছেন। শত শত ইউনিয়নে বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার মানে এই নয় যে, সেখানে তার কোনো প্রতিদ্বন্দি প্রার্থী ছিল না। দলীয় পদ ও এমপি-মন্ত্রীদের প্রভাব কাজে লাগিয়ে সম্ভাব্য পটেনশিয়াল প্রার্থীদের নির্বাচন থেকে দূরে রাখার সব রকম ব্যবস্থাই সক্রিয় থাকতে দেখা যাচ্ছে। কোথাও কোথাও নৌকার প্রতিদ্বন্দি প্রার্থীদের উপর হামলা করে, আপস করতে বাধ্য করে নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের বিজয়ের পথ নিষ্ককণ্টক করা হয়েছে। এরপরও দলীয় বিদ্রোহী ও অন্যদলের ছদ্মবেশি প্রার্থীদের কাছে সরকারি দলের হেভিওয়েট প্রার্থীদের পরাজিত হওয়ার অনেক নজির সৃষ্টি হয়েছে।

বিগত দুইটি জাতীয় নির্বাচনে মানুষ স্বচ্ছন্দে ভোট দিতে পারেনি। বিনাভোটে, বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় নির্বাচিত এমপি-মন্ত্রীদের অনেকে পরবর্তি স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে নিজেদের প্রয়োজনে পসন্দের প্রার্থীদের বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় জিতিয়ে নেয়ার কারসাজি করেছেন। গত ১০ বছরে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। একদলীয়-একতরফা নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন ঘটে না। এ কারণে সাধারণ মানুষ ও বিরোধিদলের সমর্থক ভোটাররা এ ধরণের নির্বাচন ও ভোটদানের প্রতি আগ্রহ ও আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন।বিএনপি’র অংশগ্রহণ না থাকায় এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে মূলত আওয়ামীলীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা ক্ষমতার দ্বন্দ, প্রভাব বিস্তার ও জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের লড়াই হিসেবেই গ্রহণ করেছে। নির্বাচন হতাহত শত শত মানুষের ৯০ভাগই আওয়ামীলীগের নেতাকর্মী। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে এটিই হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ ও স্থানীয় নির্বাচন। আগামী নির্বাচন ফ্রি ও ফেয়ার হলে মাঠের অবস্থা কি দাঁড়াতে পারে, সরকারের সংশ্লিষ্টরা হয়তো এই নির্বাচন থেকে একটি ধারণা নেয়ার চেষ্টা করবেন এবং নির্বাচনী সমীকরণ নিজেদের অনুকুলে রাখতে সম্ভাব্য কর্মপন্থা অবলম্বনে মনোযোগী হবেন। এ ক্ষেত্রে অর্থের বিনিময়ে ভোট কেনার যে নতুন মাত্রা সংযুক্ত হলো, অন্য সবকিছু বাদ দিলেও দলীয় এমপি-মন্ত্রী, দুর্নীতিবাজ আমলা এবং প্রশাসনের যে সব কর্মকর্তা কোটি কোটি টাকা কামিয়ে অবসর গ্রহণের পর অঢেল টাকা খরচ করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেই পারেন। নির্বাচনের এমন ট্রেন্ড দেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থাকে চরমভাবে কলুষিত করে তুলেছে। নির্বাচনের পোস্টার-ব্যানারে জনরগণের সেবা করার সুযোগ দেয়ার কথা বলা হলেও নির্বাচিত হওয়ার পর ৪-৫ বছর ধরে জনগণের রাজস্বের টাকায় উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ বাজেট নিয়ে মতলবি কর্মকান্ড জনপ্রতিনিধিদের প্রতিও মানুষ আস্থাহীন হয়ে পড়ছে। নির্বাচনের প্রতি, ভোটের প্রতি, প্রার্থীর যোগ্যতা ও নিরপেক্ষতার প্রতি মানুষের এই আস্থাহীনতার সংকট আমাদের সমাজ, রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উত্তরণের সম্ভাবনাকে আরো কঠিন ও দুরূহ করে তোলছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও অবকাঠামো উন্নয়নের চেয়ে সামাজিক-রাজনৈতিক মূল্যবোধ ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির উন্নয়ন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তা নাহলে, কোটি কোটি মানুষের মেধা ও পরিশ্রমের ঘামে অর্জিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অর্থ রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় বেপরোয়া লুটেরা ও দুর্নীতিবাজ আমলাদের হাত দিয়ে বিদেশে পাচার হওয়া কখনো বন্ধ হবে না। রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতির পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন ছাড়া সাধারণ মানুষের কাছে স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তোলা সম্ভব নয়।

মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের জাগরণ ছাড়া দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ণের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক লুটপাট ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর করা সম্ভব নয়। এ জন্য প্রথমেই দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে দুর্নীতি, দলবাজি ও অপরাজনীতি মুক্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে। দেশের অশিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত কৃষিশ্রমিক, গার্মেন্টকর্মী, প্রবাসি কর্মীরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দেশের অর্থনীতিকে মজবুত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করছেন। বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ বাড়িয়ে তোলছেন, একশ্রেণীর তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত মানুষ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুইফ্ট কোড ম্যানিপুলেশন করে, সরকারি বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালক হয়ে, শেয়ার বাজারের বিনিয়োগকারি হয়ে, আমদানি-রফতানিকারক হয়ে, সরকারের আমলা, এমপি-মন্ত্রী হয়ে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে দেশের বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে অনিশ্চয়তার পাঁকে ঠেলে দিয়েছেন। বড় বড় ঋণখেলাপি, অর্থপাচারকারিদের বেশিরভাগই দেশি-বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীধারি উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, উচ্চতর ডিগ্রী তাদেরকে শিক্ষিত মানুষ হিসেবে নৈতিক মানদন্ডে উন্নীত করতে পারেনি বলেই গুরুত্বপূর্ণ পদ ও দায়িত্বে থেকে তারা জনগণের সম্পদ লুণ্ঠনের ডাকাতি চৌর্যবৃত্তিতে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। আমাদের শিক্ষক সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা কারিক্যুলাম শিক্ষিত মানুষের আত্মমর্যাদা, নৈতিকতা, সাম্যভিত্তিক সমাজ বিনির্মানের দায়িত্ব পালনের বদলে দেশে লুটপাটতন্ত্র, চৌর্যবৃত্তি. অশ্লীলতা ও বেহায়াপনার বিস্তারে ভ’মিকা পালন করছেন। দেশে লাখ লাখ শিক্ষিত বেকার কর্মহীন ঘুরে বেড়ালেও দেশের গার্মেন্টস সেক্টরসহ কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন রফতানিমুখী সেক্টরে লাখ লাখ বিদেশি কর্মী কাজ করে এককোটি প্রবাসি শ্রমিকের আয়ের বড় অংশ বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে। নৈতিকশিক্ষা, দায়িত্বশীলতা, দেশপ্রেমের কথা বাদ দিলেও দক্ষতা ও কর্মমুখী শিক্ষার থেকেও আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার গলদ ও ব্যর্থতা ধরা পড়ে। এহেন ব্যর্থতাও অনৈতিক শিক্ষার চক্রে বন্দী একশ্রেণীর মানুষ উঠতে বসতে দেশের ধর্মীয় শিক্ষা তথা মাদরাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে বিষোদগার করছেন। আলিয়া মাদরাসায় শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, সুযোগ সুবিধা বন্ধের সুপারিশ করছেন। কওমি মাদরাসায় দরিদ্র –এতিম শিক্ষার্থীদের থাকা-খাওয়া ও ধর্মীয় শিক্ষার সুযোগ বন্ধ করতে জঙ্গিবাদের লেবেলিংয়ের পাশাপাশি অর্থের সংস্থান সঙ্কোচিত করতে এসব মাদরাসার বাৎসরিক আয়ের প্রধান উৎস কোরবানির পশুর চামড়ার মূল্য সিন্ডিকেটেড কারসাজির মাধ্যমে ধস নামানো হয়েছে। মাদরাসার আয়ের আরেকটি উৎস বাৎসরিক ওয়াজ মাহফিল। এর মধ্যে রাজনৈতিক ভেদাভেদ ঢুকিয়ে পুলিশি তৎপরতায় ওয়াজ মাহফিলের সুযোগও সীমিত করা হচ্ছে, এরপরও কোনোকিছুই বন্ধ থাকছে না। বাংলাদেশের কওমি-হাফেজি মাদরাসার শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন আন্তজার্তিক ক্বিরাত, আযান প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রথম সারির পুরষ্কার জিতে দেশের মান-মর্যাদা বাড়াচ্ছেন। আর শিক্ষা বাজেটের ৯০ ভাগ ব্যয় করা সাধারণ শিক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিংয়ে স্থান পাচ্ছে না। যারা সব সময় মাদরাসায় শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশেষায়িত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম স্থান দখল করে তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন, মাদরাসা বিরোধিরা আসলে বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারি। তাদের দাবি অসার ও মিথ্যা। স্কুল-কলেজের মত অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক সুবিধা ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে মাদরাসার শিক্ষার্থীরাই দেশে দক্ষ, সৎ ও কর্মমুখী জনশক্তির যোগান নিশ্চিত করতে আরো কার্যকর ভ’মিকা রাখতে পারবে।

প্রতিবছর দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, পলিটেকনিক, ভোকেশনাল ও বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী পাস করে বের হয়। এদের বেশিরভাগই বছরের পর বছর ধরে চাকরির জন্য ঘুরে বেড়াতে বাধ্য হয়। অন্যদিকে দেশের রফতানিমুখী শিল্পকারখানা ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিবছর লাখ লাখ বিদেশি কর্মীকে অবৈধভাবে নিয়োগ দিয়ে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের পথ খোলা রাখা হয়েছে। এ থেকে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ব্যর্থতা এবং কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় বড় ধরণের ঘাপলা ধরা পড়ে। একশ্রেণীর তথাকথিত উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তির অনৈতিক কর্মকান্ডের খেসারত দিচ্ছে দেশের ১৭ কোটি মানুষ। এবারো বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের দায়ে বুয়েটের শিক্ষক, ইন্ডাসট্রিয়াল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান নিখিল রঞ্জন ধরকে বহিষ্কার করেছে কর্তৃপক্ষ। কয়েক বছর আগে ঢাকার নামি-দামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক পরিমল জয়ধর ছাত্রী ধর্ষণের দায়ে শাস্তি হয়েছিল। দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নীতিহীন, দলবাজ-দলকানা লোকদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় শিক্ষার মান এবং শিক্ষিত ব্যক্তিদের নৈতিকতায় ক্রমাবনতি ঘটে চলেছে। এর প্রভাব পড়েছে আমাদের সমাজে, রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে। কিছু সংখ্যক মুখচেনা বুদ্ধিজীবী এসব নিয়ে কখনো কথা না বললেও দেশের মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে তাদের গাত্রদাহ লক্ষ্য করা যায়। দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ভর্তি পরীক্ষায় মাদরাসা শিক্ষার্থীদের মেধাস্থান দখল করা থেকে এটাই প্রমাণিত হয়, নানা ত্রুটিবিচ্যুতি এবং অপর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা সত্বেও দেশের মাদরাসা শিক্ষা এখনো সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় অবক্ষয়মুক্ত। তথাকথিত নামিদামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাবাণিজ্য, কোচিং বাণিজ্য এবং শিক্ষাকে উচ্চ গ্রেড নির্ভর সার্টিফিকেট সর্বস্ব অনৈতিক বাণিজ্য থেকে মুক্ত করতে না পারলে দেশ ও সমাজ থেকে দুর্নীতি-অনিয়ম ও দুর্বৃত্তায়ণ দূর করা সম্ভব নয়। শিক্ষা ব্যবস্থাকে ব্যয়বাহুল্য ও অনৈতিক প্রতিযোগিতা থেকে মুক্ত করে কর্মমুখী দক্ষতা ও নৈতিক মানদন্ডে প্রতিষ্ঠিত করার পদক্ষেপ নিতে হবে।

[email protected]



 

Show all comments
  • jack ali ২৪ নভেম্বর, ২০২১, ১২:০৪ পিএম says : 0
    until and unless we establish the Law of Allah then we will suffer in the hand of enemy of Allah government. O'Muslim wake up and fight for the right of Allah.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন