২০৩৫ সালের মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত মোটা হবেন ৪০০ কোটি মানুষ
২০৩৫ সালের মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত ওজন বা মোটা হবেন বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ। সংখ্যার বিচারে যা
১৯৯১ সাল থেকে প্রতি বছর ১৪ নভেম্বর আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। দিবসটি আন্তজার্তিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন ও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই ডায়াবেটিস রোগের সচেতনতার জন্য বেশ গুরুত্বের সাথে পালিত হয়। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। মূলত এই ১৪ নভেম্বর হলো স্যার ফ্রেড্রিক বান্টিং এর জন্ম দিবস। স্যার ফ্রেড্রিক বান্টিং এবং চার্লস বেস্ট যৌথভাবে ইনসুলিন আবিষ্কার করার জন্য ১৯২৩ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন।
প্রতিবছরই বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস উপলক্ষ্যে আন্তজার্তিকভাবে একটি প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়। বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস উপলক্ষে ২০২১ইং এ প্রতিপাদ্য “ডায়াবেটিস সেবা নিতে আর দেরী নয়”। এই দিবসটি যথাযত ও কার্যকরভাবে পালন করার জন্য বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতিসহ ডায়াবেটিস রোগের সাথে সংশ্লিষ্ঠ প্রায় সকল প্রতিষ্ঠান নানা কর্মসূচি পালন করে। ‘ডায়াবেটিস’ রোগটি সম্পর্কে সচেতনতা ও ধারনা দেওয়াই দিবসটি পালনের মূল উদ্দেশ্য। এই সচেতনতা সৃস্টির মাধ্যমে পৃথিবীর ১৬০ টিরও বেশী দেশে এক বিলিয়নের ও বেশি লোকের মধ্যে সচেতনতা তৈরী হয়।
কিন্ত বিভিন্ন জরিপে দেখা যাচ্ছে এত প্রচার সত্ত্বেও আজ বিশ্বজুড়ে ডায়াবেটিসের প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সাম্প্রতিক জরিপে দেখা যায় বাংলাদেশের ৫৫ ভাগ লোক নিজেরা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত অথচ নিজেরাই তা জানে না। একই ভাবে শিশুদের মধ্যেও ডায়াবেটিসের প্রকোপ বাড়ছে। ডায়াবেটিসে রক্তে শর্করা বা গ্লুকোজ বেড়ে যায়। শরীর প্রথমে খাদ্যের কার্বোহাইড্রেটগুলি খাওয়ার পর হজমের জন্য ভেঙে একধরণের চিনি বা গ্লুকোজে রূপান্তরিত করে। সেই গ্লোকোজ পেটের নালী বা গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ট্রাক্ট থেকে রক্ত প্রবাহে শোষিত হয়। একারনে রক্তের গ্লোকোজ স্তর খাওয়ার পরে বেড়ে যায় এবং তখন অগ্নাশয় থেকে ইনসুলিন নামক হরমোন তৈরি হয়ে রক্তে প্রবাহিত হয় এবং ইনসুলিন রক্ত থেকে এই গ্লোকোজকে শরীরের কোষে নিয়ে যায়, যেখানে এটি জ্বালানির জন্য ব্যবহৃত হয়।
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে শরীরে এই ইনসুলিনের স্বল্পতা দেখা দেয় নতুবা ইনসুলিন তার কার্যক্রম সঠিকভাবে করতে পারেনা। দুই প্রকার ডায়াবেটিস হ’ল টাইপ- ১ এবং টাইপ- ২। উভয়ক্ষেত্রেই রক্তে শর্করার মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়। তবে এই দুই ক্ষেত্রে শর্করার বেড়ে যাওয়ার কারন ভিন্নতর।
বেশিরভাগ শিশু শৈশবে টাইপ ১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। তবে, টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত শিশু এবং অল্প বয়স্কদের সংখ্যা বর্তমানে বাড়তে শুরু করেছে। আগে চিকিৎসকেরা জানতেন যে বাচ্চারা কেবল টাইপ ১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় এবং একে দীর্ঘকাল ধরে কিশোর ডায়াবেটিস (জুভেনাইল ডায়াবেটিস) নামে নামকরন করা হত।
শিশুদের টাইপ ১ ডায়াবেটিস অবস্থায় শরীরে ইনসুলিন উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দেয়। তাই এক্ষেত্রে বেঁচে থাকার জন্য ইনসুলিনের দরকার পরে। ইনসুলিনের ঘাটতি বা অভাবকে ইনসুলিন ইঞ্জেকশন বা পাম্পের মাধ্যমে পূরন করা হয়।
টাইপ ১ ডায়াবেটিসে, অগ্নাশয় ইনসুলিন তৈরির ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে কারণ ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষগুলি ধ্বংস হয়ে যায়। কেন এমনটি ঘটে তা সঠিকভাবে কেউ জানেন না, তবে বিজ্ঞানীরা মনে করেন এটা জেনেটিক এবং জিনের সাথে সম্পৃৃক্ত। টাইপ ১ ডায়াবেটিস সম্ভবত ভাইরাসের সংক্রমনের কারনেও হয়ে থাকে।
অন্যদিকে, টাইপ ২ ডায়াবেটিসে, অগ্নাশয়ের ইনসুলিন তৈরিতে কোন ব্যঘাত হয় না। তবে এক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে ইনসুলিন শরীরের কোষগুলিতে কাজ করে না বা প্রতিক্রিয়া দেখাতে ব্যর্থ হয়। ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স্- এর কারনে এই সমস্যা দেখা দেয় তখন গ্লোকোজ কোষগুলিতে প্রবেশ করতে পারেনা এবং শক্তি সরবরাহ করার সক্ষমতা কমে যায়। একারনে রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যায়, ফলে পর্যায়ক্রমে অগ্নাশয় আরও বেশি বেশি ইনসুলিন তৈরি করতে সচেস্ট হয়। অবশেষে, একসময় অগ্নাশয় রক্তে শর্করার মাত্রা স্বাবাভাবিক রাখতে পর্যাপ্ত ইনসুলিন উৎপাদন করতে ধীরে ধীরে অক্ষম হয়ে পরে।
ডায়াবেটিসের লক্ষণ:
রক্তে উচ্চমাত্রার শর্করার জন্য ঘন ঘন প্র¯্রাব হয় এবং খুব তৃষ্ণার্ত থাকে বিধায় প্রচুর পানি পান করতে হয়। ক্লান্তি বা অবসাদ বোধ থাকে। কারণ শরীর শক্তির জন্য গ্লোকোজ সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারেনা। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত শিশু এবং কিশোরদের ক্ষুধা বাড়তে পারে তবে ক্ষুধার্ত কোষগুলিকে জ্বালানী সরবরাহ করার প্রয়াসে শরীর পেশী ভেঙ্গে ফ্যাট সংরক্ষণ করে যার জন্য ওজন হ্রাস পায়।
ডায়াবেটিস-এর চিকিৎসা :
চিকিৎসা অর্থাৎ লক্ষণগুলো হ্রাস করার জন্য ভাল ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ, স্বাস্থ্য সমস্যা প্রতিরোধ এবং শিশু যাতে স্বাভাবিকভাবে তার শারীরিক, মানসিক সংবেদনশীলতা বজায় রেখে সামাজিক বৃদ্ধি এবং বিকাশে সম্ভবপর হয়। আর এর জন্য,বাবা-মাকে লক্ষ্য রাখতে হবে শিশুর রক্তের শর্করার মাত্রা যতটা সম্ভব লক্ষ্য সীমার মধ্যে রাখা।
এই মুহুর্তে, ডায়াবেটিসের কোনও নিরাময় নেই, ডায়াবেটিসের জন্য আজীবন চিকিৎসা প্রয়োজন। টাইপ ১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত শিশু কিশোররা তাদের রক্তের গ্লোকোজ স্তর নিয়ন্ত্রণ করতে প্রতিদিন ইনসুলিন ইনজেকশন বা ইনসুলিন পাম্পের উপর নির্ভর করে। তবে যথাযথ যত্ন সহ, তারাও স্বাস্থ্যকর ভাবে বেড়ে উঠবে এবং অন্যান্য শিশুদের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবে।
অন্যদিকে, শিশুদের মধ্যে টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে লক্ষন ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করে এবং প্রথমদিকের কোন লক্ষনই থাকে না। কখনও কখনও, নিয়মিত চেক-আপের সময় এই ব্যাধিটি সনাক্ত করাহয়। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসে ভবিষ্যতে হৃদরোগ, অন্ধত্ব দেখা দিতে পারে এবং কিডনি অকার্যকর হওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃস্টি হতে পারে। শিশুদের মধ্যে টাইপ ২ ডায়াবেটিসের একক প্রধান কারণ হ’ল অতিরিক্ত ওজন। যখন কোনও শিশুর খুব বেশি ওজন বেড়ে যায়, তখন তাদের ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা দ্বিগুণ হয়।
ডায়াবেটিস নিশ্চিত হয়ে গেলে, জীবনধারা বা লাইফস্টাইল পরিবর্তন করতে হবে। এছাড়া চিকিৎসকের পরামর্শ মত ওষুধ গ্রহণের প্রয়োজন হতে পারে।
সাধারণত ডাক্তারদের শিশুর টাইপ ১ বা টাইপ ২ ডায়াবেটিস আছে কিনা তা নির্নয় করা আবশ্যক, কারণ ডায়াবেটিসের নিয়ন্ত্রন এবং চিকিৎসা টাইপের ভিত্তিতে পৃথক হয়।
ডায়েট ক্যালরি, অস্বাস্থ্যকর ফ্যাট এবং মিষ্টি কমিয়ে দিতে হবে, ফাস্ট ফুড খাওয়া বন্ধ করতে হবে। ডায়টিশিয়ানের পরামর্শে খাবারের পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। প্রতিদিন শারীরিক কসরৎ বা ব্যয়ামকরতে হবে এবং প্রতিদিনকার জীবনধারা একটা নিয়মের মধ্যে আনতে হবে। প্রতিদিন কমপক্ষে ৬০ মিনিট করে জোরে হাটতে হবে বা ব্যায়াম করতে হবে। বাড়িতে শিশুর মোবাইল বা ডিভাইস আসক্তির সময় ২ ঘণ্টারও কমসময়ে সীমাবদ্ধ করতে হবে।
অধ্যাপক (ডাঃ) মনজুর হোসেন
সভাপতি, বাংলাদেশ শিশু চিকিৎসক সমিতি।
সাবেক অধ্যাপক ও পরিচালক, ঢাকা শিশু হাসপাতাল।
ডাঃ মনজুর’স চাইল্ড কেয়ার সেন্টার।
সাত মসজিদ রোড, ধানমন্ডি, ঢাকা।
সেল- ০১৭১১৪২৯৩৭৩।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।