Inqilab Logo

শুক্রবার, ০৫ জুলাই ২০২৪, ২১ আষাঢ় ১৪৩১, ২৮ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

অর্থনৈতিক বৈষম্য পুঁজিবাদী লুটপাটতন্ত্র ও প্রহসনের নির্বাচনী গণতন্ত্র

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ১০ নভেম্বর, ২০২১, ১২:০২ এএম

মিলিনিয়ামের প্রথম দশকে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে একটি মহামন্দা দেখা দিয়েছিল। এটি শুরু হয়েছিল ২০০১ সালে আমেরিকায় বিশ্ববাণিজ্যকেন্দ্রে কথিত সন্ত্রাসী বোমাহামলার পর তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশের নির্দেশনায় ওয়ার অন টেররিজম বা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নাম দিয়ে। সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখ টুইন টাওয়ার বিমান হামলার এক মাসের মধ্যেই মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সবচেয়ে বড় যুদ্ধ মহড়া চালিয়ে আফগানিস্তান ও ইরাক দখল করে নেয়। এই যুদ্ধে কোনো পক্ষের সরাসরি বিজয়ী হওয়ার কোনো সম্ভাবনা না থাকলেও পেন্টাগনের ওয়ার স্ট্র্যাটেজিস্টরা এর নাম দিয়েছিল অন্তহীন যুদ্ধ বা এন্ডলেস ওয়ার। হাজার হাজার কোটি ডলারের সমরাস্ত্র আর লাখ লাখ পশ্চিমা সেনাবাহিনী মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগেই জর্জ বুশ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের শিরোনাম দিয়েছিলেন ক্রুসেড। এ যেন সেই নবম দশম শতাব্দীর পশ্চিমা খৃষ্টানদের ধর্মযুদ্ধেরই নবতর মার্কিন সংস্করণ। আদতে এটি কোনো ধর্মীয়, আদর্শিক বা রাজনৈতিক লক্ষ্যাভিসারি সামরিক অভিযান ছিল না। এটি ছিল মূলত শিল্পায়ন ও বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়া ও ঝিমিয়ে পড়া পশ্চিমা অর্থনীতির গ্যাঁড়াকল ডিঙিয়ে মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্স বা সমরাস্ত্র ব্যবসার সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর গোপন নীলনকশা। যুদ্ধ সংক্ষিপ্ত হলে বা সহজেই বিজয়ী হলে অস্ত্র বাণিজ্য ততটা লাভ জনক হয় না। গত দুই দশকে মধ্যপ্রাচ্যে এমন কিছুই ঘটেনি যার কারণে সউদী আরব বা সংযুক্ত আরব আমিরাতকে শত শত বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ও নিরাপত্তা চুক্তি করতে হয়েছে। পশ্চিমা মিডিয়া ও কূটনৈতিক চ্যানেলগুলো একেক সময় একেকটি জুজু সৃষ্টি করে তাদের বশংবদ সরকারগুলোকে চাপে রেখে নিরাপত্তা ও অস্ত্রচুক্তির ফাঁদে ফেলেছে। আরব বসন্ত থেকে আল কায়েদা-আইএস’র তৎপরতা সিরিয়া-লিবিয়ার বিদ্রোহীদের নেপথ্যে একই শক্তি সক্রিয় ছিল। ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সউদী-আমিরাত জোটের অভিযান শুরুর আগে একে অতি সংক্ষিপ্ত সামরিক অভিযান হিসেবে অভিহিত করা হলেও গত ৫ বছরেও যুদ্ধ বন্ধ হয়নি। আফগানিস্তারে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর মত ইয়েমেন যুদ্ধে সউদী জোটের বিজয় লাভের কোনো সম্ভাবনা না থাকলেও তারা এখনো লড়াই অব্যাহত রেখেছে মূলত ওয়ার কন্ট্রাক্টরদের পরামর্শে।

পশ্চিমা মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের বাণিজ্যের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যারা জড়িত তাদের সবচেয়ে প্রভাবশালী অংশটির সাথে ইহুদী কর্পোরেট ব্যাংকার, থিঙ্কট্যাঙ্ক, হাইটেক, কর্পোরেট মিডিয়া ইনকর্পোরেশনের একটি নিবিড় সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাওয়া যায়। যুদ্ধ যেখানেই হোক, অস্ত্র ও লজিস্টিক সরবরাহ, যোগাযোগ প্রযুক্তি ও জনমত গঠনের মত বিষয়গুলোর সাথে যারা সম্পৃক্ত, তারা নিজেরা কখনোই যুদ্ধের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত আক্রান্ত হতে দেখা যায়নি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ থেকে শুরু করে কোরীয় যুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, ইরান-ইরাক যুদ্ধ, প্রথম গাল্ফ ওয়ার, ওয়ার অন টেররিজম, সিরিয়া ও ইয়েমেনের যুদ্ধ পর্যন্ত কোনো যুদ্ধই অপরিহার্য ছিল না এবং এসব প্রতিটি যুদ্ধের শুরুতেই যুদ্ধবিরতি ও আলোচনা ও কূটনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে শান্তিচুক্তির সুযোগ ছিল। সেসব সুযোগ কাজে লাগানো হলে বছরের পর বছর ধরে যুদ্ধের খরচ যোগানোর মধ্য দিয়ে বিশ্বে সম্পদের বৈষম্য সৃষ্টির পাশাপাশি ওয়ার প্রফিটিয়ারিংয়ের মাধ্যমে কর্পোরেট পুঁজিবাদের হাতে সম্পদের এমন পাহাড় জমে ওঠার কোনো সুযোগ ছিল না। বিংশ শতকের এসব যুদ্ধের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যারা যুদ্ধ শুরু করেছিল তারা কখনোই বিজয়ী হতে পারেনি। এর কারণ হচ্ছে, যুদ্ধ শুরুর নেপথ্য শক্তির লক্ষ্য যুদ্ধে জেতা নয়, প্রতিপক্ষের সম্পদ লুন্ঠন করা, ধ্বংস করা এবং জ্বালানি ও অর্থনৈতিক কাঠামোর উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ সুপ্রতিষ্ঠিত করা। তারা রথ দেখেছে কলা বেচেছে, গাছেরটা খেয়েছে তলারটাও কুড়িয়েছে। অস্ত্র বিক্রি থেকে পশ্চিমা ট্যাক্সপেয়ারদের পকেট থেকে শত শত বিলিয়ন ডলারের আয় ধরে রাখতে প্রতিপক্ষের কাছেও গোপনে অস্ত্র বিক্রি করে যুদ্ধ প্রলম্বিত করার নজির রয়েছে। আশির দশকে সিআইএ ও মার্কিন প্রশাসনের গোপণে ইরানের কাছে অস্ত্র বিক্রির ঘটনাটি পশ্চিমা মিডিয়া ইরান-কন্ট্রা কেলেঙ্কারি নামে আখ্যায়িত করে। নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও ইরানে অস্ত্র বিক্রির টাকা সিআইএ’র মাধ্যমে নিকারাগুয়ার কমিউনিস্ট বিরোধী কন্ট্রা বিদ্রোহীদের দেয়ার তথ্য থেকে এ ঘটনা ইরান-কন্ট্রা কেলেঙ্কারি নামে পরিচিতি লাভ করেছে। লেবানিজ পত্রিকায় এ ঘটনা ফাঁস না হলে হয়তো দুনিয়ার কেউ তা জানতেও পারত না। পরবর্তিতে তদন্তে মার্কিন নিরাপত্তা সহকারী অলিভার নর্থ এবং সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানকে এই কেলেঙ্কারির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। গত একশ’ বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ প্রেসিডেন্টই কোনো না কোনো কেলেঙ্কারি ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হতে পারেন। আধুনিক বিশ্বে গণতন্ত্র বা জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়ে পরাশক্তি হয়ে ওঠা দেশটি বিশ্বের দেশে দেশে গণতন্ত্র ও গণবিরোধী, বশংবদ শাসন প্রতিষ্ঠায় যুদ্ধ ও অনৈতিক কেলেঙ্কারির আশ্রয় নিয়েছে। ইরান-মিশরের মত দেশেও তারা গণতন্ত্রের কবর রচনা করে রাজতন্ত্র ও সামরিকতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার মদদ দিয়েছে।

বিশ্ব অর্থনীতিতে এক টালমাটাল অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে তিন দশক ধরে। এই অর্থনৈতিক মন্দা সামলাতে রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের পুরানো কৌশল ব্যবহারের কারণে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার নামে দেশে দেশে এক ধরণের পলিটিক্যাল সার্কাস চলছে। বিষাক্ত সাপের হাতেই নাকি বেশিরভাগ সাপুড়ের মৃত্যু হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিবার্চনে হিলারি ক্লিন্টনের সম্ভাব্য বিজয় ঠেকিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ওভাল অফিসে বসাতে নাকি রাশিয়া নেপথ্যে কাজ করেছে। এই অভিযোগ ইতিমধ্যে রাশিয়াগেট ক্যালেঙ্কারি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। সব জনমত ও জরিপ ফলাফলের রিপোর্টগুলো ছাপিয়ে অস্বাভাবিক এক শ্বাসরুদ্ধকর বাস্তবতায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া অত:পর শত শত মার্কিন শহরে নির্বাচনী ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে হাজার হাজার মানুষের রাজপথে নেমে আসার মত ঘটনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এর আগে আর কখনো ঘটেনি। সেই অস্বাভাবিক বাস্তবতার ধারাবাহিকতায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের নির্বাচনে জনগণের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরও তাকে ক্ষমতায় রাখার ডিপস্টেট ষড়যন্ত্রের কুৎসিত চেহারা দেখা গেল ২০২০ সালে নির্বাচনের পর। একদল উন্মাদ মার্কিনী বন্য জানোয়ারের মত হামলে পড়েছিল ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটল ভবনে। তাদের সেই ধ্বংসাত্মক উন্মত্ততা সারাবিশ্ব দেখেছে। বিশ্বের দেশে দেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে এবং নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজেদের বশংবদ শাসক বসাতে যুগ যুগ ধরে সিআইএ যেসব তৎপরতা চালিয়ে আসছে, এখন খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই তারা সেসব দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করে চলেছে। আমাদের দেশে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করেনি। বেশিরভাগ আসনে সরকারি দলের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় বিনাভোটে নির্বাচিত ঘোষিত হয়েছে। একাদশ জাতীয় নির্বাচনে বেশিরভাগ দল অংশগ্রহণ করলেও জনগণ ভোট দেয়ার সুযোগই পায়নি। রাতের বেলা ব্যালটে সিল মেরে বাক্স বোঝাই করে রেখে পরের দিন গণনা করার তথ্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও প্রচারিত হয়েছে। নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, গণমাধ্যমকর্মী নিয়ন্ত্রণ, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ম্যানেজ করে শতকরা ৯৫ শতাংশ আসনে ক্ষমতাসীনদের বিজয় নিশ্চিত করার পরও আমাদের রাজনৈতিক কর্মীরা জাতীয় সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন বা প্রেসিডেন্ট ভবন ঘেরাও বা অবরোধের মত কোনো কর্মসূচি দেয়নি। নির্বাচনে জো-বাইডেনের বিজয়কে দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাঁধিয়ে ঠেকিয়ে দিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উস্কানিমূলক পোস্টে উদ্বুদ্ধ হয়ে গত জানুয়ারীর ৫ ও ৬ তারিখ হাজার হাজার ট্রাম্প সমর্থক বিভিন্ন শহর থেকে ক্যাপিটল হিলের সামনে জড়ো হয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে তাণ্ডব চালায়। কংগ্রেসের জয়েন্ট সেশন চলাকালে ক্যাপিটল হিলের চারপাশে একটি বিশৃঙ্খল যুদ্ধাবস্থা তৈরী করে সেখানে পুলিশকে কার্যত নিস্ক্রিয় রাখা এবং ন্যাশনাল গার্ড বাহিনীকে অভিযান পরিচালনা করতে না দিয়ে কংগ্রেস সদস্যদের বড় ধরণের নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেয়া হয়। তবে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীরা জনগণের বিজয় ছিনিয়ে নিতে পারেনি। প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো-বাইডেন শান্তিপূর্ণভাবেই শপথ ও ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন। ক্যাপিটল হিল দখল চেষ্টা ও দাঙ্গার নেপথ্যের নায়কদের এখন বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হচ্ছে।

দেশে দেশে তথাকথিত গণতান্ত্রিক রাজনীতি এখন আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক দখলবাজি ও লুন্ঠনের যোগসাজশে পরিচালিত হচ্ছে। পুঁজিবাদি লুন্ঠনের হর্তাকর্তারাই এখন নির্বাচন ব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রক শক্তিতে পরিনত হয়েছে। ঊনবিংশ শতকে মার্ক্সবাদের প্রবক্তারা বিশ্বের উপর পুঁজিবাদের ভয়াবহ পরিনতির কথা বলেছিলেন। তারো শত বছর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফাউন্ডিং ফাদাররাও পুঁজির বেসরকারি নিয়ন্ত্রণ, কর্পোরেট ব্যাংকিং সিস্টেম ও কারেন্সি নিয়ন্ত্রণের পরিনতি সম্পর্কে যেসব ভবিস্যদ্বানী করেছিলেন তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে এখন। এর হাজার বছর আগে মহাগ্রন্থ আল কোরআনে মানুষের সম্পদের মোহ এবং সম্পদের অসম বন্টন ও ভোগবাদিতার কঠোর পরিনতির কথা বলা হয়েছে। পুঁজিবাদের সাথে প্রায়োগিক ইসলামের দ্বন্দ্ব ও বৈরিতার মূল কারণ এখানেই। ভোগ-বিলাসে প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা এবং সুদি ব্যাংকিং ব্যবস্থাই যেখানে বর্তমান বিশ্বের অর্থনীতির বুনিয়াদি শক্তি, সেখানে ইসসলামী জীবন বিধানে সব মানুষের সাম্য এবং মিতব্যয়িতার কথা, জাকাত ও চ্যারিটির কথা বলা হয়েছে, সুদ-ঘুষের চরম শাস্তি ও ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে বার বার সাবধান করা হয়েছে। আব্রাহামিক রিলিজিয়নের তিনটি ধর্ম ইসলাম, খৃষ্টবাদ ও ইহুদি ধর্মেও সুদকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু ইসলামে যেভাবে সুদকে সার্বজনীনভাবে হারাম করার পাশাপাশি জাকাত ফরজ করা ও দান-খয়রাতের তাগিদ দেয়া হয়েছে অন্য ধর্মগুলোতে এতটা তাগিদ উচ্চারিত হয়নি। পবিত্র কোরানের সুরা আলে ইমরানের ১৩০ নম্বর আয়াত, সুরা আন নিসার ১৬১ নম্বর আয়াত এবং সুরা আর রুম’র ৩৯ নম্বর আয়াতে সুদের চরম পরিনতি এবং দান-খয়রাতের পুরষ্কার সম্পর্কে বলা হয়েছে। বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্টের ম্যাথু ও লুক অধ্যায়ের বিভিন্ন স্থানে সুদ নিষিদ্ধের কথা বলা হলেও ইহুদিদের ওল্ড টেস্টামেন্টের এক্সোডাস ও ল্যাভিটিকাস অধ্যায়ে ইহুদিদের স্বজাতির মধ্যে সুদি ব্যবসা না করার কথা বলা হয়েছে। তবে বিশ্বের অর্থব্যবস্থার উপর নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং সুদভিত্তিক ব্যাংকিং ব্যবস্থাকেই মূল হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেছে ইহুদি ব্যাংকাররা। নিজেদের মধ্যে নয়, তারা মূলত নন-জুইশ কমিউনিটিকেই তাদের সুদি ব্যাংকিং ব্যবস্থার টার্গেট হিসেবে গ্রহণ করেছে। বিশ্ববাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)’র মত প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ধনী দেশগুলো এখন সুদভিত্তিক ঋণ-সহায়তার সাথে সাথে নানাবিধ শর্ত জুড়ে দিয়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্রগুলোকে অর্থনৈতিক শোষণের হাতিয়ারে পরিনত করেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে গণতন্ত্রের নিশানবরদার, সোল-এজেন্ট দাবি করলেও মার্কিন জনমত, গণতন্ত্র এবং নির্বাচন ব্যবস্থার উপর সাধারণ জনগণের প্রতিনিধিদের চেয়ে কর্পোরেট অর্থনৈতিক শক্তির প্রতিভুদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পুঁজিবাদের বিশ্বায়ন এবং পশ্চিমাদের প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ সংরক্ষিত হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের প্রভাব অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে সরাসরি ছায়াপাত ঘটায়। দেশে দেশে রাজনৈতিক সংঘাত-সহিংসতার পেছনে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নেপথ্য ভূমিকা নতুন করে বলার কিছু নাই। এখন তারা এসব অপতৎপরতা নিজ দেশেও চর্চা করতে শুরু করেছে। গত বছর মার্কিন নির্বাচনের পর নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে ট্রাম্প সমর্থকরা ক্যাপিটল হিলে যে তাণ্ডব চালিয়েছিল তার প্রভাব সিআইএ প্রভাবিত অন্যান্য দেশেও জোরালো হয়েছে। গতমাসে অনুষ্ঠিত ইরাকের পার্লামেন্ট নির্বাচনের পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে সব ভোট পুনরায় গণনার দাবিতে বাগদাদের রাজপথে তাণ্ডব চালিয়েছে। সেসব দেশে তো জনগণ রাজপথে নেমে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ করতে পারছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কমিটমেন্টকে সামনে রেখে লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ এখন নিজের ভোটের অধিকারটিও হারিয়ে বসেছে। জাতীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে স্থানীয় নির্বাচন পর্যন্ত কোথাও গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থার চর্চা নেই। বিনাভোটে ও একতরফা নির্বাচনে নির্বাচিত মন্ত্রী-এমপিরা এখন প্রতিটি স্থানীয় নির্বাচনে নিজের পসন্দের ব্যক্তিদেরকে পৌরসভা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পাস করিয়ে নেয়ার অশুভ মেকানিজম করছে। এক্ষেত্রে তারা অনেকটাই সফল। বিরোধীদল বিএনপি দলীয় প্রতীক নিয়ে এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলেও স্থানীয় নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে পারেনি সরকার। অপকৌশলে শত শত ইউনিয়ন পরিষদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অথবা পাতানো দুর্বল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের বিজয়ী ঘোষণা করা হচ্ছে। দলীয়ভাবে বিএনপি এই নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত না থাকায় ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার পদপ্রার্থী হিসেবে যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে তাদের প্রায় সবাই স্থানীয় আওয়ামীলীগের নেতা-কর্মী। এরপরও আছে ভিন্ন হিসাব নিকাশ, স্থানীয় এমপি ও বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত চেয়ারম্যান সাহেবের পছন্দের প্রার্থীর বাইরে ভোট দিয়ে কোন লাভ হবে কিনা সে হিসাব করছে ভোটাররা। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত মন্ত্রী, এমপি ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা আগামীতে একটি স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ জাতীয় নির্বাচনের লক্ষ্য অর্জনে কতটুকু আন্তরিক ভূমিকা রাখতে পারবে সে বিষয়ে জনগণের সংশয় থাকা স্বাভাবিক। যদিও শুধু স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের গ্যারান্টিই গণতন্ত্র নয়। তবে স্থানীয় থেকে জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত সব রাজনৈতিক মতপথ ও দলের প্রার্থীদের অংশগ্রহণ এবং ভোটারদের ভোটের মধ্য দিয়ে জনমতের প্রতিফলন নিশ্চিত করা গণতন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি নিশ্চিত করা সম্ভব না হলে বৈষম্যহীন ও অংশগ্রহণমূলক অর্থনীতি নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।

[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন