পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আবহমানকাল থেকে আমাদের দেশের মানুষের জীবন-জীবিকা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও অর্থনীতিতে প্রভাব বিস্তার করছে নদী। দেশের নদ-নদী আমাদের পানির প্রধান উৎস। এর সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের জীবন ও প্রকৃতি। অথচ প্রকৃতি ও পরিবেশের কথা চিন্তা না করে আমরা তা ধ্বংস করছি, জলাশয় ভরাট করে অট্টালিকা নির্মাণ, অপরিকল্পিত রাস্তা-ঘাট, স্থাপনা, কলকারখানা ইত্যাদি তৈরি করছি। ভবিষ্যতে এর জন্য আমাদের চরম মূল্য দিতে হবে। এডমন্ড হিলারি বলেছিলেন, পরিবেশজনিত সমস্যা আসলে একটি সামাজিক সমস্যা, এ সমস্যা সৃষ্টির কারণ ও শিকার দুই-ই মানুষ। আমাদের দেশে জমির কীটনাশক পদার্থ, রাসায়নিক সার, নদী, খাল, বিল, পুকুরসহ জলাশয় দূষিত করছে। ফলে মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, দূষিত পানি পান করার ফলে প্রতিবছর বিশ্বে কয়েক লাখ শিশু মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে আর মায়েরা দূষিত পানি পান করার ফলে বিভিন্ন রোগ, এমনকি বিকলাঙ্গ শিশু পর্যন্ত জন্ম দিচ্ছে। বিশুদ্ধ পানি বা নিরাপদ পানি বলতে, যে পানিতে ময়লা আবর্জনা, জীবাণু থাকে না তাকে বোঝায়। পৃথিবীর সবকটি সাগর, মহাসাগর, উপসাগর, নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুর-ডোবা, হ্রদ-হিমবাহ, মেরুতুষার এবং ভূগর্ভস্থ পানি নিয়ে বারিমন্ডল গঠিত। পৃথিবীর মোট পানির ৯৭ ভাগ পানি থাকে সমুদ্রে, ২ ভাগ আসে হিমবাহ ও মেরু তুষারপাত থেকে। মাত্র এক ভাগ পানির উৎস নদ-নদী, হ্রদ, পুকুর, ডোবা, কুয়ো, নলকূপ, ঝরণা ও ভূ-গর্ভ।
পানির পরিমাণ ও মান প্রতিনিয়ত হ্রাস পাচ্ছে। পানিদূষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। পানি বিশ্লেষকদের মতে, আগামী চার দশকের মধ্যে আমাদের দেশে ভূগর্ভস্থ পানির পরিমাণ হ্রাস পাবে আশংকাজনক হারে। ফলে পানি সংকটের সৃষ্টি হবে। দেশে পানির অভাবে সেচের জমি কমে যাচ্ছে। খাদ্যশস্যের উপর এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে, ফলে খাদ্যশস্য উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। দেশে পানির বিরাট অংশ অপচয়ের মাধ্যমে নষ্ট হচ্ছে। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মানুষ দিনে গড়ে প্রায় ১৯০ লিটার পানি খরচ করে। কল খুলে রেখে দাঁত মাজতে খরচ হয় সাড়ে সাত লিটার পানি। প্রতিবার ‘ফ্লাশ’ মানেই প্রায় সাড়ে সাত লিটার পানির অপচয়। বাড়িতে মোট পানির দুই-তৃতীয়াংশ যায় বাথরুমে, কল বা ফুটো পাইপ বা যেকোনো ধরনের ওয়াটার লিকেজ থেকে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পানির ব্যবহার অপরিহার্য, অথচ এই পানির অধিকাংশই অপচয় হয়ে যাচ্ছে। একটু সচেতন হলেই পানির এই অপচয় রোধ করা সম্ভব।
পানি যখন দুষ্প্রাপ্য হয়, তখন পানি ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব অনুধাবন করা যায় এবং তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধিও পায়। পানি ব্যবস্থাপনার বিষয়টি খুব প্রয়োজন। পরিবেশে পানিসম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনার মতো প্রয়োজনীয় ধাপের মধ্যে ভারসাম্য খুঁজে বের করা দরকার। পৃথিবীর পানি সম্পদের মধ্যে মাত্র ২.৫ শতাংশ বিশুদ্ধ। সময়ের অগ্রগতির সাথে সাথে নিরাপদ, সুপেয় পানি সীমিত হয়ে পড়ছে। ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৮টি দেশে ২.৮ বিলিয়নেরও বেশি মানুষ সুপেয় পানির দখলের সম্মুখীন হবে। এসব দেশের মধ্যে ৪০ টি পশ্চিম এশিয়ার। ২০৫০ সালের মধ্যে পানির দখল বা সংকটের সম্মুখীন দেশের সংখ্যা ৫৪ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে, যা চার বিলিয়ন মানুষের সমন্বিত জনসংখ্যার সমান। পানির সঠিক ব্যবহার ও প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর পানির পরিবেশগত প্রভাব কমাতে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় অনেক প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে বিশ্বব্যাপী । ভারতের অনেক এলাকার মানুষ নিজেদের উদ্যোগে পানি সংরক্ষণ করছে। কোনো কোনো শহরে পানি ধরে রাখার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। ২০০৪ সালের জুন মাসে বেঙ্গালুরু মহানগরে পালিকা আইন করে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক করেছে। নতুন যে বহুতল ভবন তৈরি হচ্ছে, তার প্রতিটিতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে পাইপের ব্যবস্থা রাখতে হচ্ছে, যাতে সহজেই বৃষ্টির পানি ধরে রাখা যায়।
আমাদের দেশের পরিবেশ বাঁচাতে পারে আমাদের সচেতনতা। এ সচেতনতা বাস্তবায়িত করতে পারে ছোট ছোট কিছু বলিষ্ঠ কার্যক্রম, যাকে বলা যেতে পারে ‘অ্যাকশন অরিয়েন্টেড প্ল্যানস।’ কিন্তু সবার আগে নিজেদের দিয়ে শুরু করতে হবে। নিজে পানি অপচয় না করে পরিবারের অন্যান্য সদস্যর মাধ্যমে প্রাথমিক কাজ শুরু করতে হবে। পানি সম্পদের সমন্বিত উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনা, আহরণ, বিতরণ, সুরক্ষা ও সংরক্ষণের বিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে প্রণীত আইন বাংলাদেশ পানি আইন ২০১৩ অনুসরণ করতে হবে যথাযথভাবে। বাংলাদেশ পরিবেশ আইন ১৯৯৫ এবং ২০১০ সালে সংশোধন অনুযায়ী, ১৭ নম্বর ধারাকে প্রতিস্থাপন করে বলা হয়েছে, ‘কোনো বিধি লঙ্ঘনের ফলে ব্যক্তি গোষ্ঠী জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হলে উক্ত ক্ষতিগ্রস্ত জনগণ অথবা তাহাদের পক্ষে পরিবেশ আদালতের মহাপরিচালক পরিবেশ আদালতে মামলা দায়ের করিতে পারিবেন।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল, যা দেশের মোট এলাকার ৩৭ শতাংশ, গঙ্গা নদীর পানির উপর তা নির্ভরশীল। দেশে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ এ অঞ্চলে বাস করে। এ অঞ্চলের জনগণের জীবনমান উন্নয়ন, নোনাপানির অনুপ্রবেশ রোধ, নদীভাঙ্গন নিরসন ও সুন্দরবনের জীববৈচিত্র রক্ষা করতে প্রস্তাবিত গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। সার্বিকভাবে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার লক্ষ্যে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক অনুপ্রেরণা ও নির্দেশনার আলোকে নদীভাঙ্গন, নদীভরা, লবণাক্ততা এবং জলাবদ্ধতার সমস্যা সমাধানে বৃহৎনদী সম্পদের নাব্য ও ধারণক্ষমতা পুনরুদ্ধারে ক্যাপিটাল (পাইলট) ড্রেজিং অফ রিভার সিস্টেম ইন বাংলাদেশ শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
পানির অপচয় রোধে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। পরিবার থেকে এ সচেতনতা শুরু করতে হবে। পানি অপচয় রোধে মা সন্তানকে শিক্ষা দিবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা শুরু করতে হবে এবং পাঠ্যপুস্তকে এ বিষয়ে অধ্যায় রাখলে শিশুরা ছোট থেকে অবগত হবে এবং পানির গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা পাবে। ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় পানি অপচয় রোধের বিষয়টি প্রচার হওয়া জরুরি। পানি প্রতিটি মানুষের বেঁচে থাকার প্রধান উৎস। পরিবেশ এবং প্রাণীর জীবন মরণের সাথে পানি জড়িয়ে আছে। অথচ বিশুদ্ধ পানি আমাদের মাঝে থেকে ক্রমশ: হারিয়ে যাচ্ছে, যা আমাদের সকলের জীবনের জন্য হুমকি। এই হুমকি মোকাবেলায় আমাদের প্রত্যেককে সচেতন হতে হবে।
লেখকঃ তথ্য অফিসার, পিআইডি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।