পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
কোনো প্রকার পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই ৪ নভেম্বর আকস্মিকভাবে দেশে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বৃদ্ধি করায় ভোগ্যপণ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও জনদুর্ভোগ বহুগুণে বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। আমরা সবাই জানি যে, দেশের অধিকাংশ গণপরিবহন বিশেষ করে বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও নৌযান ডিজেলচালিত। ডিজেলের দাম বৃদ্ধির ফলে সঙ্গতকারণে যানবাহনের ভাড়া বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের পরিবহন খরচ বেড়ে যাবে ও জনগণের যাতায়াত খরচ বৃদ্ধি পাবে। আমাদের দেশের কৃষিখাত অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। মহামারি করোনাকালে দেশের কৃষিখাত ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল বলেই হয়তো আমাদের অর্থনীতির গতি এখনও সচল। কৃষিজ পণ্য উৎপাদনে ডিজেলের ব্যবহার অপরিহার্য। ফলে ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধিতে কৃষিজ পণ্যের উৎপাদন ব্যয় অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে। সামনে বোরো মৌসুম। বোরো চাষে সেচের জন্য ব্যবহৃত সেচযন্ত্রের অধিকাংশ ডিজেল চালিত। এতে বোরো ধান চাষের উৎপাদন ব্যয়ও বেড়ে যাবে। ফলে চালের দাম বেড়ে যাবার একটা আশঙ্কা তৈরি হবে। এমনিতেই বর্তমানে চাল-ডালসহ নিত্যব্যবহৃত দ্রব্যের দাম নিম্ম-মধ্যবিত্ত মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। মানুষের আয় না বাড়লেও ব্যয় বেড়েছে বহুগুণ। দেশের প্রান্তিক জনপদের গরিব মানুষ ও চরাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষেরাই বলতে গেলে কেরোসিন তেল ব্যবহার করে থাকে। কেরোসিনের অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধি খেটে খাওয়া গবির মানুষের ব্যয় বৃদ্ধি করবে। তাদের চলমান অভাব ও দুঃখ-কষ্টকে অনেকাংশে বাড়িয়ে দেবে। কেরোসিন ধনিক শ্রেণীর মানুষেরা মোটেই ব্যবহার করে না বা তাদের ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়ে না। তাই কেরোসিনের মূল্যবৃদ্ধি মোটেই বোধগম্য নয়। এটা কাম্যও নয়। কেরোসিনের দাম বৃদ্ধি গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবন যাপনকে দুর্বিসহ করে তুলতে পারে। তাছাড়া কেরোসিনের এই মূল্যবৃদ্ধি দিন আনা দিন খাওয়া গরিব শ্রেণির মানুষদের জীবনমান আরো নিম্নমুখী করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
দেশের পাওয়ার প্লান্টের অনেকগুলোতেই জ্বালানি হিসেবে ডিজেল ব্যবহৃত হবার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয়ও বেড়ে যাবে, যার প্রভাব সরাসরি ভোক্তা পর্যায়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। প্রান্তিক জনপদে যেখানে বিদ্যুতের অপ্রতুলতা রয়েছে সে সব জায়গায় কৃষিজ পণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত সেচযন্ত্রে ব্যাপক পরিমাণে ডিজেল ব্যবহার হয়ে থাকে। ফলে কৃষিজ পণ্যের উৎপাদন খরচ যে এক্ষেত্রে বৃদ্ধি পাবে তা বলাই যায়। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য এই মুহূর্তে বেশ চড়া। ভোজ্যতেলের দামও লিটারে ৮/৯ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। মৌসুমি শাক-শ্ববজির দামও অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি এই পরিস্থিতিকে আরো উসকে দিতে পারে।
আমরা জানি করোনা কালে বহু মানুষ চাকরি হারিয়ে কর্মহীন হয়ে পড়েছে। অনেকেই পেশা বদল করতে বাধ্য হয়েছে। কেউ কেউ আবার চাকরি হারিয়ে পেশা বদলিয়ে কৃষিকে তাদের পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। করোনাকালে কৃষি আমাদের দেশের অর্থনীতিকে সচল রেখেছে। এখন ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি দেশের বিকাশমান কৃষিখাতকে বড় ধরনের একটি সংকটের মধ্যে ফেলে দিতে পারে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ বৃদ্ধি পাওয়া আমাদের উৎপাদনমুখী শিল্প-কারখানার উৎপাদনকে আরো ব্যয়বহুল করবে। শিল্পজ পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাবে। এই মূল্যবৃদ্ধি বিদ্যমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সময়ে জনগণের উপর মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেখা দেবে এবং তাদের ভোগান্তিকে আরো বাড়িয়ে দেবে। করোনার প্রাদুর্ভাব দেশে এখনও বিদ্যমান। কর্মহারা মানুষগুলো বিকল্প কর্মের সন্ধানে দিশেহারা। করোনার ফলে দেশে উল্লেখ করার মতো কোনো বিনিয়োগ হয়নি। বহু প্রবাসী দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে। রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গেছে। দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এমন সঙ্কটের সময় জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি সাধারণ মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। গত দু’বছরে মানুষের আয় কমে গেলেও ব্যয় কিন্তু বেড়ে গেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি দ্রব্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। মানুষের আয় কিন্তু বিগত কয়েক বছরে বাড়েনি। দ্রব্যমূল্য বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। কর্মহীন সকল মানুষের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি তো দূরঅস্ত। এমন একটি জটিল পরিস্থিতিতে জনজীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
আমাদের দেশের অর্থনীতি এখনো অনেকটা কৃষিনির্ভর। কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি কোনো সুখকর বিষয় হতে পারে না। একসাথে এত বেশি দাম বৃদ্ধি নিকট অতীতে বাংলাদেশের মানুষ দেখেনি। তাছাড়া জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা নিয়ম থাকা সত্ত্বেও গণশুনানি না করে গভীর রাতে প্রজ্ঞাপন জারি করে লিটারে ১৫ টাকা দাম বৃদ্ধি করাকে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের অগণতান্ত্রিক আচরণ হিসেবে অভিহিত করছে।
এদিকে তেলের দাম বৃদ্ধির সাথে সাথেই দেশে ভোক্তা পর্যায়ে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দামও বাড়িয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। বেসরকারি খাতে ১২ কেজি সিলিন্ডারের এলপিজি’র দাম মূসকসহ পূর্বের এক হাজার ২৫৮ টাকার স্থলে একহাজার ৩১৩ টাকা পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছে। এই এলপিজি গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে গৃহস্থালি কাজে রান্নার ব্যয় ভোক্তা পর্যায়ে বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া এলপিজি’র এই মূল্যবৃদ্ধি হোটেল-রেস্টুরেন্টের খাবার দামের উপরে সরাসরি প্রভাব ফেলবে। অর্থাৎ এখন থেকে ভোক্তাকে অতিরিক্ত মূল্যে হোটেল-রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার কিনে খেতে হবে। এদিকে গাড়িতে ব্যবহৃত এলপিজি’র দামও বৃদ্ধি করে তা পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছে, যা ইতিমধ্যেই কার্যকর করা হয়েছে। আগে ১ লিটার এলপিজি গ্যাসের দাম ৫৮ টাকা ৬৮ পয়সা ছিল, এখন তা বাড়িয়ে ৬১ টাকা ১৮ পয়সা পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত যানবাহনের ব্যয়ও বৃদ্ধি পাবে। মোটা দাগে বলতে গেলে জ্বালানি তেলের এই মূল্যবৃদ্ধি জনদুর্ভোগকে বহুলাংশে বৃদ্ধি করবে। মানুষের জীবন যাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পাবে, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পাবে, পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাবে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয় বৃদ্ধি পাবে, যাতাযাতের জন্য মানুষকে অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে হবে। সার্বিক বিচারে জনগণের জীবনমানের ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ফলে মানুষের জীবন যাপন কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। সরকার নিশ্চয় বিষয়টি ভেবে দেখবে। জনদুর্ভোগ লাঘবে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি পুনঃবিবেচনা করবে।
লেখক: প্রফেসর, আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।