Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ০২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৭ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

অস্তিত্বের স্বার্থেই কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে

আর কে চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ৭ নভেম্বর, ২০২১, ১২:০৪ এএম

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জোট সিভিএফের চেয়ারপারসন শেখ হাসিনা বিশ্বনেতৃবৃন্দকে প্যারিস সম্মেলনের প্রতিশ্রুতি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। কার্বন নির্গমন কমিয়ে আনার যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল ওই সম্মেলনে, তা বাস্তবায়নে উন্নত দেশগুলোর প্রতি আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি। এজন্য যেসব দেশে বেশি কার্বন নির্গমন ঘটছে তাদের উচ্চাভিলাষী এনডিসি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের তাগিদও দিয়েছেন।

স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোয় জলবায়ুসংক্রান্ত ২৬তম জাতিসংঘ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী চারটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। জলবায়ু ক্ষতি কাটাতে উন্নত দেশগুলোর প্রতিশ্রুত বার্ষিক ১০০ কোটি ডলার তহবিল গঠন এবং অভিযোজন ও প্রশমনে আধাআধি বরাদ্দের প্রস্তাব রেখেছেন। সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোকে সাশ্রয়ী মূল্যে পরিচ্ছন্ন ও সবুজ প্রযুক্তি দেওয়া এবং সিভিএফ দেশগুলোর উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করতে উন্নত দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। প্রস্তাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, নদী ভাঙন, বন্যা এবং খরার কারণে বাস্তুচ্যুত জলবায়ু অভিবাসীদের জন্য বিশ্বব্যাপী দায়বদ্ধতা ভাগ করে নেওয়াসহ লোকসান ও ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টির সুনিশ্চিত সমাধান দাবি করেছেন। বলেছেন, বিশ্বব্যাপী নির্গমনের মাত্র ০.৪৭ শতাংশের কম অবদান রাখা সত্ত্বেও বাংলাদেশ জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। প্রধানমন্ত্রী কার্বন নির্গমন কমাতে বাংলাদেশের নানা পরিকল্পনা জলবায়ু সম্মেলনে উপস্থাপন করেন। সম্মেলনের মূল অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য বিশেষ তাৎপর্যের দাবিদার। উন্নত দেশগুলোর কারণেই জলবায়ুতে অনভিপ্রেত পরিবর্তন ঘটছে। কার্বন নির্গমনের মাত্রা স্বল্প হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে আরও অগ্রগতি নিশ্চিত করতে ১২ বিলিয়ন বিদেশি বিনিয়োগসংবলিত ১০টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাতিল করেছে। ২০৪১ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে জ্বালানি শক্তির ৫০ শতাংশ জোগানোর উদ্যোগ নিয়েছে। উন্নত দেশগুলোকেও সাময়িক লাভের দিকে না চেয়ে মানব জাতির অস্তিত্বের স্বার্থেই এ বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ভূমিকা রাখতে হবে।

পৃথিবীর জলবায়ু ক্রমেই মানবজাতির বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। দুই দশক আগেও বিজ্ঞানীরা যেমন ধারণা করেছিলেন, দেখা গেছে, জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে তার চেয়েও দ্রুতগতিতে। ফলে বিজ্ঞানীসমাজের পাশাপাশি বিশ্বের পরিবেশ সচেতন প্রতিটি মানুষ আজ উদ্বিগ্ন। শিল্প বিপ্লবের পর থেকেই পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমেই বাড়ছে। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে এই বৃদ্ধি অনেক দ্রুততর হয়েছে। বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন, এরই মধ্যে তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো বেড়ে গেছে। প্রতিনিয়ত যে হারে কার্বন ডাই-অক্সাইডসহ গ্রিনহাউস গ্যাসগুলোর নির্গমন বাড়ছে, তাতে কয়েক দশকের মধ্যে তা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যেতে পারে। জাতিসংঘও বলছে, বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে শতাব্দীর শেষ নাগাদ তা ২.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে গিয়ে দাঁড়াতে পারে। বিজ্ঞানীদের মতে, তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তারও বেশি বৃদ্ধি পেলে নিম্নাঞ্চলীয় অনেক দেশ বা দেশের ভূখণ্ড তলিয়ে যাবে।

অন্যদিকে খরায় বহু এলাকায় নতুন করে মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হবে। বহু মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে যাবে। খাদ্যোৎপাদন কমে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে। স্বাস্থ্য সমস্যা ক্রমেই প্রকট হবে। অর্থাৎ পৃথিবীতে মানুষের বসবাসযোগ্যতা ক্রমেই বিনষ্ট হবে। এ অবস্থায় ২০১৫ সালে কপ-২১ নামে পরিচিত প্যারিস সম্মেলনে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো পৃথিবীর তাপমাত্রার বৃদ্ধি ১.৫ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখার ব্যাপারে একমত হয়েছিল। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার সহযোগিতা করাসহ আরো কিছু উদ্যোগ নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। কিন্তু সেসব লক্ষ্য অর্জনে অগ্রগতি হয়েছে খুব সামান্যই। এর প্রধান কারণ শিল্পোন্নত দেশগুলোর অনীহা। পরিবেশে প্রতিনিয়ত যে পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস যুক্ত হচ্ছে, তার ৮৮ শতাংশেরও বেশি আসছে শিল্পোন্নত ২০টি দেশে ব্যবহৃত কয়লা ও জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে। অর্থনৈতিক কারণে তারা সেই পরিমাণ দ্রুত হ্রাস করতে চায় না। এরই মধ্যে অনেক দেশ কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনার ব্যাপারে জাতিসংঘে তাদের পরিকল্পনা জমা দিয়েছে। তাতে দেখা যায়, ২০৩০ সাল নাগাদ কার্বন নিঃসরণ কমানোর প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে মাত্র ৭.৫ শতাংশ, অথচ তাপমাত্রার বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত রাখার জন্য কার্বন নিঃসরণ কমানো প্রয়োজন ৫৫ শতাংশ।

অর্থনৈতিক স্বার্থের চেয়েও বেশি জরুরি হচ্ছে পৃথিবীকে বসবাসযোগ্য রাখা। এ লক্ষ্যে বিশ্বনেতাদের সম্মিলিত প্রয়াস চালাতে হবে। প্রতিশ্রুত সহায়তা নিয়ে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর পাশে দাঁড়াতে হবে। পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি হস্তান্তরে উন্নত দেশগুলোকে আরো উদার হতে হবে। আমরা আশা করি, কপ-২৬ সম্মেলন বৈশ্বিক বিপর্যয় রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, সদস্য এফবিসিসিআই, মহান মুক্তিযুদ্ধে ২ ও ৩ নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন