Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

তালেবান শাসন : গণতন্ত্রী ও মডারেটদের ভবিষ্যৎ

মুনীরা রাহমান তাশফী | প্রকাশের সময় : ৬ নভেম্বর, ২০২১, ১২:০২ এএম

রাষ্ট্র প্রশ্নে ইউরোপ নিজেদের মধ্যে থিওক্রেটিক ফ্যাসাদের মীমাংসা খুঁজে নেয় সেকুলারিজমে। তা সত্ত্বেও ইউরোপের বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র এখনো সাংবিধানিকভাবে থিওক্রেটিক স্টেট বা ধর্মতাত্ত্বিক রাষ্ট্র: যেমন, যুক্তরাজ্যের ইংল্যান্ড, তারপর নরওয়ে, গ্রিস, ডেনমার্ক, হাঙ্গেরি এবং লাতিন আমেরিকার আর্জেন্টিনাও। এ দেশগুলো সাংবিধানিকভাবে থিওক্রেটিক স্টেট; যদিও রাজনৈতিক ও নাগরিক জীবনে তারা সেকুলার। অন্যদিকে, ইউকে, কানাডা, সুইডেন, জাপান হলো সাংবিধানিক রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র- যদিও এগুলো পূর্ণ রাজতান্ত্রিক নয়। পূর্ণ রাজতান্ত্রিক তথা এবসোলিউট মনার্কি হলো মধ্যপ্রাচ্যের উপসাগরীয় দেশগুলো, যেগুলো কিনা আবার প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদেরই নকশাকৃত।

ইউরোপের আধুনিক সাংবিধানিক রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো তাদের রাজতন্ত্র ও সরকারব্যবস্থার মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগির মাধ্যমে ভারসাম্য এনেছে। এরমধ্যেই তাদের গণতন্ত্র চর্চা। আবার ইউরোপের সাংবিধানিকভাবে ধর্মতাত্ত্বিক রাষ্ট্রগুলোও নির্বাচন ও সরকারব্যবস্থায় গণতন্ত্র চর্চা করে থাকে। কিন্তু পাশ্চাত্য শক্তি অন্যান্য দেশে তাদের গণতন্ত্র রফতানি করতে চায়, আরো সরাসরি বলতে গেলে, চাপিয়ে দিতে চায় পাশ্চাত্যের মূল্যবোধগুলো গ্রহণের শর্তেই। পাশ্চাত্যের কাছে তাদের মূল্যবোধসম্পন্ন গণতন্ত্রই হলো বিশ্বজনীন, সর্বজনীন ও একমাত্র গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচ্য। ফলে বিপ্লব-পরবর্তী ধর্মতাত্ত্বিক রিপাবলিক রাষ্ট্র ইরান নির্বাচনী গণতন্ত্র চর্চা করা সত্ত্বেও তার বিরোধ প্রধানত পাশ্চাত্যের সাথেই (আক্বিদাগত আঞ্চলিক বিরোধ একপাশে রাখলাম আপাতত; কারণ সেটাও ব্রিটিশ ডিপ স্টেট কর্তৃক প্রোগ্রামড)। পাশ্চাত্যের সাথে ইরানের বিরোধ কি নিছকই ভূ-রাজনৈতিক বিরোধ? না, এটা প্রধানত সেই চিরন্তন আদর্শিক দ্বৈরথ: পাশ্চাত্য বনাম ইসলাম। কারণ থিওক্রেটিক রিপাবলিক ইরান তো পাশ্চাত্যের মূল্যবোধসম্পন্ন গণতন্ত্র চর্চা করছে না।

সুতরাং, ইসলামী রাষ্ট্র কিংবা ইসলামিক আমিরাত প্রশ্নে গণতন্ত্র শুরুর বিষয় নয় একদমই। আগে তো বিপ্লব। তা ওই বিপ্লব ইরানের মতো গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অর্জিত হোক কিংবা তালেবানের মতো গণমুখী সশস্ত্র বিপ্ল­বের মধ্যদিয়ে অর্জিত হোক, বিপ্লব-পরবর্তী ক্ষমতা হস্তগত করার পর সংবিধান, রাষ্ট্র, সরকার, নির্বাচন, কূটনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি নির্ধারণ খুব একটা কঠিন কাজ নয়। এগুলো খুবই ব্যবহারিক বিষয়। যতক্ষণ প্র্যাকটিকাল সময় না আসছে, ততক্ষণ এগুলোকে বিশাল দুরূহ তাত্ত্বিক ও একাডেমিক বিষয়ই মনে হতে থাকবে। ইরানে বিপ্লব-পরবর্তী এসব বিষয়ে কি মহা সমস্যা দেখা দিয়েছিল? না। তারা নিজেদের মধ্যে বিষয়গুলোর সুরাহা করে নিয়েছিল। এখন সশস্ত্র বিপ্লব-পরবর্তী তালেবানের ক্ষেত্রেও কি এসব বিষয় তেমন মহা সঙ্কটরূপে দেখা দিয়েছে? তাও তো না। পরাজিত শক্তি হওয়ার দরুন পাশ্চাত্যের এখন সুযোগ কম তালেবানের রাষ্ট্র পরিচালনায় আবার হস্তক্ষেপ করার। আর বিগত দুই দশক ধরে আমেরিকার হাতে যেই ক্ষুদ্র শহুরে এলিট আফগান শ্রেণী তৈরি হয়েছে, তারা বাদে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের নিরঙ্কুশ সমর্থন যে তালেবানের প্রতিই, তা ইতোমধ্যে প্রতীয়মান। ফলে তালেবানের তো জনগণের অমতে তাদের ওপর কোনো কিছু চাপিয়ে দেয়ার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু গত বিশ বছর ধরে পাশ্চাত্য মিডিয়ার নেতৃত্বে কথিত ওয়ার অন টেররের এজেন্ডাভিত্তিক বয়ানের মধ্যদিয়ে সন্ত্রাসবাদ ও উগ্রবাদের জুজু দেখিয়ে দুনিয়াবাসীকে ক্রমাগতভাবে ডেমোক্রেসি, সেকুলারিজম ও ফেমিনিজম গেলানো হয়েছে। এমনকি কে মডারেট আর কে এক্সট্রিমিস্ট-এই প্রপঞ্চগুলোও পাশ্চাত্যের বানানো।

আমেরিকান থিংক-ট্যাংক RAND Corporation-এর মাধ্যমে সেই ওয়ার অন টেররের এজেন্ডার ফসল হলো ইসলামপন্থীদের মডারেট ভার্সন। কিন্তু জঅঘউ-এর প্রজেক্ট ‘আরব বসন্তে’র মধ্যদিয়ে মডারেট ইসলামপন্থীরা গণতান্ত্রিকভাবে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় এলে দেখা যায়, তারা পশ্চিমা মূল্যবোধগুলো গ্রহণ করছে না। শরিয়া ও কোরআন-হাদিস ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পুরোপুরি সেকুলারও হচ্ছে না। এককথায়, তারা পাশ্চাত্যের গোলামির নজরানা পেশ করছে না। তখন আবার আরব বসন্তের প্রজেক্ট বাদ দেয়া হলো এবং আবার সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে পাশ্চাত্যের অনুগত স্বৈরাচারী শাসন ফিরিয়ে আনতে শুরু করা হলো (যেমন, মিসরের সিসি)। জঅঘউ-এর ওই প্রজেক্টের পরীক্ষায় পাস করার প্রয়াস হিসেবেই তিউনিসিয়ার আন নাহদাকে সেকুলার হওয়ার প্রয়াসী হতে দেখা গেলো। যাই হোক, RAND-এর আরব বসন্তের প্রজেক্ট ব্যর্থ হওয়ার পর এখন আর মডারেট ইসলামপন্থীদের ওপর ভরসা পাচ্ছে না আমেরিকা, যদিও শুধু কথিত টেরোরিজম বা সশস্ত্র পন্থার বিরোধী এমন ইসলামপন্থীদের মডারেট হিসেবে সাব্যস্ত করে আমেরিকান থিংক-ট্যাংকটি। এমনকি ওয়ার অন টেররের এজেন্ডা সমর্থনকারী মুসলমানদের ‘গুড মুসলিম’ নামও দিয়েছিল।

কিন্তু এখন আর তারা মডারেটদের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। কেন পারছে না সেটা আল্ট্রা-মডারেট কানাডিয়ান শিক্ষাবিদ ইরশাদ মাঞ্জি ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউটে ২০১৫ সালের ১৬ ডিসেম্বরের একটা নিবন্ধে ব্যাখ্যা করেছেন: The difference between “reformist” Muslims and “moderates” is not semantic. The latter term is misleading because many “moderate” Muslims exhibit all the traits of orthodoxy, including dogma and a fear of challenging their communities’ groupthink. The qualities associated with religious moderation are positive and desirable as a goal, but they are inadequate as a means to realize positive change in Islam.

সুতরাং, এটা পরিষ্কার যে, তারা এখন আর মডারেটে সন্তুষ্ট নয়। কারণ মডারেট ইসলামপন্থীরা অন্ততপক্ষে ইসলামের মূলনীতিগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না। তাই তাদের দিয়ে ইসলামের মধ্যে পাশ্চাত্যের প্রকল্পিত ‘পজিটিভ চেঞ্জ’ আনা সম্ভব নয়। কিন্তু সেই কথিত পজিটিভ চেঞ্জ আনার জন্য ইরশাদ মাঞ্জি নতুন প্রজন্মের মুসলমানদের মধ্যে একটি শ্রেণীর কথা বলেছেন, যারা হবে রিফর্মিস্ট বা সংস্কারক। এ বিষয়ে মাঞ্জি একই নিবন্ধে লিখেছেন: The good news is that a new generation of Muslims is increasingly using the word “reformist” to describe their pluralist and humanist aspirations for Islam. Their vision for “reformist Islam” is not one that merely abstains from terrorism. It includes dignity for gays and lesbians, full equality for women, respect for religious minorities, and tolerance for different points of view. In all likelihood, a critical mass of this generation’s Muslims will provide audible calls and visible evidence for each of these principles.

ওই নতুন রিফর্মিস্ট বা সংস্কারক মুসলিম প্রজন্ম শুধু যে ‘উগ্রবাদে’র বিরুদ্ধে থাকবে তা-ই নয়, একইসাথে সমকামীদের অধিকার ও নারী-পুরুষের সমানাধিকারের নীতির পক্ষেও কথা বলবে এবং প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করবে। ফলে পাশ্চাত্যের কাছে আগেকার মডারেটদের গুরুত্ব এখন নেই বললেই চলে। উল্লেখ্য, ইরশাদ মাঞ্জি একজন কানাডিয়ান শিক্ষাবিদ। আল্ট্রা-মডারেট মুসলিম নারী। তিনি এলজিবিটিআই তথা সমকামীদের অধিকারের পক্ষে। সেইসাথে ইরাক ও আফগানিস্তানে আমেরিকার সামরিক আগ্রাসন এবং বুশ-প্রবর্তিত ওয়ার অন টেরর তথা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সমর্থকও। তার বক্তব্য আমেরিকান থিংক-ট্যাংক ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট প্রোমোট করে।

যাই হোক, নাইন ইলেভেনের পর আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালানোর মধ্যদিয়ে আমেরিকার নেতৃত্বে যে ক্রুসেড (বুশের ভাষায়) শুরু হয়েছিল, সেটার ফলে দুনিয়ার কোথাও মডারেট ইসলামপন্থীরা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হওয়া সত্ত্বেও তাদের ক্ষমতায় আসতে না দেয়ার পলিসি দৃঢ়ভাবে বাস্তবায়ন করে এসেছে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন গোটা পাশ্চাত্য শক্তি। তাই মুসলিম হিসেবে আপনি-আমি এসময়ে যতই ‘গণতন্ত্র’ ‘গণতন্ত্র’ করি না কেন, তা আসলে ততক্ষণ পর্যন্ত ‘গণতন্ত্র’ না, যতক্ষণ আপনি-আমি ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউটের এনডোর্সড ইরশাদ মাঞ্জির ভাষায় ‘রিফর্মিস্ট মুসলিম’ না হবো। ফলে গণতন্ত্র আসলেই অনেক পরের ঘটনা। এজন্যই সর্বাগ্রে পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদ ও উপনিবেশজাত বিদ্যমান রাষ্ট্রকাঠামোর বিরুদ্ধে পাল্টা বিপ্লব ঘটানোর বিকল্প নেই। আর ঠিক সেটাই দুই দশকের সুদীর্ঘ সশস্ত্র লড়াইয়ের ধারাবাহিকতায় আফগান তালেবান করতে সক্ষম হয়েছে। তারা গণতন্ত্র নয়, বরং কাবুলে গত দুই দশকের মার্কিনিদের গড়া উপনিবেশিক রাষ্ট্রকাঠামো ও সরকারব্যবস্থার পরিবর্তে শরিয়া-শাসনের ভিত্তিতে একটি স্বকীয় ইসলামিক আমিরাত গঠন করেছে।

দুনিয়াকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পাশ্চাত্যের দুটি প্রধান অস্ত্র: সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব ও গণতন্ত্র। গণতন্ত্রের মাধ্যমে মূলত অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর ওপর পশ্চিমা মূল্যবোধ ও আধিপত্য চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু মুসলিম দেশগুলোতে মডারেট ইসলামপন্থীদের মাধ্যমে যে তা সম্ভব নয়, তা বুঝে গেছে পাশ্চাত্য শক্তি। ফলে আমেরিকান থিংক-ট্যাংক ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউটের নতুন এজেন্ডা: অ্যা নিউ রিফর্মিস্ট জেনারেশন অফ মুসলিমস্, যারা কিনা সমকামীদের অধিকারের মতো পশ্চিমা মূল্যবোধগুলোর পক্ষে খোলাখুলি অবস্থান নেবে এবং গ্রহণ করবে। অন্যদিকে, মডারেট ইসলামপন্থীরা ‘গণতন্ত্র’কে যতই মুখ্যরূপে আঁকড়ে থাকুক, তাদের ওপর আমেরিকার আর ভরসা নেই। ফলে তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যত ও সম্ভাবনা অনিশ্চিত। তারওপর সম্প্রতি আফগানিস্তানে তালেবানের মতো একটি থিওক্রেটিক দল ক্ষমতাসীন হওয়ার কারণে মুসলিম বিশ্বে ব্যাপক সমর্থন ও জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। সে কারণে ওয়ার অন টেররের প্রপাগান্ডায় প্রভাবিত অনেক মডারেট ইসলামপন্থীই এখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় আছে।

যাই হোক, ওয়ার অন টেররের বয়ান ও প্রপাগান্ডা থেকে আমাদের মন, মগজ ও বুদ্ধির সামগ্রিক মুক্তি আবশ্যক। নাহলে নিজেদের সোনালি অতীত ও ইতিহাস ধারণ করে আমরা আবার স্বকীয় জ্ঞান, সভ্যতা ও জাতিসত্তার চেতনা নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারবো না। পাশ্চাত্যের ওয়ার অন টেররের এজেন্ডা আমাদেরকে স্বীয় ইতিহাসের গতিপথ থেকে বিচ্যুত করেছে। এই সত্য উপলব্ধি করা ছাড়া উপায় নেই।

লেখক: মাস্টার্সে অধ্যয়নরত, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন