Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

খান জাহান (রহ.)-এর সমাধি

ড. খোন্দকার আলমগীর | প্রকাশের সময় : ২৮ অক্টোবর, ২০২১, ১২:০৪ এএম

খান জাহানের সমাধির এক শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, তিনি ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। তাঁর এ সমাধি বাগেরহাট শহরের নিকটবর্তী ঠাকুর দিঘির উত্তর পাড়ে একটি প্রাচীরের অভ্যন্তরে অবস্থিত।
চার কোণার বৃত্তাকার বুরুজগুলি বাদে এই ইমারতের বহির্ভাগ ৪২’-১০” বর্গাকার। এটির অভ্যন্তর ভাগ ৩০’-০” বর্গাকার। সমাধির চার কোণার চারটি বুরুজে বৃত্তাকার কয়েকটি বন্ধনী আছে। চার দেওয়ালে চারটি প্রবেশ দ্বার থাকলেও উত্তর দিকের প্রবেশ দ্বারটি বর্তমানে বন্ধ। এই ইমারতের দেওয়াল ৮’-০” পুরু। দেওয়ালের নিচে প্রস্তরের পাঁচটি আনুভূমিক সারি আছে এবং তার উপরের দেওয়াল ইষ্টক নির্মিত। ৩টি তোরণ সংযুক্ত বেষ্টনী প্রাচীরের মধ্যে সমাধি ভবনটি স্থাপিত। উত্তর দিকে কোনো তোরণ ছিল না। পশ্চিম দিকের প্রধান তোরণটি বর্তমানে বন্ধ। এই তোরণ পথে মসজিদ অভিমুখে ৩টি প্রবেশদ্বার আছে। সমাধি ভবনের পশ্চিম দিকে পিরালি মুহম্মদ তাহিরের সমাধি অবস্থিত। তিনি একজন ধর্মান্তরিত মুসলমান ছিলেন।
সমাধির বহির্ভাগ: কোণার বুরুজগুলি বাদে ইমারতের এক দিকের দেওয়াল ৪২’-১০” লম্বা। এই ইমারতের প্রধান প্রবেশদ্বার দক্ষিণ দেওয়ালের একটি কৌণিক খিলানের নিচে স্থাপিত। এই প্রবেশদ্বারটি একটি আয়তাকার রিসেসের মধ্যে আবদ্ধ। দক্ষিণ দিকে তিন সারি ধনুক বক্র ছাদ কিনারা engrailled arch এবং পানি পড়ার জন্য দু’টি পাথরের নালা আছে। উত্তর ও পশ্চিম দিকে ছাদ থেকে পানি পড়ার জন্য দু’টি করে পাথরের নালা আছে। কিন্তু পূর্ব দিকে একটি মাত্র নালা আছে। অন্যটি সম্ভবত পড়ে গেছে। উত্তর দিকের প্রবেশদ্বারটি বন্ধ। কোণার বুরুজগুলিতে কয়েকটি বৃত্তাকার বন্ধনী এবং বুরুজগুলির উপরিভাগে আমলকি ও কলস অলংকরণ আছে। সমাধি ভবনটি একটি বৃহৎ গুম্বজ দ্বারা আচ্ছাদিত এবং এর উপর একটি বৃহৎ কলস মোটিফ বিদ্যমান।
সমাধির অভ্যন্তর ভাগ: এই সমাধিভবনের অভ্যন্তর ভাগ ৩০’ বর্গাকার। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইমারতটির চারটি প্রবেশদ্বার আছে এবং উত্তর দিকের বর্তমানে বন্ধ প্রবেশ দ্বারটি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রাকার। এই ইমারতের অভ্যন্তরে সংযুক্ত স্তম্ভ নাই। চারটি প্রবেশদ্বারের প্রত্যেকটির দু’দিকে দু’টি করে এই সমাধির অভ্যন্তরে প্রাচীরগাত্রে মোট আটটি ক্ষুদ্রাকার কুলুঙ্গি আছে। এইগুলির সম্মুখে বহমৎধরষষবফ ধৎপয রয়েছে। চার কোণায় চারটি কৌণিক খিলান দ্বারা অভ্যন্তরভাগকে অষ্টভূজাকৃতি করা হয়েছে। চারদিকের দেওয়ালগাত্রে সংযুক্ত আরও চারটি কৌণিক খিলান আছে। প্রতি ২ খিলানের মধ্যবর্তী স্থানে ১টি করে ত্রিকোণাকার স্থান রয়েছে। এইভাবে গুম্বজের বৃত্তাকার ভিত্তি প্রস্তুত হয়েছে। এর উপর বৃহৎ গুম্বজটি স্থাপিত।
এই ইমারত সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, বেষ্টনী প্রাকারের প্রবেশতোরণের দ্বিকেন্দ্রিক খিলান পথের সফিটে চৌচালা কুঁড়েঘরের বাঁশের কাঠামোর অনুকৃতি দেখা যায়। এটি এই ইমারতের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এগুলি ষাট গুম্বজ মসজিদের চৌচালা ছাদের অনুরূপ। পটুয়াখালি জেলার মসজিদবাড়িয়া মসজিদে এবং চট্টগ্রামের হাটহাজারি মসজিদে একই ধরনের নকশা দেখা যায়।
মুহম্মদ আব্দুল বারী বলেন, ‘একলাখি সমাধির অভ্যন্তর অষ্টকোণাকার হলেও বাংলায় এই সমাধি (খান জাহানের সমাধি) সর্বপ্রথম ভিতর ও বাহিরের দিকে চতুর্ভূজ আকারের। এখন থেকে বাংলার একগুম্বজ বিশিষ্ট প্রায় সকল ইমারতে এই বৈশিষ্ট্য পুনরাবৃত্তি হতে দেখা যায়।’
মূল কবরটি একটি ভূগর্ভস্থ কক্ষে অবস্থিত। মেঝের উপর পাথরের শিলালিপি সংবলিত তিনটি ধাপের উপর প্রস্তরের শবাধার আছে। কবরের উত্তর পার্শ্বে ভূগর্ভস্থ কক্ষে প্রবেশের জন্য একটি গর্ত ছিল। গর্তটি বর্তমানে বন্ধ। ভূগর্ভস্থ কক্ষের অভ্যন্তরে খান জাহানের মরদেহ মৃত্তিকায় শায়িত। এই গর্তেও শিলালিপি আছে বলে জানা যায়। Johana E. van Lohuizen de Leeuw বলেন যে, ১৮৭০ দশকের প্রথম দিকে এ প্রবেশপথটি খোলা হয়েছিল এবং নিচে নামার সিঁড়ি দেখা গিয়েছিল। দেওয়ালগাত্রে অনেক শিলালিপিও দেখা গিয়েছিল। তবে তখন এগুলির পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়নি। এখানে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক তথ্য থাকতে পারে। হাবিবা খাতুন বলেন, ‘ভূগর্ভস্থ শবাধার কক্ষ সংবলিত সমাধি হিসেবে এটি বাংলার সর্বাপেক্ষা আদি সমাধি। ইসলামের সর্বপ্রথম সমাধি নির্মাণের সঙ্গেই ভূগর্ভস্থ শবাধার কক্ষ সংবলিত সমাধি নির্মাণের রীতি প্রচলিত হয়। ভারতে সুলতান ঘরি ও ইলতুতমিশের সমাধিতে এর পূর্ববর্তী উদাহরণ দেখা যায়।’
শবাধারের সর্বনিম্ন ধাপে বিভিন্ন রঙের ষড়বাহুবিশিষ্ট রঙ্গিন টালি দেখা যায়। এই ইমারতের মেঝে রঙ্গিন টালি দ্বারা আবৃত ছিল। মুহম্মদ আব্দুল বারী আরও বলেন, ‘সাদা পাথরের গুঁড়া দ্বারা (white stoneware) বর্গাকার টালিগুলি প্রস্তুত করা হয়েছে। বর্তমানে বিলুপ্ত এইগুলির উন্নত মানের মিনা করা কারুকাজের ফলে বসাক সিদ্ধান্ত করেন যে, এগুলি সম্ভবত চীন থেকে আমদানি করা হয়েছিল। বসাকের এই ধারণার পিছনে কিছু সত্যতা থাকতে পারে। কেননা, এই সময়ে বাংলা ও চীনের মধ্যে দূত বিনিময় হতো। অন্যদিকে ষড়ভূজাকার টালিগুলি লাল মাটির তৈরি। এইগুলিতে বিভিন্ন প্রকার নকশা দেখা যায়। যেমন, পদ্ম, গোলাপ, বহুখাঁজবিশিষ্ট খিলান প্রভৃতি। এগুলি স্থানীয় মোটিফ। এগুলিতে নিম্নমানের মিনার কারুকাজ থেকে ধারণা করা যায় যে, মাটির তৈরি ষড়ভূজাকার টালিগুলি বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়নি। এইগুলি গৌড়ে প্রস্তুত করে সম্ভবত সেখান থেকে আমদানি করা হয়েছিল।’ অন্য ধাপগুলির উপর এবং শবাধারের উপর আরবি লিপি আছে।
সমাধি ভবনের উত্তরে একই আকৃতির একটি মসজিদ আছে। সমাধি ও মসজিদটি পুনরায় আরেকটি প্রাকার দ্বারা বেষ্টিত। এই প্রাকারের দক্ষিণ দিকে ৩টি অন্য ৩ দিকে একটি করে সর্বমোট ছয়টি তোরণ আছে।
লেখক: প্রত্নত্ত্ববিদ ও গবেষক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন