পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ সোমবার সুবহেসাদিকের সময় মক্কার কোরাইশ বংশের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর সেই আগমনের দিবসই হলো পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)।
প্রাক-ইসলামী যুগে মানুষ চরম উচ্ছৃঙ্খলতা, পাপাচার, দুরাচার, ব্যাভিচার, মিথ্যাচার, হত্যা-লুণ্ঠন, মদ্যপান ও জুয়ায় ভরপুর ছিল। অন্যায়-অপরাধ, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, সন্ত্রাস-নৈরাজ্য, নৈরাশ্য আর হাহাকার তাদের মধ্যে বিরাজমান ছিল। মানুষ ভুলে গিয়েছিল মনুষ্যত্ব। অজ্ঞতা-মূর্খতার চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল। সুশিক্ষার আলো হারিয়ে অন্ধকারের আবর্তে নিমজ্জিত হয়েছিল। যে কারণে সেই যুগকে ‘আইয়ামে জাহিলিয়াত’ বা জাহেলিয়াতের যুগ বলা হয়ে থাকে। বিশৃঙ্খলা, অজ্ঞতা-মূর্খতা, অনাচার-পাপাচার করতে করতে তখনকার মানুষ একেবারে জাহান্নামের কিনারে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাদের না ছিল কোনো সঠিক নেতৃত্ব, না ছিল কোনো আদর্শ। ঠিক এমন সময় মানবতার মুক্তির দিশারী হয়ে নূর নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সারা জাহানের হিদায়েতের জন্য আবির্ভূত হন। বিশ্ব মানবতার জন্য তিনি ছিলেন আল্লাহর এক অনন্য রহমত স্বরূপ। মহান আল্লাহ সুহানুতায়ালার পক্ষ থেকে ঈমানদারের জন্য ছিল সবচেয়ে বড় উপহার বা এহসান বা অনুগ্রহ । পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘হে মুসলমানগণ তোমারা যখন আল্লাহর রহমত পাবে তখন তাঁর শোকর গোজার কর।’ রাহমাতুলল্লিল আলামীনকে দুনিয়ায় পাঠানোর দিনটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ সহজেই অনুমেয়। তাই এদিন আল্লাহপাকের শোকর গোজার করা সমগ্র মানবজাতির একান্ত কর্তব্য।
১২ রবিউল আউয়াল এলে ঈমানদার মুমিন মুসলমানগণ নবীর প্রেমে উজ্জীবিত হয়ে, আনন্দে আত্মহারা হয়ে পবিত্র ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী (সা.) পালন করে। মহান আল্লাহপাক বলেন: ‘ওমা আরছাল নাকা ইল্লা রাহমাতাল্লিল আলামিন।’ অর্থাৎ হে হাবিব! আমি তো আপনাকে বিশ্ব জগতের প্রতি কেবল রহমত রূপেই প্রেরণ করেছি। তাই গত প্রায় ১৪০০ বছর ধরে সারা বিশ্বের মুসলমানগণ ভক্তি ও আনন্দের সাথে রাসূল (সা.) এর জন্মদিবস ১২ রবিউল আউয়াল ঈদে মিল্লাদুন্নবী (সা.) উদযাপন করে আসছে।
প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) হলেন আল্লাহ এবং মানবজাতির মধ্যে যোগসূত্র স্বরূপ। রাসূল (সা.) কে ভালবাসা ঈমানের পূর্ব শর্ত। তাই আল্লাহ পাক কোরআনে রাসূল (সা.) কে অনুসরণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন: ‘বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাসো তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, যাতে আল্লাহ তোমাদিগকে ভালোবাসেন এবং তোমাদিগকে তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেন। আল্লাহ হলেন ক্ষমাকারী দয়ালু।’ এখানে নির্দেশ এসেছে দুই দিক থেকে। একদিকে কেউ যদি সর্বশক্তিমান আল্লাহকে ভালোবাসতে চায় তবে তাকে অবশ্যই মোহাম্মদ (সা.) কে অনুসরণ করতে হবে। অন্যদিকে, আল্লাহর ভালবাসা পেতে হলে রাসূল (সা.) কে অনুসরণ করতে হবে। অর্থাৎ আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়ার পূর্ব শর্ত হচ্ছে রাসূল (সা.) কে অনুসরণ করা।
নবী করিম (সা.) নিজেও বলেছেন: ‘ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ মোমেন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার পিতামাতা, সন্তান ও অন্য সবার থেকে এমন কি তার নিজের যানের চেয়েও প্রিয় হবো।’ (সহীহ আল বুখারী)।
তাহলে কোরআন ও হাদিসের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত মুসলমানের ঈমানের দাবি হলো ইত্তেবায়ে রাসুল আর আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি ভালোবাসা ছাড়া মুমিনও হওয়া যায় না। আমরা যদি লক্ষ করি, দেখবো, এ পৃথিবীতে যারা নিজেদের মুসলিম দাবি করে তাদের সংখ্যাটি বিশাল। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তারা যে রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারের প্রতিষ্ঠা দিয়েছে তার চরিত্র কতটা মুসলিম? সেগুলির মধ্যে কতটা প্রকাশ পায় ঈমানদারী? যদিও কোথাও কোথাও ঈমানদারী যেমন দেখা যায়, তেমনি দেখা যায় বেঈমানীও। যে রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, আইন-আদালত নিয়ে তাদের বসবাস, ঈমানদারীর প্রকাশ তার মধ্যে কতটুকু?
সাধারণত মানুষ তার আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবকে ভালোবাসে। আর ঈমানের দাবি হলো, নবীজিকে ভালবাসা। এটি স্বর্গীয় ভালবাসা যেখানে একজন ঈমাদারের জন্য ফরজ আল্লাহর পরে রাসূল (সা.) সম্পর্কে সর্বোচ্চ ভালোবাসা হৃদয়ে পোষণ করে এবং সর্বোচ্চ সম্মান দেয়া। সেজন্যই ১২ রবিউল আউয়াল হতে হবে আশেকে রাসূলের ঈমানী জজবা ও ভালবাসা বহিঃপ্রকাশের দিন।
পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)’র গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে প্রসিদ্ধ তাবেঈ হযরত হাসান বসরী (রা.) বলেন: যদি আমার উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ থাকত, তাহলে আমি তা রাসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মদিন উপলক্ষে মাহফিলে খরচ করতাম। [সূত্র: আন নেয়মাতুল কুবরা আলাল আলাম, পৃষ্ঠা নং-১১।]
আর তা-ই তো প্রিয় নবী (সা.)’র এই ধরাতে আগমনের মাসে তাঁর প্রেমিকরা খুশি উদযাপন করে থাকে এবং সাফায়েতরারী প্রিয় নবীর আগমনের দিনটির কথা সকলকে স্মরণ করিয়ে দেয়, মহান অনুগ্রহের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় এবং শুকরিয়া আদায়ার্থে বেশি বেশি মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করে থাকে। কুরআন হাদিসের কোথাও ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) সম্পর্কে নিষেধাজ্ঞা নেই, বরং এর স্বপক্ষেই প্রমাণ রয়েছে এবং ভালো নতুন রীতি উদ্ভাবনকারী, কিয়ামত পর্যন্ত এর উপর আমলকারী প্রত্যেকের সাওয়াবের ভাগীদার হওয়ার কথাও এসেছে। সাহাবায়ে কেরাম যেভাবে প্রিয় নবী (সা.)’র প্রতি ভালবাসা-সম্মান প্রকাশের সুযোগ পেয়েছে আপনিও কি সেসব সুযোগ পেয়েছেন! মনে রাখা উচিৎ, নবীপ্রেম ঈমানের মূল।
পরিশেষে মহান রবের পবিত্র কালামের ভাষায় বলতে চাই: ‘সুতরাং আল্লাহর অনুগ্রহগুলোকে স্মরণ করো এবং পৃথিবীতে ফিতনা-ফাসাদকারী হয়ে বিচরণ করো না।’ (সূরা আ‘রাফ, আয়াত ৭৪) ‘ওহে যারা ঈমান এনেছ! ভালো বিষয়গুলো, যা আল্লাহ্ তোমাদের জন্য বৈধ করেছেন সেসব তোমরা নিষিদ্ধ করো না, আবার বাড়াবাড়িও (সীমালঙ্ঘন) করো না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ ভালোবাসেন না সীমালঙ্ঘনকারীদের।’ (সূরা আল মায়িদাহ: ৮৭), ‘আর আল্লাহর নির্দেশকে হাস্যকর বিষয়ে পরিণত করো না। আল্লাহর সে অনুগ্রহের কথা স্মরণ করো, যা তোমাদের উপর রয়েছে এবং তাও স্মরণ করো, যে কিতাব ও জ্ঞানের কথা তোমাদের উপর নাযিল করা হয়েছে, যার দ্বারা তোমাদেরকে উপদেশ দান করা হয়। আল্লাহকে ভয় করো এবং জেনে রাখ যে, আল্লাহ সর্ববিষয়েই জ্ঞানময়।’ (সূরা বাকারাহঃ ২৩১)
লেখক: প্রধান নির্বাহী উপদেষ্টা, বাংলাদেশ রেজভীয়া তালিমুস সূন্না বোর্ড ফাউন্ডেশন
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।