Inqilab Logo

রোববার ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে হবে

মো. বশিরুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ১৬ অক্টোবর, ২০২১, ১২:০২ এএম

নিরাপদ ও অনিরাপদ খাদ্য নিয়ে ভাবনা আজ বিশ্বকে দারুণভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। এ ভাবনা থেকে অর্থাৎ খাদ্য এবং পুষ্টির গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে ১৬ অক্টোবর বিশ্ব খাদ্য দিবস পালিত হয়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত ২০তম সাধারণ সভায় হাঙ্গেরির খাদ্য ও কৃষিমন্ত্রী বিজ্ঞানী ড. পল রোমানি খাদ্য দিবস পালনের প্রস্তাব করেন। তার প্রস্তাবের পর ১৯৮১ সাল থেকে বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রতিষ্ঠার দিনটিতে বিশ্বের ১৫০টিরও বেশি দেশে এ দিবসটি গুরুত্বের সাথে পালিত হয়ে আসছে। সন্দেহ নেই বিশ্বের অনেক দেশেই বিশুদ্ধ এবং পুষ্টিকর খাদ্যের নিশ্চয়তা নিশ্চিতকল্পে এই দিবসটি উদযাপন করবে। আমাদের দেশেও এই দিবসটি উদযাপনের ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকবে না। তবে ওই পর্যন্তই। কারণ বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে বিশুদ্ধ ও পুষ্টিকর খাবার প্রাপ্তি কঠিন হয়ে উঠেছে।

আমাদের দেশে বিশুদ্ধ ও পুষ্টিকর খাবার না পাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে, ফসলে কীটনাশকের ব্যাপক অপপ্রয়োগ এবং মাত্রাতিরিক্ত সার ব্যবহার। একই সঙ্গে মজুদদার, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা খাদ্যে বিভিন্ন রাসায়নিক তথা ফরমালিন, ক্যালসিয়াম, কার্বাইড, ইথোফেন, কীটনাশক, কাপড়ের রঙ, পোড়া তেল ও মবিলমিশ্রিত তেলসহ নানা ক্ষতিকারক রাসায়নিক উপকরণ, হরমোন ও অ্যান্টিবায়োটিক খাদ্যে মেশানো অন্যতম কারণ। এছাড়া প্রক্রিয়াজাত খাদ্যেও নানা ধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক মেশানো হচ্ছে। আসলে, আমাদের দেশে ভেজালমুক্ত খাদ্য আর আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া যেন সমার্থক। এমন কোনো খাদ্যপণ্য নেই যেখানে ভেজাল নেই। খাদ্যপণ্যে ভেজালের কারণেই দেশের মানুষের বিভিন্ন রকমের ক্যান্সার, লিভার সিরোসিস, কিডনি ফেইলিউর, হ্নদযন্ত্রের অসুখ, হাঁপানিসহ আরো জটিল রোগ দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। আর আমরা প্রতিনিয়ত দেখতে পাচ্ছি বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে রোগীদের দীর্ঘ লাইন। একে নিয়ন্ত্রণে আনতে খাদ্যকে নিরাপদ করতে হবে সর্বাগ্রে।

নিরাপদ খাদ্য নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। মাছ-মাংস, মৌসুমি ফলমূল ও শাকসবজি কিনতে আমাদের প্রায়ই চিন্তিত হতে হয়। আসলে, প্রকৃতি যে খাদ্য ও পানীয় দান করেছে তা নিঃসন্দেহে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত। এগুলো অনিরাপদ হয় রূপান্তরিত ও প্রক্রিয়াজাতকরণের মধ্যদিয়ে। এই রূপান্তর ও প্রক্রিয়াজাতকরণে ইচ্ছাকৃত বা অসাবধানতা অথবা অজ্ঞতাকে দায়ী করা যায়। কারণ যাইহোক, এর ফল, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও ঝুঁকি যে জাতিকে কতটা ভয়াবহতায় ফেলতে পারে তা চিন্তাও করা যায় না।

আসলে, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে। খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে সরকার অঢেল অর্থ খরচ করলেও নিরাপদ খাদ্যের বিষয়ে কতটুকু মনোযোগী তা সংশয়ের ঊর্ধ্বে নয়। কৃষি ও খাদ্যবান্ধব বর্তমান সরকার ‘নিরাপদ খাদ্য’কে গুরুত্বসহকারে নিয়েছে, এর ফলে প্রণীত হয়েছে ‘নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩’ এবং তা বাস্তবায়নের জন্য ২০১৫ সালে ২ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু করেছে ‘নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ’। ইতোমধ্যে তারা নিরাপদ খাদ্য কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ৬৪টি জেলায় ও আটটি বিভাগীয় শহরে ৭৪টি নিরাপদ খাদ্য আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভেজালবিরোধী সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি তারা কাজ করছে নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে। আছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভেজালবিরোধী অভিযান। তার পরও কমছে না ভেজালের ব্যাপকতা।

আমার জানি, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য মানুষের মৌলিক চাহিদা। এর মধ্যে খাদ্য প্রধান। জীবন ধারণের জন্য খাদ্যের কোনো বিকল্প নেই। সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রতিটি মানুষের প্রয়োজন বিশুদ্ধ ও পুষ্টিকর খাদ্য। আর এ বিশুদ্ধ খাদ্যই যদি অখাদ্যে রূপান্তরিত হয়, তা গ্রহণের পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ হতে বাধ্য। এ খাদ্য যদি আমাদের জীবন-জীবিকার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় তবে আমরা যে ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির শিকার হবো তা কিন্তু যুদ্ধ ও মহামারীর ভয়াবহতার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। কাজেই কাল বিলম্ব না করে এমন পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজে বের করতে হবে। কারণ খাদ্য নিরাপত্তার উপর জোর তাগিদ দিয়ে দেশ যতই উন্নতি লাভ করুক না কেন তা টেকসই না হয়ে হবে আত্মঘাতী। জীবন ও খাদ্য দুটি একে অপরের পরিপূরক। কথায় আছে, নিরাপদ খাদ্য খেলে ওষুধের প্রয়োজন হয় না। আবার খাদ্যের মান ও খাদ্য অভ্যাস না থাকলে ওষুধ কোনো কাজে আসে না।

বিশ্ব খাদ্য দিবস খাদ্য সার্বভৌমত্ব, খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ে আমাদের অনেকগুলো প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে চাল, মাছ, পেঁয়াজ, সবজিসহ প্রতিটি খাদ্যেরই দাম হু হু করে বাড়া এবং আমদানি নির্ভরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় আমাদের খাদ্য সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সেইসঙ্গে নানা শঙ্কাও তৈরি হয়েছে। তবে বলতে দ্বিধা নেই গত কয়েক দশকে আমাদের খাদ্যশস্য উৎপাদন কয়েকগুণ বেড়েছে। চার দশকে আগের চেয়ে মানুষ প্রায় দ্বিগুণ খাদ্য গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে। দুর্ভিক্ষ, মঙ্গা ছিল যে দেশের নিত্য সহচর, তা ইতিহাসে স্থান পেয়েছে। এ সাফল্য সত্ত্বেও খাদ্যের মান নিয়ে প্রশ্নের শেষ নেই। খাদ্য নিরাপত্তাকে পাশ কাটিয়ে এখন আলোচনার মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে নিরাপদ খাদ্য।

সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি উন্নয়নের কারণে মানুষ এখন আর খাদ্য সংকটে নেই। দেশের প্রায় সব ধরনের খাদ্যই উৎপাদন হচ্ছে। তবে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু উৎপাদন পর্যায়ে উত্তম চর্চার অনুসরণের মাধ্যমে তা সম্ভব নয়। কেননা বাজারজাত প্রক্রিয়া ও বিক্রির সময়ও পণ্য নানাভাবে দূষিত হচ্ছে। এই সমস্যা সমাধানে কৃষির উৎপাদনে সঠিক জ্ঞান, দক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি সঠিক কৃষি উপকরণের যোগান বাড়াতে হবে। কাজ করতে হবে বাজারজতকারণ ও বিপণন ব্যবস্থার উন্নতিতে। কৃষকদের কাছে তথ্য নিয়ে যেতে হবে। সব মিলিয়ে কাজ করতে হবে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, বাজার ব্যবস্থাপনা এবং কৃষিবান্ধব নীতি ও পরিকল্পনা নিয়ে।

এমন পরিস্থিতিতে অনিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও বাজারজাত নিয়ন্ত্রণ করতে সব খাদ্য ও পানীয় নিয়মিত পরীক্ষা ও জনসম্মুখে তার ফল প্রকাশ করা জরুরি। খাদ্যের মানের ব্যাপকভিত্তিক পরীক্ষা না হলে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা দুরূহ। এছাড়াও নিরাপদ খাদ্য কার্যক্রম পরিচালনা ও নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন অধিক দক্ষ লোকবল, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, উন্নতমানের গবেষণাগার এবং অভিজ্ঞ প্রযুক্তিবিদ।

লেখক: উপ-পরিচালক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন