পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
গতকাল বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় পূজামন্ডপে হামলার ঘটনার প্রেক্ষাপটে হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতা ও প্রতিনিধিরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে যান। এ সময় তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাদের উদ্বেগ ব্যক্ত করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে দ্ব্যর্থহীন ও অবিচলভাবে বলেন, ঘটনার সাথে জড়িতদের কঠোর শাস্তি দেয়া হবে। ঘটনার সাথে জড়িত যারা এবং যে ধর্মেরই হোক না কেন, তাদের রেহাই দেয়া হবে না। ঘটনাগুলোর সাথে জড়িতদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি সারাবিশ্বে জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির প্রসঙ্গ টেনে প্রতিবেশি ভারতকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, সেদেশেও যাতে এমন কিছু না করা হয়, যার প্রভাব এখানে পড়ে। তিনি বলেন, বিশ্বজুড়ে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাওয়ায় তারও একটা প্রভাব এসে পড়ছে। সে ব্যাপারে আমাদের নিজেদের দেশ শুধু নয়, আমাদের প্রতিবেশি দেশকেও সজাগ থাকতে হবে। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর এমন বলিষ্ঠ ও সুস্পষ্ট বক্তব্য এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ত্বরিৎ ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি অত্যন্ত প্রশংসনীয় এবং অভিনন্দনযোগ্য।
আমাদের দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিষয়টি প্রশ্নাতীত। হাজার বছর ধরে এ দেশে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী নির্দ্বিধায়, নিশ্চিন্তে একসঙ্গে বসবাস করে আসছে। এদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা বিরল, বলা যায়। কখনো কখনো এর ব্যত্যয় ঘটলে, তার পেছনে কোনো স্বার্থান্বেষী মহল জড়িত ছিল বলে প্রমানিত। বাংলাদেশ বিশ্বে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির রোল মডেল হিসেবে প্রশংসিত। শুধু তাই নয়, হিন্দু সম্প্রদায় সংখ্যালঘু হলেও তাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। আনুপাতিক হারের চেয়েও তারা বেশি সংখ্যায় নিয়োগপ্রাপ্ত এবং নিয়োজিত রয়েছে, যা যেকোনো দেশের জন্য সম্প্রীতির অনন্য উদাহরণ। প্রতিবেশি ভারতে এমন নজির বিরল। আমরা বরাবরই দেখছি, সেখানের দ্বিতীয় বৃহত্তম সম্প্রদায় মুসলমানদের চাকরির সুযোগ-সুবিধা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের অন্যান্য ক্ষেত্রে চরম বৈষম্য বিরাজমান। বৈষম্য তো রয়েছেই, দেশটি থেকে মুসলমানদের উচ্ছেদের মতো নীতি অবলম্বন করা হচ্ছে। প্রায় প্রতিনিয়ত মুসলমানরা সেখানে নিপীড়ন, নির্যাতন ও হত্যার শিকার হচ্ছে। এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। সম্প্রতি আসামে মুসলমানদের উচ্ছেদের ঘটনায় এক মুসলমানকে হত্যা করে তার লাশের উপর পৈশাচিক উল্লাসে এক চিত্রগ্রাহকের নৃত্যের দৃশ্য সারাবিশ্ব দেখেছে। এ নিয়ে ভারতের ক্ষমতাসীন দল কিংবা অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে কোনো ধরনের প্রতিবাদ বা বক্তব্য দিতে দেখা যায়নি। শুধু মুসলমানদের উচ্ছেদ, নিপীড়ন ও হত্যা নয়, দেশটিতে বিভিন্ন মসজিদ ভেঙ্গে মন্দির নির্মাণও করা হচ্ছে। এর বিপরীতচিত্র আমাদের দেশে। গতকালই বেশ কয়েকটি দৈনিক পত্রিকায় লালমনিরহাটে একই আঙ্গিনায় শতবর্ষী মসজিদ ও মন্দির পাশাপাশি থাকার বিরল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য উদাহর হিসেবে সংবাদ পরিবেশন করেছে। শুধু এটিই নয়, যখনই হিন্দুদের ওপর কোনো ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে, তা প্রতিরোধে ও প্রতিবাদে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে আলেম-ওলামারা মাঠে নামেন। হিন্দুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের আহ্বান জানায়। এসব বিষয় প্রতিবেশি দেশের প্রতিক্রিয়াশীলদের নজরে পড়ে না। তারা আমাদের দেশে হিন্দুদের ওপর কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন বিজেপির নেতাসহ হিন্দুত্ববাদী নেতাদের তেলে বেগুনে জ্বলে উঠতে দেখা যায়। এমনকি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবী জানায়। বাংলাদেশে উদ্ভুত ঘটনা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন তৃণমূল দল উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। রাজ্যের বিজেপির নেতা শুভেন্দু অধিকারী ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছেন। চিঠিতে তিনি বাংলাদেশের হিন্দুদের মধ্যে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে প্রধানমন্ত্রীকে পদক্ষেপ নিতে তাকিদ দিয়েছেন। তার এ ধরনের বক্তব্যে প্রচ্ছন্নভাবে হলেও আমাদের দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারত সরকারের হস্তক্ষেপের বিষয়টি অস্পষ্ট থাকেনি। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, এরকম বক্তব্যে ঘটনার পেছনে কারা জড়িত থাকতে পারে তারও কিছুটা আভাস রয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশে যেভাবে জাঁকজমকপূর্ণ ও বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে হাজার হাজার মন্ডপে দুর্গা পূজা উদযাপিত হয়, তা অভূতপূর্ব এবং ভারতের কলকাতাসহ অন্যান্য রাজ্যেও এতটা উৎসবমুখর পরিবেশে উদযাপিত হয় না। এই জাঁকজমকপূর্ণ পূজা উদযাপন করতে পশ্চিমবঙ্গ ও অন্যান্য রাজ্য থেকে থেকে অনেক মানুষ বাংলাদেশে আসে। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, বাংলাদেশ কতটা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যর্থাথই বলেছেন, দেশে বছর বছর পূজামন্ডপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্থায়ী পূজামন্ডপের পাশাপাশি অস্থায়ী পূজামন্ডপেও পূজা উদযাপিত হচ্ছে। ভারতে সরকারের অনুমোদন ছাড়া নতুন করে পূজামন্ডপ করতে দেয়া হয় না। প্রধানমন্ত্রীর এ কথা থেকেই প্রমাণিত হয়, বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায় কতটা স্বাধীনভাবে, নিরাপদে, বাধাহীনভাবে এবং উৎসবমুখর পরিবেশে পূজা উদযাপন করে। অন্যদিকে, ভারতে মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসবে বাধা প্রদান এবং সীমিতকরণের বিষয়টি নিত্যকার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, ভারতে মুসলমানরা প্রতিনিয়ত উচ্ছেদ, নিপীড়ন, নির্যাতন ও হত্যার শিকার হলেও যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো কোনো ধরনের প্রতিবাদ করে না। তারা মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকে। যেন মুসলমান হত্যা ও নির্যাতন মানবাধিকারের মধ্যে পড়ে না। অন্যদিকে, বাংলাদেশে সংখ্যা লঘুদের ক্ষেত্রে পান থেকে চুন খসলেই, তারা মানবাধিকার গেল বলে হইচই করে উঠে। তাদের এই দ্বৈতনীতি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে উদ্ভুত ঘটনা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে মনিটর করে অত্যন্ত দক্ষতা ও বিচক্ষণতার সাথে দ্রুত সামাল দিয়েছেন। পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশের প্রতিও আহ্বান জানিয়েছেন, সেখানে যাতে এমন কোনো ঘটনা না ঘটে যার প্রভাব আমাদের এখানে পড়ে। এটা তাঁর অত্যন্ত দূরদর্শী, বিচক্ষণ, সাহসী এবং রাষ্ট্রনায়কোচিত উচ্চারণ। দেশের সাধারণ মুসলমানও অত্যন্ত ধৈর্য্য এবং সহনশীলতার পরিচয় দিয়ে ঘটনাকে বিস্তৃত হতে দেয়নি। এখানেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী দেশসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে বাংলাদেশের মৌলিক পার্থক্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অতি দ্রুত ও অভূতপূর্ব দক্ষতার সঙ্গে পরিস্থিতি যেভাবে মোকাবেলা করেছেন, তার জন্য আমার তাঁকে অকুণ্ঠ ধন্যবাদ জানাই।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।