Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন প্রয়োজন

মো. আরাফাত রহমান | প্রকাশের সময় : ৩ অক্টোবর, ২০২১, ১২:০২ এএম

মাত্র প্রায় ১,৪৭,৫৭০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে গঠিত বাংলাদেশে আছে ২২ প্রজাতির উভচর, ১০৯ প্রজাতির অভ্যন্তরীণ ও ১৭ প্রজাতির সামুদ্রিক সরীসৃপ, ৩৮৮ প্রজাতির আবাসিক, ২৪০ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি এবং ১১০ প্রজাতির আন্তর্দেশীয় ও ৩ প্রজাতির সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী। এমন ছোট একটি দেশে বন্যপ্রাণীর এরূপ বিপুল সমাবেশ এবং বৈচিত্র্য এক আশ্চর্য ঘটনা, যেখানে জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। এদেশের ভৌগোলিক অবস্থান বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। অসংখ্য নদ-নদী, খাল-বিল, ছোট বড় বিভিন্ন ধরনের বনাঞ্চল এবং মনোরম জলবায়ু বহু যুগ ধরে বাংলাদেশকে বিচিত্র বন্যপ্রাণীর অনবদ্য আবাস হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বর্তমানে দেশের আন্তর্দেশীয় ও আবাসিক ৮৯৫ প্রজাতির (২৬৬টি স্বাদুপানি ও স্বল্পলোনাপানির মাছসহ) মধ্যে ২০১ প্রজাতি বিভিন্ন ধরনের হুমকির সম্মুখীন এবং ২২৩ প্রজাতির অবস্থা অনিশ্চিত ও আশঙ্কাজনক।

বিগত ১০০ বছরে বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে গেছে এক ডজনের বেশি বন্যপ্রাণী। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যÑ এক শিংবিশিষ্ট গন্ডার, জাভান গন্ডার, এশিয়ান দু’শিংবিশিষ্ট গন্ডার, গাউর, বেন্টিং, বুনো মহিষ, হরিণ, নীলগাই, নেকড়ে, নুকতা হাঁস, ময়ূর এবং বাদার কুমির। যেহেতু অধিকাংশ বন্যপ্রাণী প্রধানত বনাঞ্চলের ধরন, অবস্থা এবং বিস্তৃতির উপর নির্ভরশীল, এসব প্রাকৃতিক পরিবেশের অবনতি তাই স্থানীয় ও আবাসিক পশুপাখিকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। বিগত তিন দশকে বাংলাদেশে বনাঞ্চলের অবনতি ঘটেছে প্রচন্ডভাবে। অনুমান করা হয় যে, ১৯৭০ দশক থেকে বনভূমির পরিমাণ শতকরা ৫০ ভাগের বেশি হ্রাস পেয়েছে। ১৯৯০ সালের এক হিসাব থেকে জানা যায় বাংলাদেশে মাথাপিছু বনভূমির পরিমাণ ০.০২ হেক্টরের কম। নিঃসন্দেহে বনভূমি ও মানুষের মধ্যকার এ অনুপাত পৃথিবীর যেকোন দেশের তুলনায় সর্বনিম্ন। বর্তমানে দেশে বন আচ্ছাদনের পরিমাণ ৮% এর কম।

বাংলাদেশের প্রায় ৬২৮ প্রজাতির পাখির মধ্যে ৩৮৮টি আবাসিক এবং ২৪০টি পরিযায়ী। সারস এদেশের সবচেয়ে বড় পাখি, উচ্চতা হয় প্রায় ১.৭ মিটার। তবে এ পাখি এখন বিরল, কদাচিৎ দেখা যায়। কতক মধুপায়ী ও সানবার্ড দৈর্ঘ্যে মাত্র ৭-৮ সেমি; সম্ভবত এদেশে এরাই পাখিদের মধ্যে ক্ষুদ্রতম। বনভূমির অবনতি ও অবক্ষয় এবং সেই সঙ্গে বাস্তুতন্ত্রের পরিবর্তন নিঃসন্দেহে পাখি সম্পদকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে। বনাঞ্চল এবং জলাভূমির সঙ্গে সম্পৃক্ত বহু পাখির সংখ্যা এখন কমে গিয়েছে। অধিকাংশ পরিযায়ী পাখি বাংলাদেশে আসে এ উপমহাদেশের উত্তর অঞ্চলের পার্বত্য এলাকা থেকে। কতক আসে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল ও সাইবেরিয়া থেকে। অনেক প্রজাতি দক্ষিণ বা দক্ষিণ-পূর্ব এলাকার দেশগুলিতে তাদের অভীষ্ট স্থানে পৌঁছবার পূর্বে যাত্রাপথে বাংলাদেশে কিছু সময়ের জন্য বিরতি নেয়। আবার অনেক পরিযায়ী পাখিই শরৎ ও বসন্তকালে বাংলাদেশেই অবস্থান করে, তারপর নিজের দেশে ফিরে যায়।

১৯২৭ সালের ভারতীয় বন-বিধিতে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের কোন ব্যবস্থা ছিল না। এতে অবশ্য বনসম্পদের সংজ্ঞা দিতে সব বন্যপ্রাণী এবং চামড়া, দাঁত, শিং, হাড়, রেশম, গুঁটি, মধু, মোম ইত্যাদির উল্লেখ ছিল। ব্রিটিশ আমলে প্রয়োজনবোধে বন্য পাখি ও অন্যান্য প্রাণী অথবা কোন নির্দিষ্ট প্রজাতি সংরক্ষণের জন্য কয়েকটি বিশেষ আইন/বিধি চালু ছিল। এগুলি হলো: ১. বন্য হাতি সংরক্ষণ আইন, ১৮৭৯; ২. বন্য পাখি ও জন্তু সংরক্ষণ আইন, ১৯১২; এবং ৩. বন্য গন্ডার সংরক্ষণ আইন, ১৯৩২।

এসব আইন ছাড়াও ভারতীয় বন-আইন, ১৯২৭ ও অধ্যাদেশ, ১৯৫৯ সরকারের নিকট বনে শিকার ও মাছ ধরা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ন্যস্ত করেছে, যা প্রয়োজনবোধে প্রযোজ্য। পরবর্তীকালে ১৯৫৯ সালে সরকার ব্যক্তিগত ও সরকারি বনে এসব কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য পৃথক দুই প্রস্থ আইন তৈরি করে। এ দুটি বিধি মোতাবেক বন নিম্নোক্তভাবে শ্রেণিবদ্ধ হয়েছে। যথা: প্রথম শ্রেণি: কোন বিশেষ প্রজাতির অবলুপ্তি রোধের জন্য কিংবা অভয়ারণ্য বা অন্য কোন উদ্দেশ্যে এসব বনে সব ধরনের শিকার, ফাঁদ-পাতা বা মাছ-ধরা নিষিদ্ধ, যতদিন না একটি প্রজাতি বৃদ্ধি পেয়ে অন্যান্য সম্পদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় শ্রেণি: এই ধরনের বনে এসব আইন মোতাবেক বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত বা অনুমতিপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাই শুধু শিকার, ফাঁদ-পাতা বা মাছ ধরতে পারবে।

এসব আইন বন্যপ্রাণী রক্ষায় ততটা কার্যকর বলে প্রমাণিত হয় নি। ফলে, বাংলাদেশ সরকার রাষ্ট্রপতির আদেশ নং ২৩, ১৯৭৩ হিসাবে ‘বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) আদেশ ১৯৭৩’ জারি করে। অতঃপর ‘বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) (সংশোধন) বিধি, ১৯৭৪’ হিসেবে ১৯৭৩ সালের এই আইন সংশোধিত, সম্প্রসারিত ও পুনঃবিধিবদ্ধ হয়। সংশোধিত বিধিতে আছে ৪৮ ধারা ও ৩ তফশিল। এতে রয়েছে: বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী উপদেষ্টা পরিষদ গঠন, অভয়ারণ্য, জাতীয় পার্ক ও শিকারভূমি প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা; আইনভঙ্গকারীর জন্য জরিমানা ও শাস্তি; বন্যপ্রাণী আমদানি ও রপ্তানি; ভ্রাম্যমাণ আদালত গঠন; সরকারি কর্মচারীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য; এবং এই আইনের ভিত্তিতে বিধি-বিধান প্রণয়ন। এটি ১৮৭৯, ১৯১২ ও ১৯৩২ সালের আইনগুলিও বাতিল করে। এই তফশিলে বন্যপ্রাণীর একটি তালিকা রয়েছে, তাতে অন্তর্ভুক্ত যেগুলির শিকার অনুমতি সাপেক্ষে বৈধ; যেসব প্রাণী এবং তাদের সংরক্ষণযোগ্য অংশ ও মাংস রাখা, হস্তান্তর ও ব্যবসার জন্য অনুমতিপত্র প্রয়োজন।

প্রথম তফশিলে রয়েছে উভচর ৩, সরীসৃপ ৩, পাখি ২৭ ও স্তন্যপায়ী ৩ প্রজাতি। কাঁকড়াও এতে অন্তর্ভুক্ত। এ তফশিলে বর্ণিত প্রাণী সাধারণ অনুমতিপত্র নিয়েই শিকার করা যাবে। প্রথম তফশিলের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে উল্লেখিত সরীসৃপ, পাখি ও স্তন্যপায়ী শিকারের জন্য বিশেষ অনুমতিপত্র আবশ্যক, অর্থাৎ এসব প্রাণীর মধ্যে মানুষখেকো বাঘ, বন্য হাতি ইত্যাদির সংখ্যা বৃদ্ধি একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্যে বিঘ্ন ঘটালে কিংবা জান ও মালের জন্য হুমকি হয়ে উঠলে এই ধরনের অনুমতিপত্র পাওয়া যাবে। দ্বিতীয় তফশিলভুক্ত প্রাণীদের সংরক্ষণযোগ্য অংশ, মাংস বা চামড়া আইনসিদ্ধ অনুমতিপত্র ব্যতিরেকে রাখা অবৈধ। এতে আরও রয়েছে ১৮ সরীসৃপ, ৪৬১ পাখি ও ৬৭ স্তন্যপায়ী প্রজাতি যেগুলি শিকার, হত্যা বা ধরা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এই তফশিল মোতাবেক গর্ভবতী, দুগ্ধদাতা ও শাবকসহ মা-পশুদের শিকার নিষিদ্ধ। তফশিলের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে উল্লেখিত সব প্রাণীর স্ত্রী-পশু বিপজ্জনক ঘোষিত (মানুষখেকো বাঘ, বন্য হাতি ইত্যাদি) না হলে শিকার করা যাবে না।

১৯৭৪ সালের আইন ১৯২৭ সালের বিধি ও সংশ্লিষ্ট নিয়ম-কানুনের সঙ্গে এর সম্পর্ক উল্লেখ করেনি। ১৯২৭ সালের আইনের প্রাসঙ্গিক ধারাগুলিও এতদদ্বারা বাতিল হয়নি। বলা যেতে পারে, ১৯৭৪ সালের আইন একটি স্থায়ী বিধি হিসেবে ১৯২৭ সালের আইনের যাবতীয় বিধি-বিধান রহিত করেছে। ১৯৭৪ সালের আইনটি অবশ্য সর্বাঙ্গীন নয়, যথেষ্ট পূর্ণাঙ্গও নয়, তাতে বাদ গেছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। উপযুক্ত লোকবল, অর্থবল ও সুযোগ-সুবিধার অভাবে উল্লেখিত বিধিগুলিও যথাযোগ্যভাবে প্রয়োগ করা যায় না। আইনটির প্রয়োজনীয় সংশোধন আবশ্যক বলে বিশেষষ্ণদের ধারণা। আন্তর্জাতিক কনভেনশন, চুক্তি ও প্রটোকল বাংলাদেশ বন ও বনসম্পদসংশ্লিষ্ট কয়েকটি আন্তর্জাতিক কনভেনশন, চুক্তি ও প্রটোকলের স্বাক্ষরদাতা। এগুলির কোন কোনটি অনুমোদিত না হলেও স্বাক্ষরিত হওয়ার সুবাদে এগুলির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের পক্ষে ক্ষতিকর সব ধরনের কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। আমরা প্রকৃতির, প্রকৃতিও আমাদের। সুন্দর এই প্রকৃতি ও পরিবেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ বন্যপ্রাণী। প্রকৃতির এই অমূল্য সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব আমাদেরই। সে দায়িত্ব শুধু যে বন্যপ্রাণীর জন্য তাই নয়, কেনো না কোনোভাবে মানুষের অস্তিত্বের জন্যই বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ করা জরুরি।

লেখক: সহকারী কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার এন্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন