Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মাছে ভাতে বাঙালীর দক্ষিণাঞ্চলে আড়াই লাখ টন মাছ উদ্বৃত্ত বাড়ছে কাকড়া কুচিয়া সহ খাঁচায় মাছের চাষ

নাছিম উল আলম | প্রকাশের সময় : ৩০ আগস্ট, ২০২১, ২:৫৪ পিএম

গত এক দশকে দক্ষিণাঞ্চলে মাছের উৎপাদন প্রায় ৭৫% বৃদ্ধি পেয়ে ‘মাছে ভাতে বাঙালী’র বাস্তব উদাহরন সৃষ্টি করেছে। খাদ্যে উদ্বৃত্ত দক্ষিণাঞ্চল ইতোমধ্যে মাছের উৎপাদন প্রায় ৬ লাখ টনে উন্নীত হয়ে আড়াই লাখ টন উদ্বৃত্ত এলাকা। দক্ষিণাঞ্চল ইতোমধ্যেই সাড়ে ৭লাখ টন খাদ্য উদ্বৃত্বের টেকসই অবস্থান তৈরীর পাশাপাশি গত এক দশকে মাছের উৎপাদনও বেড়েছে প্রায় ৭৫%। তবে এসময়ে দেশে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ৫৫%। দক্ষিণাঞ্চলের ৬ জেলায় ৩.৩৮ লাখ লাখ টন মাছের চাহিদার বিপরিতে উৎপাদন ৬ লাখ টনের কছে। এমনকি গত এক দশকে দক্ষিণাঞ্চলে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে ১১৫%। মৎস্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানে সারা দেশের ৬৬% ইলিশ আহরিত হয় দক্ষিণাঞ্চলে। কৃষি ফসলের চেয়ে মাছে মুনফা বেশী হওয়ায় গ্রামঞ্চলে এখন মৎস্য চাষে আগ্রহ আরো বাড়ছে।
দক্ষিণাঞ্চলের ৬টি জেলার প্রায় ২৮হাজার হেক্টর বদ্ধ জলাশয়, ৪ লাখ ২৭ হাজার ৮৪২ হেক্টর উন্মুক্ত জলাশয় ছাড়াও দেড় সহশ্রাধীক বেসরকারী মৎস্য খামার, ৫০টির মত সরকারী-বেসরকারী মৎস্য হ্যাচারী, ৯২০টি নার্সারি খামার এবং প্রায় ৯ হাজার চিংড়ি খামারে মৎস্য উৎপাদনে ব্যাপক সাফল্য আসছে।
‘বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমিক্ষা-২০১৮’এর হিসেব অনুযায়ী, দেশের মোট জিডিপি’র ৩.৫৭% এবং কৃষিজ জিডিপি’র ২৬.৩৭% মৎস্যখাতের অবদান। দক্ষিণাঞ্চলে এ হার আরো বেশী বলে মৎস্য অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে।
জাতিসংঘের ‘খাদ্য ও কৃষি সংস্থা-ফাও’এর ২০১৮-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী মূক্ত ও অভ্যন্তরীন জলাশয়ে মাছ আহরনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় স্থানে এবং বদ্ধ জলাশয়ের মাছ উৎপাদনে ৫ম স্থানে রয়েছে। তেলাপিয়া উৎপাদনে অবস্থান ৪র্থ। ইলিশ উৎপাদনে প্রথম। দক্ষিণাঞ্চলেও এসব ক্ষেত্রে যথেষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে একজন মানুষের দৈনিক ৬০ গ্রাম মাছের চাহিদার বিপরিতে বাংলাদেশে ইতোমধ্যে তা প্রায় ৬৩ গ্রামে উন্নীত হলেও দক্ষিণাঞ্চলে এর পরিমান আরো বেশী। অথচ দুই দশক আগেও মাছের প্রাপ্যতা ছিল মাথাপিছু ৫৩ গ্রাম। অধিদপ্তরের মতে, দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ১২ শতাংশরও বেশী মানুষ মৎস্য সেক্টর থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছে। ২০১৬-১৭ সালে দেশে মাছ উৎপাদনে সয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করলেও দক্ষিণাঞ্চল আরো পাঁচ বছর আগে এখাতে সয়ম্ভর হয়।
তবে অব্যাহত নগরায়নে বরিশাল মহানগরী সহ দক্ষিণাঞ্চলের জেলা শহরের মত অনেক উপজেলা সদরের পুকুর, দীঘি ও খালগুলো ক্রমাগত ভড়াট হয়ে যাচ্ছে। যা আগামীতে এ সেক্টরের জন্য দুঃসংবাদ বয়ে আনতে পারে বলেও মনে করছেন মৎস্য বিশেষজ্ঞগন।
তবে এরপরেও বর্তমানে দক্ষিণাঞ্চলের ৬টি জেলায় প্রায় ৪ লাখ ২৭ হাজার পুুকুর ও দীঘি, ৬৬৭টি বরোপীট, ৯০টি প্রবাহমান নদ-নদী, ৪৩টি বিল, একটি বাঁওড় বা মরা নদী, প্রায় দেড় হাজার খাল ও সোয়া ৬শ প্লাবন ভূমি সহ মোট জলাশয়ের পরিমান ৫৪ লাখ ৫৬ হাজার হেক্টরের মত। এসব জলাশয়ে মাছের উৎপাদন ২০০৮-০৯ সালে ২ লাখ ৯৮ হাজার টন থেকে ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে সোয়া ৫ লাখ টনেরও বেশী বৃদ্ধি পেয়ছে। বর্তমানে তা প্রায় ৬ লাখ টন। যার মধ্যে ইলিশের উৎপাদনই প্রায় সাড়ে ৩ লাখ টনের মত। এছাড়াও রুই জাতীয় মাছ প্রায় ৭৬ হাজার টন। পাঙ্গাস, শিং-মাগুর, কৈ, তেলাপিয়া এবং চিংড়ি ছাড়াও অন্যান্য মাছের উৎপাদনও ১ লাখ ২০ হাজার টনের মত। এসময়ে দক্ষিণাঞ্চলের সরকারী-বেসরকারী ৫০টি হ্যাচারী ও ৯২৩টি নার্সারীতে প্রায় ২৫ হাজার কেজি রেনু ও প্রায় ৩০ লাখ মাছের পোনা উৎপাদন হচ্ছে।
দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় ৫ লাখ জেলে মৎস্য খাতের ওপর নির্ভরশীল। যারমধ্যে মৎস্য অধিদপ্তরের নিবন্ধিত জেলে ৩ লাখ ৫২ হাজার ৭২৪। মৎস্য অধিদপ্তরের মতে, বরিশাল বিভাগেই প্রায় সোয়া ৩ লাখ জেলে ইলিশ আহরনে জড়িত। যার ৬৫% সার্বক্ষণিকভাবে জড়িত বলে মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে বলা হয়েছে।
দেশের বিভিন্ন উন্মূক্ত জলাশয়ে ‘খাঁচায় মাছ চাষ’ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে দক্ষিণাঞ্চলেও প্রায় দেড় হাজার খাঁচায় বছরে প্রায় ১ হাজার টন বিভিন্ন ধরনের মাছ উৎপাদন হচ্ছে। এছাড়া এ অঞ্চলে কাকড়া ও কুচিয়া চাষ সম্প্রসারনেও সাফল্য আসছে। ইতোমধ্যে এ অঞ্চলের ৫টি জেলার ১১টি উপজেলার পুকুরে কিশোর কাকড়া চাষ, পেনে কাকড়া মোটাতাজা করন, খাঁচায় কাকড়া মোটাতাজা করন ও সামাজিক পর্যায়ে কুচিয়া চাষ-এর ২৫টি প্রদর্শনী খামার স্থাপন করা হয়েছে।
ফলে দক্ষিণাঞ্চলের ৭৩৫টি খামারে বছরে ৩শ টনেরও বেশী কাকড়া উৎপাদন হচ্ছে। এছাড়াও দক্ষিণাঞ্চলের ৮টি উপজেলার প্রায় তিন হাজার মৎস্যজীবী বছরে ১ হাজার টনেরও বেশী শুটকী উৎপাদন করেছে।
তবে এসব অর্জনের পরেও দক্ষিণাঞ্চলে মৎস্য অধিদপ্তরের অবস্থা খুব ভাল নয়। জনবল সংকটে এ অধিদপ্তরের কার্যক্রম অনেকটাই অচলবস্থার মুখে। ৬টি জেলার ৪২টি উপজেলার জন্য মৎস অধিদপ্তরের যে মাত্র ১৬৭টি জনবল মঞ্জুরী রয়েছে, তার অর্ধেকেরও বেশী পদ শূণ্য। এঅঞ্চলে সিনিয়র সহকারী পরিচালক, সহকরী পরিচরালক, সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা,উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা, মৎস্য সম্প্রসারন কর্মকর্তা, মৎস্য সম্প্রসারন ও মান নিয়ন্ত্রন কর্মকতা ও মৎস্য জরিপ কর্মকর্তার বেশীরভাগ পদেই জনবল নেই। এমনকি খামার ব্যাবস্থাপক সহ সহকারী মৎস কর্মকর্তার ৪২টি পদেরও বেশীরভাগই শূণ্য।
এসব বিষয়ে মৎস অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় উপÑপরিচলক’এর সাথে আলাপ করা হলে তিনি জানান, নদ-নদী ও খাল-বিল সমৃদ্ধ দক্ষিণাঞ্চলে মাছ চাষের অপার সম্ভবনার রয়েছে। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে উন্নত প্রযুক্তিতে মাছচাষ সম্প্রসারনে অধিদপ্তর উদ্যোক্তাদের প্রযুক্তিগত সহায়তা দিচ্ছে। অধিদপ্তরের জনবল সংকটের বিষয়টি সদর দপ্তর ও মন্ত্রনালয়কে নিয়মিত অবহিত করার কথা জানিয়ে অদুর ভবিষ্যতে এ সংকট কাটিয়ে ওঠা যাবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মাছ

১১ আগস্ট, ২০২২
২৩ জুলাই, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ