চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
ওবাইদুল্লাহ উবাইদ
॥ শেষ কিস্তি ॥
সমকালীন ইতিহাসের খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব ও আধ্যাত্মিক গুরু হযরত মাওলানা সোলতান আহমদ সাহেব নানুপুরী (রহ.) সাহেবও হযরতের সুযোগ্য সহচর ছিলেন। তিনি বাবুনগর মাদ্রাসায় দীনি শিক্ষাকার্যক্রম দীর্ঘদিন যাবত সফলতার সাথে আন্জাম দেন। দেশে-বিদেশে দীর্ঘসময় তিনি হযরত বাবুনগরী (রহ.)-এর সান্নিধ্যে ছিলেন। এর সুবাধে তিনি একদিন হযরত বাবুনগরীকে প্রশ্ন করলেন, ‘আমি কি যথাযথভাবে দীনি আলোচনা সম্বলিত বয়ান করতে পারব?’ জবাবে বাবুনগরী সাহেব বলেন, ‘অবশ্যই পারবে। একটু ধৈর্য ধরো। ইনশাআল্লাহ! বয়ানের জন্য তোমার এত এত ময়দান এত এত মঞ্চ তৈরি হবে, মানুষের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সময় দেওয়াটাও তোমার দুষ্কর হয়ে যাবে।’ বাবুনগরী (রহ.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্যায়িত হয়। দেখা গেছে, পরবর্তী সময়ে নানুপুরী (রহ.)-এর বয়ান শুনতে শ্রোতাদের মাঝে প্রবল ভক্তিপূর্ণ আগ্রহ তৈরি হয়।
চট্টগ্রাম হাটহাজারী ঈদগাহে একবার একটি ইসলামী জলসা অনুষ্ঠিত হয়। ওই জলসায় আকাবিরে দীনের বিরাট একটা অংশ উপস্থিত হন। হযরত বাবুনগরী (রহ.) বয়ান করছিলেন। অত্যন্ত আবেগভরা কণ্ঠে তিনি বয়ান করছিলেন। বক্তব্যে নানান বিষয়ের উপর গভীর জ্ঞানগর্ভ আলোচনা চলছিল। একসময় মুফতি সাহেব (রহ.) দাঁড়িয়ে যান। সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে বাবুনগরী (রহ.)-কে নিজের বুকের সাথে লাগিয়ে একটা চাপ দেন। এবং উচ্চকণ্ঠে বলেন, ‘আপনাকে তাসাওউফের চার খান্দানের ইজাজত (অনুমতি) দিলাম।’ এ সময় জলসার অবস্থা ছিল এক অন্যরকম! এটা কুদরতে খোদার এক বিস্ময়বিমূঢ় ঘটনা। হযরতের রাত্রি জাগরণ তৎকালে কম খাওয়া, কম ঘুমানো, লোকদের সাথে কম মিশা, কম কথা-বার্তা বলা; পীর-মুরশিদ তথা সঠিক দীনের প্রতি সফল পথপ্রদর্শকগণের নিত্যকার নিয়ম ছিল। তবে হাকিমুল উম্মত মুজাদ্দিদ মিল্লাত হযরত আশরাফ আলি থানবি (রহ.) বলেন, ‘বর্তমান সময়ে যেহেতু মানুষ আগেকার যুগের মানুষদের চাইতে শারীরিকভাবে দুর্বল, তাই কম খাওয়া, কম ঘুমানোর সাধনা তাদেরকে না-করাই উচিৎ। কিন্তু আরিফে রব্বানি কালজয়ী ব্যক্তিত্ব আল্লামা হারুন বাবুনগরী (রহ.)-এর আহারে স্বল্পতা, কম ঘুমানো যেন প্রতিদিনের একটা স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। বিশেষ বা ভালো কোনো খাদ্যের প্রতি তাঁর কোনো আগ্রহই ছিল না। দস্তরখানায় যদিও উন্নত খাবারের মজুদ থাকে, তারপরেও তিনি অল্প আহার করে উঠে যেতেন। সাধারণত মানুষের ভালো খাবারের প্রতি তুলনামূলক আগ্রহ থাকে। কিন্তু হযরতের এসবের কোনো চাহিদাই নেই। তাই হযরতের প্রিয় খাবার কী, সেটা জানা যায়নি। নাশতার প্রতি কোনো আগ্রহ ছিল না। দুপুরে শোয়ার অভ্যাস ছিল না। সুন্নাত পালনার্থে শুধু একটু কাইলুলা (মধ্যাহ্নে পর একটু শোয়া) করতেন। রাতে জলদি শুয়ে যাওয়ার তাড়া ছিল না। অনেক সময় বয়ান করতে করতে রাত একটা পেরিয়ে যেত। তবুও তিনি শুতেন না। কেউ যখন বলতো, ‘হযরত! রাত একটা বেজে গেছে।’ তিনি তখন বলতেন, ‘আরে বাজছে যখন বাজতে দাও।’
এদিকে আবার খুব ভোরে জেগে উঠতেন। তাহাজ্জুদ ও জিকরুল্লাহয় মশগুল হয়ে যেতেন। নিজের শরীরের প্রতি এত অবহেলার পরেও তিনি সুস্থ মস্তিষ্কের ছিলেন। বিশুদ্ধ চিন্তক ছিলেন। শরীরের স্বাস্থ্যও মাশাআল্লাহ! অনেক উন্নত ছিল। সমকালীন প্রসিদ্ধ খতিব মাওলানা মাজহারুল ইসলাম সাহেব হযরত বাবুনগরী (রহ.)-এর প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ ছিল। মুফতি আজিজুল হক (রহ.)-এর ওফাতের পর তিনি আধ্যাত্মিত দীক্ষায় দীক্ষিত হতে দীক্ষাগুরু হযরত বাবুনগরীর সান্নিধ্যে আসেন। তিনি প্রায় বলতেন, ‘‘মানুষ খাওয়া-দাওয়া, নিদ্রা ব্যতীত বেঁচে থাকতে পারে, দীনের পথপ্রদর্শক বাবুনগরী (রহ.)-কে না দেখলে বিশ্বাসই হতো না।
হারুন বাবুনগরী (রহ.) ওলিকুলের শিরোমণি আল্লামা জমির উদ্দিন (রহ.)-এর সান্নিধ্যে ১৮ বছর ছিলেন। তিনি শায়খকে মানবরূপী ফেরেশতা মনে করতেন। আপন শায়খের উপর এতই আস্থাবান ছিলেন যে, হযরতের সকল নির্দেশে আত্মোৎসর্গ করতে সর্বদা প্রস্তত থাকতেন। জমির উদ্দিন (রহ.)-এর ইন্তিকালের পর তিনি আধ্যাত্মিক দীক্ষালাভ করতে মুফতি আজিজুল হক (রহ.)-এর দিকে মনোনিবেশ করেন। তিনি হযরতের প্রেমের অতল গহ্বরে হারিয়ে গেলেন। মুফতি সাহেবকে পেয়ে তিনি আপন শায়খকে হারানোর ব্যথা থেকে অনেকাংশে মুক্তিলাভ করেন।
ওলিগণের কারামত সাহাবায়ে কেরাম (রাজি.)-এর যুগ থেকেই প্রকাশ পেয়ে আসছ। আল্লাহ কারামত দ্বারা কারো হিম্মত ও উদ্যমতাকে বৃদ্ধি করেন। কারো অন্তরে দৃঢ়তা সৃষ্টি করেন। কারামাত দুই প্রকার। এক প্রকার হচ্ছে হিস্সিয়া (অনুভব করা যায়)। দ্বিতীয় প্রকার হচ্ছে অন্তর্নিহিত কারামাত। দীনের উপর অবিচল থাকা। অটল থাকা। সুন্নাত ও নিজের বিশুদ্ধ নীতির উপর অটল থাকা। মূলত এটিই কারামাত।
হযরত বাবুনগরী (রহ.) যে অল্পতুষ্টির উপর জীবনযাপন করেছেন সময়ের আবর্তন-বিবর্তন ও যুগের অবস্থার পরিবর্তন কোনোটিই হযরতের দৃঢ়তার উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামেরর সুন্নাতের সংরক্ষণও আকাবিরদের নীতির যথাযথ হেফাজতে তিনি ছিলেন শক্তিশালী কেল্লাস্বরূপ। এই ইস্তিকামাতই (দৃঢ়তা অবিচলতা) হচ্ছে কারামাত।
হযরত হারুন বাবুনগরী (রহ.)-এর অবদান বা দীনের খেদমতের কথা উল্লেখ করে কেবল লেখার কলেবরই বৃদ্ধি পাবে। তাঁর অবদানের কথা লিখে-বলে শেষ করা যাবে না। তবে হযরতের জীবনী আলোচনায় হযরতের নিজ হাতে গড়া জামিয়া বাবুনগরের নাম না নিলে যে হযরতের প্রতি অন্যায় করা হবে! তাই কিঞ্চিৎ আলোচনা করতেই হয়। তাঁর ইলম ও দীনি অবদানের মধ্যে অবশ্যই বাবুনগর মাদ্রাসা শীর্ষস্থানের যোগ্য। তিনি একদিকে যেমন তাসাউওফের একজন সুখ্যাত রাজ-সম্রাট, তেমনই শরীয়তের দাবি সম্পর্কে ছিলেন পূর্ণ অভিজ্ঞ। আল্লাহর একমাত্র মনোনীত ধর্ম ইসলামের ব্যাপক প্রচার-প্রসার ও ধনী-গরিব আদম সন্তানদেরকে দীনি শিক্ষা-দীক্ষায় আলোকিত করে তুলতে তিনি ১৩৪৫ হিজরি সন মোতাবেক ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে বাবুনগর মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। যেটি আজকের এ সময়ে এশিয়া উপমহাদেশের শীর্ষস্থানীয় একটি মাদ্রাসা হিসেবে পরিচিত। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে তিনি নিজেই এর কর্ণধার ছিলেন। নিয়মিত ক্লাসও করাতেন। হযরতের ইন্তিকালের পর তাঁরই গুণধর সন্তান শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী সাহেব (দা.বা.) এ মাদ্রাসার পরিচালনার গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করে যাবতীয় কাজ সফলতার সাথে আন্জাম দিয়ে আসছেন। হযরত হারুন বাবুনগরী (রহ.) মাদ্রাসার ফান্ড থেকে না নিজের জন্য বেতন নিতেন, না দৈনিক আহার মাদ্রাসায় করতেন। এমনকি মাদ্রাসার বার্ষিক মাহফিলের সময় হাজার হাজার লোক মাদ্রাসায় আহার করাতেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়! সেদিনও বাবুনগরী (রহ.) মাদ্রাসা থেকে আহার করতেন না। মাদ্রাসার মাঠ থেকে হযরতের গৃহপালিত কোনো পশু যদি ঘাস খায় তিনি সে টাকাটাও মাদ্রাসার ফান্ডে এনে জমা করে দিতেন।
মৃত্যু প্রায় সুদীর্ঘ সাতযুগ ধরে পৃথিবীর বুকে সত্যের আলো বিকিরণের পর ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসের আঠারো তারিখ, বরকতময় দিন রোজ সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটায় চট্টগ্রাম মেডিকেয়ার ক্লিনিকে হযরত হারুন বাবুনগরী (রহ.) নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে আপন মনিবের ডাকে সাড়া দিয়ে চিরদিনের জন্য চলে যান। মুহূর্তের মধ্যেই রেডিও-সংবাদের মাধ্যমে সারাদেশে হযরতের মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে। শেষবারের মতো তাঁর প্রদীপ্ত চেহারা দর্শনের লক্ষ্যে বাঁধভাঙ্গা স্রোতের ন্যায় মানুষ জমায়েত হতে লাগল। তখন কোরবানির ঈদ উপলক্ষে সকল প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা সত্ত্বেও এত মানুষের জমায়েত সত্যিই বিস্ময়কর! এ ছিল স্মরণকালের বৃহত্তম জমায়েত। পরদিন মঙ্গলবার সাড়ে ১১টা বাজে জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। জানাজার নামাজের ইমামতি করেন বাবুনগরী (রহ.)-এর বড় পুত্র বর্তমান জামিয়া বাবুনগরের প্রধান পরিচালক আল্লাম মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী সাহেব। মাদ্রাসার দক্ষিণ পার্শ্বে মাকবারায়ে হারুনীতে হযরত বাবুনগরী (রহ.) চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।