Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আফগানিস্তানে পরিবর্তনের প্রতি নজর রাখা দরকার

আ ক ম আশরাফুল হক | প্রকাশের সময় : ১২ আগস্ট, ২০২১, ১২:০৬ এএম

পৃথিবী প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। প্রকৃতি, জলবায়ু, পরিবেশ, পরিস্থিতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, রাষ্ট্র ও মানচিত্রসহ পৃথিবীর সব কিছুতেই পরিবর্তনের একটা হাওয়া সর্বদা লেগে আছে। এমনকি মানুষের স্বভাব-চরিত্র, ধ্যান-ধারণা, আকীদা-বিশ্বাস, সভ্যতা ও সংস্কৃতিতেও লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখা যায়। গত একশত বছরে বাংলাদেশ, ভারতসহ গোটা পৃথিবীতে বিপুল পরিবর্তন হয়েছে। ভারত ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত একটি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র ছিল। প্রায় পৌনে দুশত বছরের আন্দোলনের পর ধর্মীয় বিবেচনায় হিন্দুদের জন্য একটি এবং মুসলিমদের জন্য একটি, দুটি রাষ্ট্র, দুটি মানচিত্র হয়। ঠিক ২৪ বছর পর সেটা আবার পরিবর্তন হয়, নয় মাসের যুদ্ধে বাংলাদেশ নামে নতুন একটি মানচিত্র ও রাষ্ট্র আত্মপ্রকাশ করে। গত একশত বছরে আরো পরিবর্তনগুলো দেখুন। সিকিম, হায়দ্রাবাদ, জুনাগড় নামে স্বাধীন দেশের অস্তিত্ব বিশ্ব মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে। মুসলিম বিশ্বের সেন্ট্রাল খেলাফত তুরস্কের ওসমানী সাম্রাজ্য ধ্বংস করে আরববিশ্বে ছোট ছোট বহু দেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। তুরস্কে আধুনিকতা ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ইসলামকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সেই তুরস্কে ৭০ বছর পর আবার নতুন করে ইসলামের জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগানের নেতৃত্বে দেশটি বিশ্ব পরিমন্ডলে নতুন ইসলামী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। গত একশত বছর পূর্বে গোটা বিশ্বে ইউরোপীয় ও পশ্চিমাদের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য ছিল। যেমন ভারত, মালয়েশিয়া, মিসরসহ অনেক দেশে বৃটেনের ঔপনিবেশিক শাসন ছিল। আলজেরিয়া ছিল ফ্রান্সের উপনিবেশ। ল্যাটিন আমেরিকায় ব্রিটেন ও স্পেন, আফ্রিকায় স্পেন, ফ্রান্স ও বৃটেনের ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু গত একশত বছরের মধ্যে সবাইকে ওইসব দেশ ছেড়ে লেজ গুটিয়ে নিজেদের দেশে ফিরে যেতে হয়েছে।

১৯১৮ সালে প্রথম ও ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধকল বিশ্ববাসীকে সইতে হয়েছে। এই দুই বিশ্বযুদ্ধে পৃথিবীতে বিশাল পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে। একদিকে বিশ্ব আধিপত্যে জার্মানির হিটলারের উত্থান এবং ওসমানি খেলাফতের দীর্ঘ সাত শত বছরের ধারাবাহিক শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটে, অন্যদিকে নতুন বিশ্বশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় আমেরিকা ও রাশিয়া। কিন্তু মাত্র ৭০ বছর বিশ্ব পরিমন্ডলে দাপট দেখিয়ে ১৯৯০ সালে দুর্বল আফগানিস্তানে হোঁচট খেয়ে রাশিয়া ভেঙে খান খান হয়ে যায়। জন্ম নেয় বেশ কয়েকটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র। বিশ্ব মানচিত্র উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কিমিনিস্তান, কাজাখস্তানসহ বেশ কয়েকটি স্বাধীন দেশ আত্মপ্রকাশ করে। পরিবর্তনের ধারা জানান দেয়।

এই ঠুনকো আফগানিস্তানেই মাত্র ৩০ বছর পর শতাব্দীর আরেক পরাশক্তি আমেরিকা হোঁচট খেল। ধরাশায়ী হলো। হলো পরাজিত। ১৯৯০ সালে রাশিয়াকে যেভাবে আফগানিস্তান ছাড়তে হয়েছে, আজ আমেরিকাকেও সেভাবেই দেশটি ছাড়তে হয়েছে। আফগানিস্তান মাত্র ৩০ বছরের ব্যবধানে দুই বিশ্ব পরাশক্তি আমেরিকা ও রাশিয়ার পরজয়ে নতুন শতাব্দীর শুরুতেই বিশ্ব রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তনের আভাস লক্ষ করা যাচ্ছে। আফগানিস্তানে আগ্রসনের পর থেকে রাশিয়া যেমন অনেকটা দুর্বল ও সংকুচিত হয়ে এসেছিল, তেমনি এবারও মনে হচ্ছে আমেরিকাও দুর্বল ও সংকুচিত হয়ে আসবে। ফলে বিশ্ব পরিমন্ডলে নতুন কোনো পরাশক্তির আগমন ও আবির্ভাব অবশ্যাম্ভাবী হয়ে পড়বে। বিশ্ব শাসন ও নিয়ন্ত্রণের সেই শক্তি কে হতে পারে? তাবত বিশ্ব আজ এ নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনায় করছে। বিজ্ঞ মহল মনে করে, নব্য তুর্কি, চায়না, রাশিয়া বেল্ট নতুন পরাশক্তির জায়গা অনেকটা পূরণ করতে পারে। রাজনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের অগ্রসরমান অবস্থান সেই ইঙ্গিতই বহন করছে বলে অনেকে মনে করেন।

গত শতাব্দীর পরিবর্তনটা যেমন এশিয়া মহাদেশের একটি মুসলিম দেশ তুরস্ককে কেন্দ্র করে সংঘটিত হয়েছিল। তেমনি এবারের বিশ্ব পরিবর্তনও এশিয়া মহাদেশের একটি মুসলিম দেশ আফগানিস্তানকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হতে যাচ্ছে। ফলে সঙ্গতভাবে এই পরিবর্তনের ঢেউ সবচেয়ে বেশি আঘাত করার সম্ভাবনা মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায়, যার দরুন ভারতকে আমরা এ বিষয়ে খুব ব্যতিব্যস্ত দেখতে পাচ্ছি। আফগানিস্তান থেকে আমেরিকার এভাবে চলে যাওয়ায় ভারতের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ লক্ষ করা যাচ্ছে। আমেরিকার নিয়ন্ত্রণমুক্ত আফগানিস্তানের নতুন স্বাধীন অবস্থানে আরো বেশ অস্বস্তিতে রয়েছে ভারত। অন্যদিকে চীন ইতোমধ্যে আফগান নতুন কর্তৃপক্ষকে সাদর সম্ভাষণ জানিয়েছে। পরিবর্তিত এই অবস্থানকে তারা স্বাগত জানিয়েছে।

আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত, চীন ও বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে কাছাকাছি অবস্থিত। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিকভাবে এ দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশ ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। আদিকাল থেকে পৃথিবীর সকল রাজনৈতিক পরিবর্তনে ভূরাজনীতি (জিও পলিটিক্স) নিয়ামক হিসেবে কাজ করে আসছে। আজকের বিশ্ব পরিবর্তনেও এই ভূরাজনীতি মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভূরাজনীতির জটিল সমীকরণে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে আমাদের কী করা উচিত? বাংলাদেশের ভূমিকা এবিষয়ে কী হতে পারে? দেশের রাজনৈতিক মহল, গবেষক, বিশ্লেষক ও বুদ্ধিজীবী মহলে এ নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। তাদের মতে, এক্ষেত্রে বাংলাদেশ নীরব ভূমিকায় থাকতে পারে না। বিশ্বের সাথে তাল মিলাতে কিছু না কিছু ভূমিকা রাখতেই হবে। পৃথিবীটা মূলত একটা প্রতিযোগিতার মঞ্চ। এই মঞ্চে নীরব থাকার কোনো সুযোগ নেই।
আফগানিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী নতুন নেতৃত্ব বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন নয়; বরং বিশ্ব পরিবেশের সাথে সঙ্গতিশীল এক অদম্য নেতৃত্ব। এই নেতৃত্ব ইতোমধ্যে আগের তুলনায় অনেক বেশি রাজনৈতিক ও ক‚টনৈতিক দক্ষতা দেখাতে সক্ষম হয়েছে। রাজনৈতিক পরিপক্কতা অর্জন করেছে। এজন্য তারা বিশ্ব দরবারে নিজেদেরকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছে। এদিকে আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ও দেশটির পরিবর্তিত নতুন নেতৃত্বের সাথে রাজনৈতিক যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করছে। এক্ষেত্রে ভারত, পাকিস্তান, বৃটেন, কাতার, আমেরিকা ও চীনসহ প্রভৃতি শক্তিধর দেশের কথা উল্লেখ করা যায়।

আমরা আশা করব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দেশের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় স্বার্থ বিবেচনা করে এক্ষেত্রে বিচক্ষণ ও যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবেন।
লেখক: নির্বাহী সভাপতি, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি ও প্রধান সমন্বয়কারী জাতীয় সংহতি মঞ্চ



 

Show all comments
  • আব্দুল্লাহ ইদ্রিস ১৪ আগস্ট, ২০২১, ৫:০৯ এএম says : 0
    মাশা আল্লাহ লেখাটা খুবই সুন্দর ও তথ্য বহুল হয়েছে ধন্যবাদ
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন