Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

হাসপাতাল করার জমি থাকলেও সিআরবি ধ্বংসের আয়োজন

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ১ আগস্ট, ২০২১, ১২:০১ এএম

হাসপাতাল করার মতো অনেক জমি আছে রেলওয়ের। নগরীর ঝাউতলা, আমবাগান, খুলশি, পাহাড়তলী, বন্দর, ষোলশহরে অনেক জমি পড়ে আছে। কুমিরাতে রেলের ৩৫ একর জমিতে গড়ে উঠা যক্ষা হাসপাতাল দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। সেখানেও বেশ কয়েকটি হাসপাতাল করা যায়। এছাড়া সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী হাসপাতালের জন্য জমি দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। সিডিএ বলছে তাদেরও জমি আছে। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে বিকল্প হিসাবে নগরীর পতেঙ্গায় সাগর তীরবর্তী এলাকা, কিংবা দক্ষিণ চট্টগ্রাম অথবা রেলের যে কোন সমতল ভ‚মিতে হাসপাতাল নির্মাণ করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।

কিন্তু আধুনিক একটি হাসপাতাল করার মতো অনেক জমি থাকার পরও চট্টগ্রামের ফুসফুস হিসাবে পরিচিত ইতিহাস, ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক শোভামন্ডিত সিআরবি ধ্বংসের আয়োজন থেমে নেই। টানা প্রায় তিন সপ্তাহের আন্দোলনেও টনক নড়েনি। পরিবেশ বিরোধী ওই সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে রেলওয়ে ও বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন তথ্য গোপন করে হেরিটেজ ঘোষিত একটি সংরক্ষিত স্থানে হাসপাতালের নামে পানির দরে সোনার চেয়ে দামি জমি গ্রাস করার নীলনকশা এটি।

পূর্ব রেলের সদর দপ্তর সিআরবি এলাকায় রেলওয়ে হাসপাতাল কলোনির ছয় একর জমি সরকারি-বেসরকারি (পিপিপি) প্রকল্পের আওতায় ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ কোম্পানি লিমিটেডকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সেখানে তারা ৫০০ শয্যার হাসপাতাল, ১০০ আসনের মেডিকেল কলেজ ও ৫০ আসনের একটি নার্সিং ইনস্টিটিউট নির্মাণ করবে। প্রকল্পটির কাজ শুরু হতেই তীব্র প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু হয় চট্টগ্রামজুড়ে।
প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করে সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্প বাতিল অথবা অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার দাবিতে চলছে সামাজিক আন্দোলন। আন্দোলনের মুখে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দেয় হাসপাতালের জন্য কোন গাছ কাটা হবে না। তাছাড়া হাসপাতাল হবে সিআরবির অদূরে। তবে বাস্তবতা হলে সিআরবির খুব কাছেই ছয় একর জমি। সেখানে যেতে হবে সিআরবি সাত রাস্তা হয়ে।

সেখানে হাসপাতাল হলে পুরো সিআরবি এলাকা বিরাণ ভ‚মিতে পরিণত হবে। স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, সেখানে হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ ও নার্সিং ইনস্টিটিউটের পাশপাশি আরো অনেক স্থাপনা করতে হবে। এর ফলে পুরো এলাকা একটি যানজট ও রাতে দিনে কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হবে। প্রস্তাবিত হাসপাতাল এলাকার পাশেই কয়েকটি বাংলো ছাড়াও স্কুল, মসজিদ ও মন্দির রয়েছে। আছে গণবসতিপূর্ণ এলাকা।

সাবেক সিটি প্রশাসক ও মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন বলেন, হাসপাতাল করার মতো উপযুক্ত জমি থাকার পরও সিআরবিকে ধ্বংস করার যে আয়োজন তার নেপথ্যে রয়েছে বাণিজ্যিক স্বার্থ। সোনার চেয়ে দামি জমি দখল করার চক্রান্ত চাটগাঁবাসী প্রতিহত করবে। আমরা অবশ্যই হাসপাতাল চাই। কিন্তু চট্টগ্রামের ফুসফুস কেটে নয়। সিআরবির আশেপাশে তো নয়ই পাহাড় ও গাছ কেটে কোথাও হাসপাতাল করতে দেয়া হবে না।

সিআরবি সুরক্ষায় গঠিত ১০০১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির সদস্য সচিব ও বার কাউন্সিলের সাবেক সদস্য অ্যাডভোকেট ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল বলেন, হাসপাতাল নির্মাণের জন্য রেলওয়ে যে টেন্ডার আহŸান করে তাতে সিআরবির নাম ছিলো না। প্রকল্পের স্থান লেখা ছিলো রেলের যে কোন এলাকার জমি। কিন্তু এখন তারা হেরিটেজ ঘোষিত সংরক্ষিত এলাকায় হাসপাতাল করছে। যা সম্পূর্ণ বেআইনি। সিআরবি সুরক্ষায় আন্দোলন চলবে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা আইনি লড়াইও চালিয়ে যাব।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রধান প্রৌকশলী কাজি হাসান বিন শামস বলেন, নগরীর সবচেয়ে উম্মুক্ত স্থান সিআরবি সিডিএর মাস্টারপ্ল্যানে সংরক্ষিত এলাকা। ওই এলাকায় কোন বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের এখতিয়ার কারো নেই। আমরা সেখানে কোন স্থাপনা নির্মাণের অনুমোদন দেব না। তিনি বলেন, একটি নগরীর অন্তত ৩০ থেকে ৪০ ভাগ স্থান উম্মুক্ত রাখার কথা। সেই অনুপাতে চট্টগ্রামে উম্মুক্ত কোন স্থান নেই। হাসপাতাল করার মতো পতেঙ্গা এলাকাসহ নগরীর আশপাশে অনেক জমি আছে জানিয়ে তিনি বলেন সিআরবি এলাকায় হাসপাতাল হলে পুরো এলাকার পরিবেশ ধ্বংস হয়ে যাবে।

পরিবেশ অধিদফতর চট্টগ্রাম মহানগরীর পরিচালক মোহাম্মদ নূরউল্লা নূরী বলেন, ইউনাইটেড কর্তৃপক্ষ এখনও পরিবেশ ছাড়পত্র নেয়নি। সিআরবিতে হাসপাতালের নির্মাণের কোন ছাড়পত্র দেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ এলাকাটি হেরিটজ ঘোষিত এবং সেই সাথে সংরক্ষিত।

ওই এলাকার বাসিন্দা ও জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী বলেন, যেখানে হাসপাতাল করতে চাইছে সেখানে এখনও তিনজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদের কবর দৃশ্যমান। সেখানে একটি মসজিদ, দুটি মন্দির আছে। রেলওয়ের স্টাফদের বাসা আছে। পাশে গোয়ালপাড়া, এনায়েত বাজার ও বাটালি রোডের মতো গনবসতিপূর্ণ এলাকা। সেখানে হাসপাতাল হলে যানবাহন আর মানুষের চাপে পরিবেশ নষ্ট হবে। এত প্রতিবাদের পরও সেখানে হাসপাতাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে না আসায় রেলওয়ে এবং বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের সেবার মহৎ উদ্দেশ্য নয় অসৎ উদ্দেশ্য স্পষ্ট হচ্ছে বলে জানান তিনি।

বিশিষ্ট স্থপতি পরিকল্পিত চট্টগ্রাম আন্দোলনের নেত্রী প্রফেসর জেরিনা হোসেন বলেন, সিআরবিতে কোনভাবেই স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। এটা অপ-উন্নয়ন এবং গণবিরোধী। পৃথিবীর প্রতিটি উন্নত শহরে উম্মুক্ত স্থান আছে। তারা সেটাকে সংরক্ষণ করে। সিআরবিকে ধ্বংস করা যাবে না। এই শহরেই হাসপাতাল করার মতো অনেক জমি আছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মাদ ওমর ফারুক রাসেল বলেন, হাসপাতাল এবং বাণিজ্যিক স্থাপনা হলে ধীরে ধীরে সিআরবি ও আশপাশের এলাকার সবুজ পরিবেশ , গাছ -পালা, পাখ পাখালি এবং জীববৈচিত্র্য বিনাশ হবে। এলাকাটি কোলাহলময় হয়ে উঠবে। ভবনে লাগানো এসির কারণে এলাকার অক্সিজেন ও কার্বনের ভারসাম্য ভেঙে পড়বে, উষ্ণতা বেড়ে যাবে। এর নেতিবাচক প্রভাব আশপাশের এলাকায় মানুষের উপরও পড়বে।

অক্সিজেন মাস্ক পরে প্রতিবাদ
সিআরবিতে গাছ কেটে হাসপাতাল নির্মাণের প্রতিবাদে সিআরবিতে অক্সিজেন মাস্ক পরে এবং সিলিন্ডার নিয়ে গতকাল অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন প্রবীণ সাংবাদিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসিরুদ্দিন চৌধুরী। এসময় তার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। চট্টল ইয়ুথ কয়ারের ব্যানারে আয়োজিত এই প্রতিবাদ কর্মসূচিতে নাসিরুদ্দিন চৌধুরী বলেন, সিআরবি যদি ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে আমাদের মুক্ত বায়ুর জায়গাটা ধ্বংস হয়ে যাবে। চট্টগ্রামের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে অতীতে বহু ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। এবার তার ব্যতিক্রম হবে না। সিআরবি সুরক্ষার আন্দোলনে চট্টগ্রামবাসী সফল হবে।



 

Show all comments
  • Rimon Arfin ১ আগস্ট, ২০২১, ৪:৫৯ এএম says : 0
    জনাব ফজলুল হক এমপি স্যার যেমন চাইছেন এটা ধ্বংস না করে অন্যত্র করতে, তেমনি আমরা উত্তরবঙ্গের লোকেরাও চাই ঐ জায়গাটা বাদ দিয়ে অন্য কোথাও হোক হাসপাতালটি ।
    Total Reply(0) Reply
  • রুকাইয়া খাতুন ১ আগস্ট, ২০২১, ৪:৫৯ এএম says : 0
    দ্রুত এই প্রকল্প থেকে সরে আসা হোক।
    Total Reply(0) Reply
  • রক্তিম সূর্য ১ আগস্ট, ২০২১, ৫:০০ এএম says : 0
    পারিবেশ ধ্বংস করে কোনো কিছু করা যাবে না
    Total Reply(0) Reply
  • Hafiz Uddin ১ আগস্ট, ২০২১, ১১:৩২ এএম says : 0
    হাসপাতাল এবং বাণিজ্যিক স্থাপনা হলে ধীরে ধীরে সিআরবি ও আশপাশের এলাকার সবুজ পরিবেশ , গাছ -পালা, পাখ পাখালি এবং জীববৈচিত্র্য বিনাশ হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • Kamal Hossain ১ আগস্ট, ২০২১, ১১:৩৩ এএম says : 0
    সিআরবিতে কোনভাবেই স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। এটা অপ-উন্নয়ন এবং গণবিরোধী।
    Total Reply(0) Reply
  • Saadiq ২ আগস্ট, ২০২১, ১:৫৫ এএম says : 0
    চট্টগ্রামের নগরীর অধিকাংশ পাহাড়,অসাধু সরকারি কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অবৈধভাবে লীজ নিয়ে পাহাড় কেটে পরিবেশ ধ্বংস করা হয়েছে এবং হচ্ছে সরজমিনে গিয়ে এখনো দেখা যায় নাছিরাবাদ,খুলশী,কাবিলাধাম এলাকার পাহাড় কাটার দৃশ্য
    Total Reply(0) Reply
  • নূর মোহাম্মদ ২ আগস্ট, ২০২১, ৩:৪৬ এএম says : 0
    সিআরবি ন্যাচেরাল হাসপাতাল,অন্য হাসপাতালের কিবা প্রয়োজন।
    Total Reply(0) Reply
  • নূর মোহাম্মদ ২ আগস্ট, ২০২১, ৩:৪৬ এএম says : 0
    সিআরবি ন্যাচেরাল হাসপাতাল,অন্য হাসপাতালের কিবা প্রয়োজন।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সিআরবিতে হাসপাতাল

৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১
১৮ আগস্ট, ২০২১

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ