চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
হাফেজ মুহাম্মদ আবুল মঞ্জুর
ইসলাম শান্তি-সম্প্রীতি ও মানবতার ধর্ম। কোনরূপ সহিংসতা, বিবাদ-বিসংবাদের স্থান ইসলামে নেই। ন্যূনতম শান্তি-শৃঙ্খলা ও সম্প্রীতি বিনষ্ট হয় এমন আচরণকেও ইসলাম প্রশ্রয় দেয় না। পবিত্র কোরআন মজীদে আল্লাহপাক ইরশাদ করেন ‘ফিৎনা-ফাসাদ বা দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করা হত্যার চেয়েও কঠিন অপরাধ।’ (সুরা বাকারা, আয়াত-১৯১)। ‘পৃথিবীতে শান্তি স্থাপনের পর তাতে ফাসাদ সৃষ্টি করো না।’ (সূরা আ’রাফ, আয়াত-৫৬)। অমুসলিমদের প্রতিও কোন অন্যায় আচরণ ইসলাম অনুমোদন করে না। শান্তি-সৌহার্দ্য ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সুরক্ষায় ইসলামের রয়েছে শ্বাশত আদর্শ ও সুমহান ঐতিহ্য। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সাথে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর প্রতিটি আচরণ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিরল ও প্রোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এক অমুসলিম বৃদ্ধার ঘটনা ইতিহাসে আমরা জেনেছি। সে বৃদ্ধা প্রতিদিন মহানবী (স.)-এর চলার পথে কাঁটা দিত। একদিন রাসূল (স.) দেখলেন, পথে কাঁটা নেই, তখন তিনি ভাবলেন, হয়ত ওই বৃদ্ধা অসুস্থ হয়েছে বা কোন বিপদে আছে, তার খোঁজ নেয়া দরকার। এরপর দয়ার নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) ওই বৃদ্ধার বাড়িতে পৌঁছে দেখেন ঠিকই সে অসুস্থ। তিনি বৃদ্ধাকে বললেন, আমি আপনাকে দেখতে এসেছি। এতে বৃদ্ধা অভিভূত হয়ে গেল যে, আমি যাকে কষ্ট দেয়ার জন্য পথে কাঁটা পুতে রাখতাম, সে-ই আজ আমার বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছে। ইনিই তো সত্যিকার অর্থে শান্তি ও মানবতার অগ্রদূত।
রাসূলে কারীম (স.)-এর ঘরে একবার এক ইহুদী মেহমান হয়ে আসল। রাসূল (স.) তাকে যথাযথ মেহমানদারী করলেন এবং রাতে বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দিলেন। পরে সে ইহুদী মেহমান অসুস্থতাবশত বিছানায় মলমূত্র ত্যাগ করে। তাই রাসূল (স.) তাকে কিছু বলবেন এই ভয়ে সে প্রভাতের আগেই ঘর থেকে পালিয়ে গেল। ভোরে ওই ময়লাযুক্ত বিছানা দেখে রাসূল (স.) এই মর্মে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন যে, হায়! আমি ওই ব্যক্তিকে যথাযথ মেহমানদারী করতে পারিনি; এতে সে কষ্ট পেয়েছে। অতঃপর মহামানব বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স.) নিজ হাতে ময়লা ও দুর্গন্ধযুক্ত বিছানাটি পরিষ্কার করলেন এবং সেই ব্যক্তির কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইলেন, ভাই আমি আপনাকে যথাযথ মেহমানদারী করতে পারিনি। এজন্য আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। তখন ইহুদি লোকটি বলল, অপরাধ করলাম আমি আর ক্ষমা চাচ্ছেন আপনি। ইসলামের আদর্শ তো সত্যিই মহৎ! অতঃপর রাসূল (স.)-এর এমন উদারতা ও আদর্শে মুগ্ধ হয়ে সে ইসলাম গ্রহণ করে। হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর এই উদার ঐতিহাসিক চরিত্রকে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ফুটিয়ে তুলেছেন এভাবে, “তোমার ধর্মে অবিশ্বাসীরে তুমি ঘৃণা নাহি করে/আপনি তাদের করিয়াছ সেবা ঠাঁই দিয়ে নিজ ঘরে।” এরূপ উৎকৃষ্টতম আদর্শের মাধ্যমেই বিশ্বব্যাপী ইসলামের প্রচার ও জাগরণ ঘটেছে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) মক্কা থেকে মদীনা হিজরত করার পর যে ‘মদীনা সনদ’ প্রণয়ন করেন তা বিশ্ব ইতিহাসের সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান এবং শান্তি-সম্প্রীতির ঐতিহাসিক দলিল। এই সনদে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষাসহ সংখ্যালঘুদের অধিকার ও নিরাপত্তা প্রদান সম্পর্কিত উল্লেখযোগ্য ধারা সন্নিবেশিত রয়েছে। যেমন “সনদে স্বাক্ষরকারী সকল গোত্র-সম্প্রদায় ‘মদীনা রাষ্ট্রে’ সমান অধিকার ভোগ করবে, সকল ধর্মসম্প্রদায়ের স্ব-স্ব ধর্ম-কর্ম পালনের স্বাধীনতা ও অধিকার যথারীতি বহাল থাকবে; কেউ কারও ওপর কোনরূপ আক্রমণ করবে না, সন্ধিভুক্ত কোন সম্প্রদায় বহিঃশত্রুকর্তৃক আক্রান্ত হলে উক্ত আক্রান্ত সম্প্রদায়কে সম্মিলিতভাবে সহযোগিতা করতে হবে এবং শত্রুদের প্রতিহত করতে হবে, কোন নাগরিক কোন অপরাধ করলে তা তার ব্যক্তিগত অপরাধ বলে গণ্য করা হবে।” (সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ ২য় খ-, পৃষ্ঠা ৯৪ ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকাশিত)। এভাবে ঐতিহাসিক মদীনা সনদের মাধ্যমে শান্তির বার্তাবাহক বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স.) ধর্ম-বর্ণ, জাতি-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সকলের মাঝে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি, সাম্য-মৈত্রীর সুদৃঢ় বন্ধন রচনা করে আদর্শ কল্যাণ রাষ্ট্রের অদ্বিতীয় নজির স্থাপন করেন। মুসলিম ও কুরাইশদের মাঝে স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক হুদায়বিয়ার সন্ধির বেশক’টি ধারা ছিল মুসলিম স্বার্থবিরোধী। এতদসত্ত্বেও সুদূরপ্রসারী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) তা মেনে নেন। কিন্তু প্রতিপক্ষের প্রতিনিধি সুহাইল ইবনে আমর হুদায়বিয়ার সন্ধিতে হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর নামের সাথে ‘রাসূলুল্লাহ’ লেখা যাবে না মর্মে আপত্তি জানিয়ে বলল, আমি যদি সাক্ষ্য দিতাম যে, আপনি আল্লাহর রাসূল, তাহলে তো আর আপনার সাথে যুদ্ধ-বিগ্রহ হতো না, আপনাকে বায়তুল্লাহ যেতে বাধা দিতাম না। তখন রাসূল (স.) সন্ধির লেখক হযরত আলী (র.)কে বললেন ‘রাসূলুল্লাহ’ শব্দটি কেটে দিয়ে ওর ইচ্ছানুযায়ী শুধু আমার নাম লিখ। এতে হযরত আলী (র.) অপারগতা প্রকাশ করায়, রাসূল (স.) নিজ হাতেই তা কেটে দিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও উদারতার অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত পেশ করেন। (সীরাতুন্নবী (স.) ইবনে হিশাম, ৩য় খ-, পৃষ্ঠা-৩৩১ ও সীরাতুল মোস্তফা (স.) আল্লামা ইদ্রিস কান্দলবী (রহ.) ২য় খ- পৃষ্ঠা-৩০৯)। ইসলামের ইতিহাসে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে দেখা যায়, মক্কা বিজয়ের দিন মহানবী (স.) বিজয়ীবেশে মক্কায় প্রবেশ করলে কুরাইশদের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু মহানবী (স.) বিজিত শত্রুদের প্রতি কোন ধরনের দুর্ব্যবহার করেননি এবং কিঞ্চিৎ পরিমাণ প্রতিশোধস্পৃহাও প্রকাশ করেননি, বরং দুশমনদের প্রতি ক্ষমা ঘোষণা করেছেন। তিনি কুরাইশদের বলেছেন, ‘হে কুরাইশগণ! আমি তোমাদের সাথে কেমন ব্যবহার করবো বলে তোমরা মনে করো? তারা বললো, ‘আপনি আমাদের প্রতি ভালো ব্যবহার করবেন বলে আমাদের ধারণা। আপনি দয়ালু ভাই। দয়ালু ভাইয়ের পুত্র। অতঃপর রাসূল (স.) বললেন, আমি তোমাদের সাথে সেই কথাই বলছি, যে কথা হযরত ইউসুফ (আ.) তাঁর ভাইদের উদ্দেশে বলেছিলেনÑ ‘আজ তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই। যাও তোমরা সকলেই মুক্ত।’ (আর-রাহীকুল মাখতুম (উর্দু) পৃষ্ঠা-৬৩৩)। হযরত আনাছ (র.) বর্ণনা করেন, “আমরা একদিন মসজিদে নববীতে রাসূলে কারীম (স.)-এর সামনে বসা ছিলাম। এমন সময় একজন বেদুঈন এসে মসজিদের ভিতরে পেশাব করতে লাগল। এতে উপস্থিত সাহাবীগণ তাকে ধমক দিলে রাসূল (স.) বললেন, তাকে পেশাব করা থেকে বাধা প্রদান করো না। তাকে সুযোগ দাও; যাতে সে পেশাবের প্রয়োজন সেরে নিতে পারে, কারণ মধ্যখানে বন্ধ করলে ক্ষতি হবে। সে বেদুঈনের পেশাব করা শেষ হলে নবী কারীম (স.) তাকে ডেকে বললেন যে, এটা পেশাবের স্থান নয়; বরং এটা আমাদের ইবাদতখানা, পবিত্রস্থান। এ বলে তিনি তাকে বিদায় করে দিলেন এবং এক সাহাবীকে পানি নিয়ে আসতে বললেন। অতঃপর মহানবী (স.) নিজেই সাহাবীগণকে সাথে নিয়ে মসজিদ থেকে উক্ত পেশাব ধুয়ে দিলেন।” (বুখারী ও মুসলিম)। প্রতিশোধের পরিবর্তে শত্রুদের প্রতি মহানবী (স.)-এর ক্ষমা ও মহানুভবতার এমন অসংখ্য দৃষ্টান্ত শান্তি- সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় ইসলামের চিরন্তন আদর্শের জানান দেয়। পারস্পরিক সাক্ষাতে সালাম বিনিময়ের যে বিধান ইসলামে রয়েছে তাও সম্প্রীতির বন্ধন সুসংহতকরণের উজ্জ্বল প্রয়াস। ‘সালাম’ অর্থ শান্তি। সালাম বিনিময়ের মাধ্যমে মূলত একে অপরের শান্তিই কামনা করেন। এতে ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতির সেতুবন্ধন রচিত হয়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় ইসলাম এতই সোচ্চার যে, রাসূল (স.) নিজেদের জানমালের পাশাপাশি সংখ্যালঘু অমুসলিম সম্প্রদায়ের জানমাল রক্ষায় সচেষ্ট থাকার জন্যও মুসলমানদের প্রতি জোর তাগিদ দিয়েছেন। শুধু তাই নয়; অন্য ধর্মাবলম্বী ও তাদের উপাসনালয়ের ওপর আঘাত-সহিংসতাও ইসলামে জায়েজ নেই। সহিংসতা তো দূরের কথা অন্য ধর্মকে কটূক্তিও না করার জন্য কুরআন মজীদে আল্লাহপাক নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, “তোমরা তাদের মন্দ বলো না, যাদের তারা আরাধনা করে আল্লাহকে ছেড়ে।” (সুরা আনআম, আয়াত ১০৮)।
উপরোক্ত আলোচনায় সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়, বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি, শান্তি, সৌহার্দ্যপূর্ণ সহাবস্থান ও সদ্ব্যবহার ইসলামের অনুপম শিক্ষা। শান্তি ও মানবতার ধর্ম ইসলাম সংঘাত, সহিংসতা, বিশৃঙ্খলা ও সাম্প্রদায়িকতাকে চরমভাবে ঘৃণা করে। রাসূল (স.)-এর ওয়ারিশ হিসেবে হক্কানী ওলামায়েকেরাম নিরবচ্ছিন্নভাবে শান্তি-সম্প্রীতি ও মানবতার সুমহান শিক্ষা দান করে চলেছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।