Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কক্সবাজারে ঝুঁকির মুখে শত শত বহুতল ভবন

ইসিএ (ইকোলজিকাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া) এলাকায় উপেক্ষিত হাইকোর্টের নির্দেশনা, মাঝারী ভূমিকম্পে ধসে পড়তে পারে ৫০ ভাগ স্থাপনা

কক্সবাজার থেকে শামসুল হক শারেক | প্রকাশের সময় : ২ জুলাই, ২০২১, ৬:২৯ পিএম

দেশের পর্যটন রাজধানী খ্যাত কক্সবাজার শহর এবং বিস্তীর্ণ সৈকত এলাকায় গড়ে উঠা শত শত বিল্ডিং ঝুঁকিরমুখে বলে জানা গেছে। এসব বিল্ডিং গুলো নির্মাণের সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানা হয়নি বিল্ডিং কোড। এছাড়াও লবণাক্ত এলাকায় হওয়ায় অধিকাংশ বিল্ডিং নিচের অংশে ক্ষয়ে যাওয়ায় এগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। সুনামী বা মাঝারী ধরণের ভূমিকম্প হলেও এসব স্থাপনা গুলো মারাত্মক দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সম্প্রতি সিলেটে ঘন ঘন ভূমিকম্প এবং যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের মিয়ামি সৈকতে ১২ তলা বিশিষ্ট একটি আবাসিক ভবন ধসের ঘটনায় কক্সবাজার সৈকতের হোটেল মোটেল ও আবাসিক ভবন গুলো নিয়ে এই শঙ্কা দেখা দেয়।

প্রাপ্ত তথ্যমতে মিয়ামি সৈকতের উত্তরের সার্ফসাইড শহরের আবাসিক এলাকায় ওই ভবনটি ১৯৮০ সালে তৈরি করা হলেও মাত্র ৪০ বছর সময়ে এটি ধসে পড়ে। মাত্র ৪০ বছরের পুরোনো ভবনটিতে এমন বিপর্যয়ের কারণ এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে ২০১৮ সালের এক নিরীক্ষায় সেটির নিচের দিকে পার্কিং গ্যারেজের অবকাঠামোতে গুরুতর সমস্যা ধরা পড়েছিল বলে জানা গেছে। এতে নয়জনের মৃত্যু নিশ্চিত হলেও নিখোঁজ রয়েছে আরো ১৫০ জন।

কক্সবাজার শহরের কলাতলীর আবাসিক এলাকায় গড়ে উঠেছে ৪ শতাধিক বহুতল হোটেল মোটেল ভবন। একইভাবে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ সৈকত এলাকায় এবং মহেশখালী, কুতুবদিয়ায় ও সেন্টমার্টিনে গড়ে উঠেছে অসংখ্য বহুতল স্থাপনা।এগুলোর অধিকাংশের ক্ষেত্রে মানা হয়নি বিল্ডিং কোড এবং নেই পরিবেশের ছাড় পত্রও।

পরিবেশ বাদীদের মতে (ইকোলজিকাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া) ইসিএ এলাকায় গাদাগাদি করে গড়ে উঠা এগুলো যেন কনক্রিটের পাহাড়। মাঝারি ধরণের ভূমিকম্প হলেও এগুলো একটার উপর আরেকটা পড়ে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে। ঘটতে পারে অনাকাঙ্ক্ষিত প্রাণহানির ঘটনাও।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে বিভিন্ন সময়ে করা জরিপ মতে ঢাকায় মোট ১৩ লাখ, চট্টগ্রামে ৩ লাখ ও সিলেটে ১ লাখ বহুতল ভবন রয়েছে। এসব ভবনের ৭৫ শতাংশ হচ্ছে ছয়তলা বা তার চেয়ে বেশি। ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে এই ভবনগুলো ও এর বাসিন্দারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

কক্সবাজারে কী পরিমাণ বহুতল ভবন আছে, এগুলো বিল্ডিং কোড ও পরিবেশের ছাড় পত্র নিয়ে করা হয়েছি কিনা তার কোন হিসাব কোন দপ্তরে নেই। ২০০০ সালের পরে পর্যটন খাত চাঙ্গা হলে হুহু করে এসব বহুতল ভবন গুলো গড়ে উঠে। সৈকত এলাকায় তিন তলা থেকে ১০ তলা পর্যন্ত এই ভবন গুলো নির্মাণের অনুমতি দাতা কোন যথাযথ কর্তৃপক্ষ খোঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শহরে কক্সবাজার পৌরসভার অনুমোদন নিয়ে অধিকাংশ স্থাপনা হলেও আর কিছু হয়েছে জেলা প্রশাসনের অনুমোদনে। জানা গেছে, এসময় কাগজ পত্র একধরনের জমা দেয়া হলেও বিল্ডিং করা হয়েছে আরেক ধরণের। যার কারণে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে কক্সবাজার শহরের কলাতলীতে গড়ে উঠেছে কনক্রিটের শহর! এখন অবশ্য
কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠিত হওয়ার পর বিল্ডিং এর প্লান পাশ করতে কড়াকড়ি করা হচ্ছে।

কক্সবাজার গণপূর্ত বিভাগের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মোহাম্মদ আরিফুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, গণপূর্তের তত্ত্ববধানে নির্মিত ভবন গুলোতে বিল্ডিং কোড যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়েছে। বেসরকারী পর্যায়ে তারকা হোটেল গুলো বাদ দিলে কলাতলীর বহুতল স্থাপনা গুলোর অধিকাংশ ভবনে বিল্ডিং কোড মানা হয়েছে বলে মনে হয়না। তিনি আরো বলেন, অনুমোদন নেয়ার সময় হয়ত বিল্ডিং কোড মেনেই অনুমোদন নেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে তা অনুসরণ করা হয়নি।

এদিকে অভিজ্ঞজনদের মতে কক্সবাজার নাজিরার টেক থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ বালুকাময় সৈকতে কোন ধরণের স্থাপনা ফিজিবল নয় বলেই প্রমাণিত। দেখা গেছে এই এলাকায় কোন স্থাপনা করা হলে ভাঙন শুরু হয়। বিগত চার দলীয় জোট সরকারের সময় সৈকতের তিনটি পয়েন্টে জেটি স্থাপন করতে গিয়েও ভাঙনের মুখে তা সম্ভব হয়নি। সম্প্রতি সৈকতের ভাঙন ও সেখানে স্থাপনা নির্মাণের চেষ্টা বলে মনে করা হচ্ছে।

ওদিকে কক্সবাজার শহরতলীর নাজিরার টেক থেকে টেকনাফ -সেন্টমার্টিন পর্যন্ত সৈকত এলাকাকে ইসিএ (ইকোলজিকাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া) পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করে দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয় হাইকোর্টের কঠোর নির্দেশনা থাকলেও তা মানা হয়নি। হাইকোর্ট সাগর তীরের বহুতল ভবন গুলোতে যে কোন সময় বিপদ হতে পারে বলে আঁচ করে সৈকত এলাকায় বহুতল ভবন নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে এবং সেখানে নির্মিত বহুতল ভবনগুলো ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিয়েছে। এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনকে দায়িত্ব দেয়া হলেও তা কার্যকর হচ্ছেনা।

এছাড়াও ২০/৩০ বছর আগে সাগর তীরে নির্মিত শত শত ভবনের নিচের অংশে লবণাক্ততায় ক্ষয়ে গেছে। মাঝারী ধরণের ভূমিকম্প হলেও এসব ভবন গুলো ধসে পড়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায়না। এই মারাত্মক পরিস্থিতির দেখাশোনার জন্য কোন কর্তৃপক্ষের দায় দায়িত্ব আছে বলে জানা যায়নি।

এপ্রসঙ্গে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সাবেক সদস্য, প্রকৌশলী বদিউল আলম বলেন, কক্সবাজার শহরের ১০ ভাগেরও বেশী বিল্ডিং মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে পড়েছে। এছাড়াও অধিকাংশ বিল্ডিং এর ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোড অনুসরণ করা হয়নি। ৫ মাত্রার বা মাঝারী ধরণের ভূমিকম্পে এসব বিল্ডিংয়ের ৫০ ভাগই ধসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে এসব বিল্ডিং এর ৯০ ভাগই ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি বলেন, সবচাইতে বড় কথা হল এগুলো দেখার জন্য সুনির্দিষ্ট কোন কর্তৃপক্ষ নেই।

ঝুঁকিপূর্ণ ভবন গুলো নিরূপণ করে হাইকোর্ট এর নির্দেশনা বাস্তবায়নের পাশাপাশি ভূমিকম্পের সম্ভাব্য ক্ষতি থেকে রক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পরিকল্পিত নগরায়ণ এবং সরকারি বেসরকারি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়ে দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার প্রশিক্ষণ জরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কক্সবাজার


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ